ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বাড়ির মালিককে টার্গেট করে ডাকাতি

রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে বাড়ির মালিককে টার্গেট করে ডাকাতি

সোহেল ওরফে জামাই সোহেল, ডাকাতিই তার পেশা। ঢাকায় একটি ডাকাত দল নিয়ন্ত্রণ করে এই জামাই সোহেল। তার নামে ১২টি এবং সহযোগী মোহাম্মদ রুবেল শেখের নামে পাঁচটি মামলা রয়েছে। রাজধানীর বিভিন্ন স্থান ঘুরে ঘুরে ডাকাতির উদ্দেশে বাসা-বাড়ি টার্গেট করে তারা। এরপর আশপাশে কয়েক দিন র?্যাকি করে ডাকাতিতে নামে চক্রটি।

রাজধানীর মালিবাগের একটি বাসায় চারটি শীতাতপ নিয়ন্ত্রণ যন্ত্র (এসি) লাগানো দেখে ডাকাতির জন্য বাসাটি চিহ্নিত করে তারা। বাড়িটিতে ডাকাতির ঘটনায় হওয়া মামলার তদন্ত কর্মকর্তা বলেন, ওই ভবনের অন্য ফ্ল্যাটে একটি করে এসি লাগানো ছিল। তাছাড়া ডাকাত চক্রটি কোনো বাসার গৃহকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করে না, ধরা পড়ে যাওয়ার ভয়ে।

গত বুধবার সরজমিন দেখা যায়, শাহজাহানপুর ১৩০-বি, মালিবাগ ১ম লেনের ২য় তলার একটি ফ্ল্যাটে থাকেন ভুক্তভোগী পরিবারটি। ছয়তলা ভবন পুরোটাই তাদের। বাসার পূর্ব পাশের মাঝখানের বেডরুমের জানালার গ্রিলের চারটি রড কাটা। ওই জানালার নিচেই অন্য মালিকের একটি টিনশেড রুম। সেই টিনশেড রুমের চালের উপর দাঁড়িয়ে ডাকাতরা জানালার গ্রিল কাটে।

ভুক্তভোগী ষাটোর্ধ্ব রোকেয়া বেগমের সঙ্গে কথা হয় গণমাধ্যমে। পরিবার নিয়ে থাকেন মালিবাগে নিজস্ব বাসায়। রাত চারটার পরে কিছু একটা কানে এলে আকস্মিক ঘুম ভাঙে তার। বিছানায় শুয়ে শব্দের উৎস বোঝার চেষ্টা করেন তিনি। পাশে শুয়ে থাকা স্বামী শামসুদ্দিন আহমেদকে না ডেকে নিজেই রুম থেকে বের হয়ে ডাইনিং রুমে আসেন। সঙ্গে সঙ্গে দুজন ব্যক্তি পর্দার আড়াল থেকে বেরিয়ে গলায় অস্ত্র চেপে ধরে কথা বলতে নিষেধ করেন। জীবনের ভয়ে চুপ থাকেন রোকেয়া। রোকেয়া বলছিলেন, আর যতদিন বাঁচব, এই স্মৃতি নিয়ে বাঁচতে হবে। সেদিনের কথা কোনোমতেই ভুলতে পারছি না। এখনও রাতে আচমকা কোনো শব্দে ঘুম ভাঙলে ভয় ধরে যায়।

সেদিন রোকেয়া দম্পতি ফ্ল্যাটের পূর্ব পাশের উত্তর দিকের বেডরুমে শোয়া ছিলেন। আর তাদের ছেলে রফিকুল দক্ষিণ পাশের বেডরুমে ঘুমিয়ে ছিলেন। বাসার পূর্ব পাশের মাঝখানের রুমটি খালি। ওই রুমের দরজায় পর্দা ঝুলানো ছিল। ডাকাতরা রুমে ঢুকে পর্দার পেছনে দাঁড়িয়ে ছিল। ডাইনিং রুমে যেতেই অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে ফেলে আমাকে, জানান ভুক্তভোগী রোকেয়া বেগম।

তিনি বলেন, প্রথমে দুই ডাকাত আমার মাথায় অস্ত্র ঠেকিয়ে রাখে। আর দুজন পুরো বাসা ঘুরে দেখার পর দরজা লাগানো ছেলের রুম খুলতে বলেন। এসময় রোকেয়া বেগম নিজেই ছেলেকে দরজা খুলে বাইরে আসতে বলেন। তখনও ছেলে বাইরের অবস্থা কিছুই জানে না। রফিকুল দরজা খুলতেই আমার মাথা থেকে অস্ত্র সরে ছেলের মাথায় গিয়ে ঠেকে। এটা আরও বড় ভয় কীভাবে আমি আমার ছেলেকে নিজে ঘুম থেকে ডেকে তুলে ডাকাতদের অস্ত্রের মুখে ফেললাম। সেটা ভাবতেই মাথা ধরে আসে। ১৫ দিন আগের ঘটনা হলেও এখনও ভয়ে গা ছমছম করে। এখন রুমের দরজা বন্ধ করেই ঘুমাই। গত রোববার দিবাগত রাত ৪টার পরে ওই ঘটনা ঘটে। পরে ২ জানুয়ারি সকালে শাহজাহানপুর থানায় মামলা করেন তার ছেলে রফিকুল।

অভিযোগ পেয়ে থানা পুলিশ, ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে। এছাড়া সেখান থেকে আলামত সংগ্রহ করেন পুলিশ কর্মকর্তারা।

জানা যায়, রোকেয়া বেগমের স্বামী মুক্তিযোদ্ধা শামসুদ্দিন আহমেদ তার ছেলে ব্যবসায়ী রফিকুল ইসলাম, ছেলের বউ, নাতি-নাতনি নিয়ে শাহজাহানপুর মালিবাগ ছয়তলা ভবনের একটি ফ্ল্যাটে থাকেন। সেদিন ছেলের বউ ঢাকার লালমাটিয়ায় তার বাবার বাসায় বেড়াতে যান। এতে বাসার কাজ শেষ করে ঘুমাতে একটু দেরি হয়।

মামলার বাদী ভুক্তভোগী রফিকুল ইসলাম বলেন, ডাকাতদের সবার মুখে মাস্ক ছিল। রুমের দরজা খুলতেই অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে। পরে বিছানার চাদর কেটে বাবা-মাসহ আমার হাত-মুখ বেঁধে ফেলে। চার জনের দুজন আমাদের এক রুমে নিয়ে অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে। এসময় আমাদের মোবাইল ফোন নিয়ে সিম কার্ড খুলে ফেলে। আর বাকি দুজন বাসার টাকা-পয়সা, সোনা-রুপা আছে দিতে বলে। বাসার চারটি বেড, ড্রয়িংসহ প্রতিটি রুমের আলমারি, ড্রয়ার থেকে সব কাপড়চোপড়, কাগজপত্র এলোমেলো করে টাকা-পয়সা, সোনার খোঁজ করতে থাকে তারা। এর মধ্যে আমার বাবা কথা বলার চেষ্টা করলে একজন তার পিঠে চাপাতি দিয়ে কোপ দেয়। মাকে আঘাত করার ভয় দেখিয়ে চুপ থাকতে বলে। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতাল থেকে চিকিৎসা নিয়ে এখন বাসায় আছেন বাবা।

ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) মতিঝিল বিভাগের উপকমিশনার (ডিসি) হায়াতুল ইসলাম খান বলেন, ঘটনার ১৫ দিনের মধ্যে গত ১৫ জানুয়ারি রাজধানী, কুমিল্লা ও গাজীপুরের বিভিন্ন স্থানে অভিযান চালিয়ে জড়িত চার ডাকাতকে গ্রেপ্তার করা হয়। এসময় ডাকাতির কাজে ব্যবহৃত যন্ত্রপাতি ও জামাই সোহেলের হেফাজত থেকে কয়েক রাউন্ড গুলি, ম্যাগাজিন ও একটি পিস্তল উদ্ধার করা হয়। পরে তাদের বিরুদ্ধে অস্ত্র আইনে আরও একটি মামলা করা হয়েছে।

গ্রেপ্তারকৃতরা হলেন, ডাকাত দলের সর্দার সোহেল ওরফে জামাই সোহেল, তার প্রধান সহযোগী মোহাম্মদ রুবেল শেখ, জাহাঙ্গীর ওরফে লালু ও রাজন মোড়ল। এর মধ্যে গ্রেপ্তার ডাকাত দলের সর্দার সোহেল ওরফে জামাই সোহেল বিরুদ্ধে ডিএমপির বংশাল, শাজাহানপুর ও রামপুরা থানায় ১২টি এবং মোহাম্মদ রুবেল শেখের নামে ডাকাতি, দস্যুতা, খুনসহ পাঁচটি মামলা রয়েছে বলে জানান পুলিশের এই কর্মকর্তা।

ডিএমপির শাহজাহানপুর থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) অমিত হাসান মাহমুদ বলেন, গ্রেপ্তার চার ডাকাতকে সেদিন আদালতে তুলে জামাই সোহেল ও রুবেল শেখকে রিমান্ড আবেদন করা হয়। পরে আদালত তাদের ?দুজনের চারদিন করে রিমান্ড আবেদন মঞ্জুর করেন।

ডাকাত দলের সদস্যদের অস্ত্রের উৎস জানতে চাইলে এসআই অমিত হাসান মাহমুদ বলেন, ডাকাত দলের সদস্যরা কোথা থেকে অস্ত্র সংগ্রহ করে, সেটা জানার চেষ্টা চলছে। এছাড়া তাদের নিয়ে বৃহস্পতিবার অস্ত্র উদ্ধারে বের হওয়ার কথা রয়েছে। এছাড়া চার দিনের রিমান্ডে এনে জিজ্ঞাসাবাদে বেশ কিছু নতুন তথ্য পাওয়া গেছে। সেটা নিয়েও কাজ করছি।

আলোকিত বাংলাদেশ
আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত