দেশের নদ-নদী রক্ষায় ২০১৩ সালে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন (এনআরসিসি) প্রতিষ্ঠা করা হয়। এরপর থেকে ৪৮টি নদী রক্ষায় জোরাল ভূমিকা নিয়েছে সংস্থাটি। প্রভাবশালীদের শত বাধা উপক্ষো করেই নদীরক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান হাওলাদারের নেতৃত্বে নদীর দখলদারদের একটি তালিকাও তৈরি করা হয়। তবে নদী রক্ষা কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী ওই তালিকা সংশোধন করতে যাচ্ছেন। একই সঙ্গে তালিকাটি প্রকাশ না করে গোপন রাখার পক্ষে। তবে বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন, তালিকা গোপন রাখা মানেই নদী দখলদারদের সঙ্গে এনআরসিসির কর্মকর্তাদের অবৈধ লেনদেনের সুযোগ করে দেয়া। এমনও হতে পারে- নদী রক্ষা কমিশন মাঝেমধ্যেই দখলদারদের উচ্ছেদের নামে হুমকি দিয়ে ব্যক্তিগতভাবে আর্থিক লাভবান হওয়ার সুযোগ রয়েছে।
জানা গেছে, এনআরসিসি সারা দেশে নদীরক্ষায় কাজের পরিদর্শনের চেয়ে রাজধানীতেই সভা, সেমিনারের মধ্যেই সীমাবদ্ধ রয়েছে। সংস্থাটির কাজ নদীকে দখল ও দূষণের হাত থেকে রক্ষা করা। নদীর পাড় যেখানে সুস্পষ্ট, সেখানে নদী চিহ্নিত করা সহজ। অথচ দিনের পর দিন নদীর জায়গা দখল করে আবাসন প্রকল্প ও শিল্পকারখানা গড়ে তোলার পাশাপাশি দোকানপাট ও বাজার হয়েছে। ঘরবাড়ি করে স্থানীয়রাও নদীর জমি দখল করেছে। ফলে নদীদূষণসহ অবৈধ স্থাপনা তৈরি করায় মূল নদীর প্রবাহ অত্যন্ত সংকুচিত হয়ে পড়ছে।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানা গেছে, নৌ পরিবহণ মন্ত্রণালয়, ভূমি মন্ত্রণালয়, পানিসম্পদ মন্ত্রণালয়, মৎস্য ও পশুসম্পদ মন্ত্রণালয়, পরিবেশ মন্ত্রণালয় ও শিল্প মন্ত্রণালয়ের মধ্যে নদী-সংক্রান্ত কাজের কোনো সমন্বয় করছে না জাতীয় নদী রক্ষা কমিশন। এতে অন্যান্য কমিশনের মতোই কাগুজে বাঘ হয়ে পদ-পদবির মধ্যে নিজেদের সীমাবদ্ধ রেখেছে নদীরক্ষা কমিশন। নদীর মালিকানা গ্রহণের কোনো উদ্যোগ দেখা যায়নি। কমিশন রাজধানীতে বসে ফাইলের মধ্যে নদী রক্ষা করছে আর সারাদেশ নদীগুলো দখল-দূষণে অস্তিত্ব হারাতে বসেছে। ব্রহ্মপুত্র, শীতলক্ষ্যা, মেঘনা ও ধলেশ্বরী নদীগুলোর অনেক জায়গা বড় বড় শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো দখল করে নেয়ার চিত্র দেখা গেছে। এনআরসিসি নদীর মালিকানা গ্রহণ করতে ব্যর্থ হয়েছে।
নদী দখলদারদের তালিকা সংশোধন ও দখলদারদের নাম প্রকাশ না করায় বর্তমান নদীরক্ষা কমিশনের বিরুদ্ধে নদী খেকোদের রক্ষার অভিযোগ উঠেছে। এ বিষয়ে নদীরক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, নদী দখলদারের তালিকাটি ঠিকমতো তৈরি করা হয়নি। এই তালিকা প্রজেক্টের মাধ্যমে করার প্রয়োজন ছিল না। কারণ কারা কারা নদী দখল করছে, এটি একমাত্র জেলা প্রশাসক বলতে পারবেন। নদী দখলদারদের তালিকা তৈরি অন্য কোনো বিভাগের দায়িত্ব নয়। আর নদীর দখলদারদের তালিকা মুছে ফেলা হয়নি, সংস্থার নিরাপত্তার স্বার্থে তালিকা গোপন রাখা হয়েছে।
ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, নদীর পাড় দখল করে ছোট ছোট ঘরবাড়ি যারা গড়ে তুলেছেন তাদের উচ্ছেদের করার আগে বড় বড় শিল্পকারখানা উচ্ছেদের দিকে মনোযোগ দিয়েছে নদীরক্ষা কমিশন। সেজন্য চট্টগ্রাম থেকে শুরু করে বিভিন্ন নদীর পাড়ে গড়ে ওঠা স্থাপনা উচ্ছেদের কার্যক্রম চালাচ্ছে।
তিনি আরও বলেন, নদীর পাড় ঘেঁষে মানুষ বসবাস করলেই তাকে হুট করে দখলদার বলা যাবে না। কারণ, তার জমির খতিয়ান ও মৌজা থাকতে পারে। সেজন্য নদী দখলদার না হয়েও তালিকায় নাম এলে এবং সেটি জনসম্মুখে প্রকাশ করলে ওই ব্যক্তি ক্ষুব্ধ হয়ে নদীরক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যানের বিরুদ্ধে মামলা করতে পারেন। আর যদি খতিয়ান ও মৌজায় খাস জমি হয় তাহলে তাকে দখলদার বলা যাবে। কিন্তু পানি আইন অনুসারে নদীর পাড় দখলদারের কোনো সংজ্ঞা নেই। কারণ, পানি আইন অনুযায়ী নদীর পাড় থেকে ১০ মিটার পর্যন্ত নদীর জমি ধরা হয়। কিন্তু দেখা যায় বছরে বছরে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হয়। সেখানে আজকে যাকে নদী দখলদার বলা হচ্ছে, আগামীতে নদীর গতিপথ পরিবর্তন হলে পানি আইনে তাকে তো দখলদার বলা চলবে না।
নদী রক্ষা কমিশনের চেয়ারম্যান আরও বলেন, ২০২২ সালের ২৮ ডিসেম্বর নদীর দখলদারদের তালিকা আমার কাছে দিয়েছে। দখলদারের এই সংখ্যা ছিল ৫৭ হাজার ৩৯০ জন। তালিকা থেকে কোনো দখলদারের নাম মুছে ফেলা হয়নি।
নদীরক্ষা কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী নদীরক্ষা না করে বরং নদী খেকোদের রক্ষার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন। তার আত্মীয়স্বজনসহ সংশ্লিষ্ট অনেকেই নদী দখলদার। তাদের আড়াল করতে জেলা প্রশাসকদের মাধ্যমে তৈরি নদী দখলদারদের তালিকা সংশোধন বা বাতিল করার উদ্যোগ নিয়েছেন তিনি। সম্প্রতি ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) ওয়াটারকিপার্স বাংলাদেশ আয়োজিত এক কর্মশালায় এমন অভিযোগ তুলেছেন নদী রক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান মুজিবর রহমান হাওলাদার। তবে এসব অভিযোগ অস্বীকার করেছেন মনজুর আহমেদ চৌধুরী। মুজিবর রহমান হাওলাদার বলেন, ‘কমিশন থেকে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এবং দেশের আইন মেনে দখলদারদের তালিকা তৈরি করা হয়েছে। কিন্তু চেয়ারম্যান ওই তালিকা প্রকাশ না করে পুনর্মূল্যায়নের নামে তালিকা থেকে অনেক দখলদারের নাম বাতিল করতে চান। দখলদারের নাম তালিকা থেকে বাদ দেয়ার জন্য আর্থিক সুবিধা নেয়ার কথাও আমরা শুনতে পাচ্ছি।’
তিনি বলেন, সরকারের একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী আমাকে একদিন বললেন, ‘আপনাদের মাঠপর্যায়ে গিয়ে তালিকা করার দরকার নেই। ঢাকায় বসে কাজ করলেই চলবে। কিন্তু আমি ওই মন্ত্রীর এলাকায় গিয়ে দেখি তার বাবার আমল থেকে দুটি শিল্পকারখানা নদী দখল করে চালানো হচ্ছে।’
তিনি আরও বলেন, ‘অনেক সংসদ সদস্য, উপজেলা চেয়ারম্যান ও প্রভাবশালী নেতা নদী দখল করে আছেন। তাদের নাম বাদ দিতে বর্তমান চেয়ারম্যান দখলদারদের তালিকা সংশোধন করছেন।’
নদীরক্ষা কমিশনের সাবেক চেয়ারম্যান বলেন, ‘দেশে নদী যে দখল ও দূষণের শিকার হচ্ছে, তা বুঝতে বিজ্ঞান ও গবেষণার দরকার হয় না। নদীর পাশ দিয়ে হেঁটে গেলেও বোঝা যায়। নদী রক্ষা কমিশনের কাজ ছিল এরই মধ্যে চিহ্নিত হওয়া দখলদারদের উচ্ছেদে উদ্যোগ নেয়া। যাদের নদী দখলদারদের তালিকা যাচাই-বাছাই করার দায়িত্ব দেয়া হচ্ছে, তাদের সম্পদের হিসাব নিলে ওই তালিকা সংশোধনের আসল কারণ বেরিয়ে আসবে।’ ড. মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী নিয়োগপত্রের শর্তও রাখেননি অভিযোগ করে মুজিবুর রহমান হাওলাদার বলেছেন, জাতীয় নদীরক্ষা কমিশন আইন ২০১৩ এর ধারা ৫(২) এবং একই আইনের ধারা ৫(৩) অনুযায়ী ড. মঞ্জুরকে অন্যান্য প্রতিষ্ঠান ও সংগঠনের সঙ্গে কর্মসম্পর্ক পরিত্যাগের শর্তে নিয়োগ দেয়া হলেও তিনি সেই শর্ত ভঙ্গ করে নদীদখল করে আত্মীয়স্বজনের মাধ্যমে পরিচালিত ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত রয়েছেন। অন্যদিকে তিনি চেয়ারম্যানের দায়িত্বে বসার পর ক্ষমতার অপব্যবহার করছেন। কমিশনের সুপারিশ করার ক্ষমতা থাকলেও তিনি নিজেই নির্দেশ দিয়ে লিখিত চিঠি পাঠিয়েছেন। এটি নিয়োগবিধির লঙ্ঘন।
তবে এসব অভিযোগ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় নদীরক্ষা কমিশনের বর্তমান চেয়ারম্যান মঞ্জুর আহমেদ চৌধুরী বলেন, সাবেক চেয়ারম্যানের এসব অভিযোগ মিথ্যা ও উদ্দেশ্যপ্রণোদিত। দখলদারদের তালিকা তৈরির প্রক্রিয়ার সঙ্গে তিনি (মুজিবুর রহমান হাওলাদার) জড়িত ছিলেন না। তিনি দায়িত্ব ছেড়ে দেয়ার পর আমি চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় ওই তালিকা তৈরি করা হয়। কিন্তু তালিকায় বেশ কিছু ভুলত্রুটি ধরা পড়ায় আমরা তা সংশোধন করছি। কোনোভাবেই তা বাতিল করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়নি।
এ বিষয়ে কমিশনের সদস্যদের বক্তব্য হলো- হাইকোর্টের এক রায়ে সিএস রেকর্ডের ভিত্তিতে অবৈধ দখলদারদের চিহ্নিত করতে বলা হয়েছিল। কিন্তু প্রকল্পে তাদের চিহ্নিত করা হয়েছে পানি আইন ২০১৩-এর ভিত্তিতে। এ কারণে প্রকল্পে চিহ্নিত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানের নাম ও তালিকা কমিশনে দেয়া প্রতিবেদনে এবং ডাটাবেজে অন্তর্ভুক্ত করা যাবে না এবং তা প্রকাশ করা যাবে না। কিন্তু ১৯৪০ সালে করা সিএস রেকর্ডে চিহ্নিত সব নদ-নদীর অবস্থান এখন আগের জায়গায় নেই জানিয়ে প্রকল্প-সংশ্লিষ্টরা বলেছেন, পানি আইনে নদীর সীমানা ও ফোরশোরকে (তীরবর্তী ভূমি) সুস্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়েছে। আবার আলোচিত প্রকল্পটিতে দখলদারদের চিহ্নিত করতে শুধু পানি আইন নয়, বন্দর আইন ও ভূমি আইনেরও সহায়তা নেয়া হয়েছিল। পাশাপাশি দখলদার চিহ্নিত করতে জিপিএস ব্যবহার এবং সরেজমিন পরিদর্শনও করা হয়েছিল। আইনগুলোর সঙ্গে হাইকোর্টের রায়ের কোনো বিরোধ নেই জানিয়ে পরিবেশ আইনবিদরা বলেন, এগুলো বরং একটি আরেকটির পরিপূরক। আবার সিএস রেকর্ডেও দেশের সব নদ-নদীর সীমানার হালনাগাদ তথ্য নেই। সুতরাং, কমিশনের দখলদারদের তালিকা মুছে দেয়ার বিষয়টিকে যৌক্তিক বলা যাচ্ছে না কোনোভাবেই।