ভূমিকম্প আঘাত হানার ১৯৮ ঘণ্টা পর তুরস্কের দক্ষিণাঞ্চলের একটি ধসে যাওয়া ভবনের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ১৮ বছর বয়সি এক কিশোরকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। ধ্বংসাত্মক ভূমিকম্পের ৮ দিনের বেশি সময় পর মঙ্গলবার সকালের দিকে ওই কিশোরসহ মোট তিনজনকে জীবিত উদ্ধার করেছেন তুরস্কের উদ্ধার কর্মীরা। গত সোমবার স্মরণকালের ভয়াবহ ভূমিকম্প আঘাত হানে প্রতিবেশী দুই দেশ তুরস্ক ও সিরিয়ায়। রিখটার স্কেলে ৭ দশমিক ৮ মাত্রার শক্তিশালী ভূমিকম্পে উভয় দেশে এখন পর্যন্ত ৩৭ হাজারের বেশি মানুষের প্রাণহানি ঘটেছে। ভূমিকম্প আঘাত হানার ৮ দিনের বেশি সময় পেরিয়ে গেলেও আজ কয়েকজনকে ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। হাজার হাজার ভবনের ধ্বংসস্তূপে উদ্ধার অভিযান চলমান থাকায় প্রাণহানির সংখ্যা দ্বিগুণেরও বেশি হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে জাতিসংঘ। সম্প্রচারমাধ্যম সিএনএন তুর্ক এক প্রতিবেদনে বলছে, মঙ্গলবার সকালের দিকে তুরস্কের আদিমান প্রদেশের একটি ধসে যাওয়া ভবনের নিচ থেকে মুহাম্মদ জাফর নামের এক কিশোরকে জীবিত উদ্ধার করা হয়েছে। টেলিভিশনে প্রচারিত ভিডিও ফুটেজে দেখা যায়, ভূমিকম্পে ক্ষতিগ্রস্ত আদিমানের একটি ভবনের ধ্বংসাবশেষের নিচ থেকে ওই কিশোরকে উদ্ধারের পর স্ট্রেচারে করে নেয়া হচ্ছে। এ সময় তার মুখে অক্সিজেন মাক্স ও হাতে স্যালাইন লাগানো দেখা যায়। পরে সেখান থেকে একটি অ্যাম্বুলেন্সে করে স্থানীয় এক হাসপাতালে নেয়া হয় তাকে। ভূমিকম্পে ধসে যাওয়া ভবনের নিচে আটকে পড়ার প্রায় ১৯৮ ঘণ্টা পর উদ্ধার এই কিশোরকে স্ট্রেচারে করে নিয়ে যাওয়ার সময় হাতের আঙুল নড়াচড়া করতে দেখা যায়।
এই ঘটনার কিছুক্ষণ আগেই দেশটির উদ্ধারকারীরা পার্শ্ববর্তী কাহরামানমারাস প্রদেশের একটি ভবনের ধ্বংসাবশেষ থেকে দুই সহোদরকে জীবিত উদ্ধার করেন। তুরস্কের রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তা সংস্থা আনাদোলু কাহরামানমারাস প্রদেশের ধ্বংসস্তূপের নিচ থেকে ১৭ বছর বয়সি মুহাম্মদ এনেস ইয়েনিনার ও তার ভাই ২১ বছর বয়সি বাকি ইয়েনিনারকে উদ্ধার করা হয়েছে বলে জানিয়েছে। পরে ধ্বংসস্তূপের পাশেই রাখা অ্যাম্বুলেন্সে করে একটি হাসপাতালে নেয়া হয় তাদের। তবে এই দুই ভাইয়ের শারীরিক অবস্থার ব্যাপারে পরিষ্কার কোনো তথ্য পাওয়া যায়নি।
তুরস্কে ১০ লাখেরও বেশি মানুষ গৃহহীন হয়ে পড়েছে এবং সাহায্য সংস্থাগুলো বলছে, সিরিয়ায় এই সংখ্যা আরও বেশি হতে পারে। দুই দেশেরই উদ্ধারকারী দলগুলো এখন বিস্তীর্ণ এলাকায় উদ্ধার কাজ গুটিয়ে আনছে। কারণ জীবিত কাউকে উদ্ধারের সম্ভাবনা ক্ষীণ হয়ে আসছে। খবর : বিবিসির
জাতিসংঘ বলছে, গত সপ্তাহের মারাত্মক ভূমিকম্পে বিধ্বস্ত হওয়ার পর দেশটিতে ত্রাণ সহায়তা পৌঁছাতে আরও দুটি সীমান্ত পারাপার খুলতে রাজি হয়েছে সিরিয়ার সরকার। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্তোনিও গুতেরেসের একজন মুখপাত্র বলেছেন, ‘এটি একটি বড় পরিবর্তন আসতে চলেছে। আমরা এখন পর্যন্ত একটি সীমান্ত পারাপার ব্যবহার করছি। অনেক সিরীয় নাগরিক তাদের যুদ্ধ-বিধ্বস্ত দেশে সহায়তা না পৌঁছানোয় ক্ষোভ প্রকাশ করেছে। প্রেসিডেন্ট বাশার আল-আসাদের সরকার উদ্ধার তৎপরতা ব্যাহত হওয়ার জন্য দেশটির উপর আরোপিত পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞাকে দায়ী করেছে। তবে আন্তর্জাতিক সাহায্য গোষ্ঠীগুলো বলছে, আসাদ সরকারের অব্যবস্থাপনা এবং দেশের সব এলাকায় উদ্ধার কাজে সংযুক্ত না হওয়াটাই মূল প্রতিবন্ধকতা। গত সোমবার দামেস্কে প্রেসিডেন্ট আসাদের সঙ্গে উচ্চ পর্যায়ের বৈঠকের পর জাতিসংঘ নতুন দুটি সীমান্ত পারাপার খুলে দেয়ার এই ঘোষণা দিয়েছে। এগুলো হচ্ছে- তুরস্কের সীমান্তের সঙ্গে থাকা বাব আল-সালাম এবং আল-রাই সীমান্ত পারাপার। এতে বলা হয়েছে, বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত উত্তর-পশ্চিম সিরিয়ায় সীমান্ত পারাপার প্রাথমিকভাবে তিন মাসের জন্য খোলা থাকবে।
বিবিসি রেডিও ফোরের ওয়ার্ল্ড টুনাইট প্রোগ্রামকে গুতেরেসের মুখপাত্র স্টিফেন দুজারিক বলেছেন, ‘খুব শিগগিরই আমরা অন্য দুটি পারাপার ব্যবহার করব। আমরা আশা করি, যতক্ষণ পর্যন্ত আমাদের এটি ব্যবহার করতে হবে ততক্ষণ পর্যন্ত চুক্তিটি স্থায়ী হবে। আমরা যত তাড়াতাড়ি সম্ভব এটি ব্যবহার করা শুরু করব এবং আমি এটি ছাড়া আর কোনো কিছুই ভাবতে চাই না। দুজারিক আরও বলেন, ‘আমি শুধু অনুমান করতে চাই যে, মানুষ এই সংঘর্ষে যে পক্ষকেই সমর্থন করুক না কেন এখন তারা রাজনীতিকে সরিয়ে রাখবে।’ তবে কবে নাগাদ দুটি সীমান্ত পারাপার চালু হবে সে বিষয়ে বিস্তারিত কিছু জানাননি তিনি। ভূমিকম্পের পর প্রথম কয়েক দিনে সিরিয়ার সরকারনিয়ন্ত্রিত এলাকায় কিছু ত্রাণ সরবরাহ পৌঁছেছিল। মূলত রাশিয়া, ইরান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের মতো বন্ধু রাষ্ট্রগুলো থেকে এসব সহায়তা আসে। কিন্তু সিরিয়ার বিধ্বস্ত উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলীয় বিদ্রোহী নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলো কার্যত বিচ্ছিন্ন থেকে গেছে। এর কারণ এই অংশগুলোতে আন্তর্জাতিক মানবিক সাহায্য শুধুমাত্র তুরস্ক হয়ে যাওয়া একটি সীমান্ত পারাপার ব্যবহার করে পৌঁছাতে পারে। অথবা সিরিয়ার সরকার-নিয়ন্ত্রিত এলাকাগুলোর মধ্য দিয়ে সেগুলো পৌঁছাতে পারে। এদিকে রয়টার্সের খবরে বলা হয়েছে, তুরস্কের দুর্যোগ ও জরুরি ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, তাদের এখানে মৃতের সংখ্যা ১৯৩৯ সালের ভূমিকম্পকে ছাড়িয়ে গিয়ে ৩১৬৪৩ জনে দাঁড়িয়েছে। এটি আধুনিক তুরস্কের ইতিহাসে সবচেয়ে প্রাণঘাতী ভূমিকম্পে পরিণত হয়েছে।