ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

নীল কমল নদীর জলরাশি ভেদ করে হিরণ পয়েন্ট

নীল কমল নদীর জলরাশি ভেদ করে হিরণ পয়েন্ট

প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এক অপূর্ব লীলাভূমি আমাদের সুন্দরবন। চিরসবুজ-নিস্তব্ধ এই বনের প্রধান বৃক্ষ সুন্দরী; এই বৃক্ষের নামানুসারে সুন্দরবনের নামকরণ। পদ্মা, মেঘনা ও ব্রহ্মপুত্র নদীত্রয়ের অববাহিকার বদ্বীপ এলাকায় অবস্থিত এই অপরূপ বনভূমি বাংলাদেশের খুলনা, সাতক্ষীরা, বাগেরহাট, পটুয়াখালী ও বরগুনা জেলা এবং ভারতের পশ্চিমবঙ্গ রাজ্যের দুই জেলা উত্তর চব্বিশ পরগনা ও দক্ষিণ চব্বিশ পরগনাজুড়ে বিস্তৃত। সমুদ্র উপকূলবর্তী নোনা পরিবেশের সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ বন হিসেবে সুন্দরবন বিশ্বের সর্ববৃহৎ অখণ্ড বনভূমি। ১০ হাজার বর্গ কিলোমিটার জুড়ে গড়ে ওঠা সুন্দরবনের ৬ হাজার ৫১৭ বর্গ কিলোমিটার (৬৬%) রয়েছে বাংলাদেশে এবং বাকি অংশ (৩৪%) রয়েছে ভারতের মধ্যে। সুন্দরবন সম্পদ এবং জীববৈচিত্র্যে সমৃদ্ধশালী হওয়ায় ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃতি পেয়েছে। ১৯৯৭ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্যবাহী স্থান হিসেবে সুন্দরবনকে স্বীকৃতি দেয়। দর্শনার্থীদের জন্য সুন্দরবনের ভেতরে যেতে হলে নৌপথই একমাত্র উপায়। শীতকাল হচ্ছে সুন্দরবন ভ্রমণের সবচেয়ে উপযুক্ত সময়। একজন দর্শনার্থীর পক্ষে পুরো সুন্দরবন ঘুরে দেখা সম্ভব না হলেও এই বনের বিশেষ কিছু দর্শনীয় স্থান রয়েছে। যে স্থানগুলো ভ্রমনপ্রিয় মানুষদের ভ্রমণ আকাঙ্ক্ষা মিটানোর জন্য সবচেয়ে উপযুক্ত হতে পারে তার মধ্যে হিরণ পয়েন্ট নিজস্ব বৈশিষ্ট্যে বৈচিত্র্যময়। হিরণ পয়েন্ট হলো বাংলাদেশের দক্ষিণাঞ্চলে অবস্থিত পৃথিবীর সর্ববৃহৎ নোনা পানির বন সুন্দরবনের দক্ষিণাংশের একটি সংরক্ষিত অভয়ারণ্য। এর আরেক নাম নীলকমল। প্রমত্তা কুঙ্গা নদীর পশ্চিম তীরে, খুলনা রেঞ্জে এর অবস্থান। হিরণ পয়েন্ট, ইউনেস্কো ঘোষিত অন্যতম একটি বিশ্ব ঐতিহ্য। আমরা যাত্রা শুরু করলাম ইউনেস্কো ঘোষিত অন্যতম বিশ্ব ঐতিহ্য হিরণ পয়েন্ট সুন্দরবনের উদ্দেশে। আমাদের জাহাজ ছুটে চলেছে দুবলার চরকে বামে রেখে নীল কমল নদীর জলরাশি ভেদ করে। সুন্দরবনের বহু ছোট ছোট নদীর মধ্যে নীলকমল অন্যতম, যা সুন্দরবনের সৌন্দর্যে নতুন মাত্রা যোগ করেছে। এই নদীর উৎপত্তি পশুর নদীর মোহনায় এবং যার প্রান্ত মিলিত হয়েছে বঙ্গোপসাগরে। সুন্দরবনের মূল অংশ থেকে হিরণ পয়েন্টকে অনেকটাই বিচ্ছিন্ন করেছে এই নীল কমল নদী। মূলত এই নদীর নামানুসারে হিরণ পয়েন্টকে ভিন্নভাবে নীল কমলও বলা হয়ে থাকে। তবে হরিনের অবাধ বিচরণের জন্য এই স্থানটিকে হিরণ পয়েন্ট হিসেবে নামকরণ করা হয়। জাহাজ থেকে নেমে উঠতে হবে ট্রলারে। কারণ আমরা নদীর কোল ঘেষে হিরণ পয়েন্টের নৈসর্গিক সব দৃশ্য উপভোগ করব। কোলঘেঁষে নদীর গভীরতা কম থাকায় সেখানে জাহাজ প্রবেশ করতে পারে না। তাই আমরা সবাই লাইফ জ্যাকেট পরা অবস্থায় ট্রলার নিয়ে হিরণ পয়েন্টের উদ্দেশে যাত্রা শুরু করেছি। চারিদিক জুড়ে অথৈ জল আপনার মনকে ছোট ছোট ঢেউয়ের সাথে দুলিয়ে দেবে অনায়াসে। বিস্তৃত জলরাশির ওপারেই অপেক্ষা করছে হিরণ পয়েন্টের মূল বনজ সৌন্দর্য্য। এবারে ট্রলার থেকে নামার পালা। আমরা পৌঁছে গেছি হিরণ পয়েন্টের মূল অংশের প্রবেশদ্বারে। বাংলাদেশ বন বিভাগের এই ঘাট থেকেই হিরণ পয়েন্টের মূল ভূখণ্ডের উদ্দেশে যাত্রা শুরু হবে। এখানে চেষ্টা করবেন সর্বোচ্চ সাবধানতা অবলম্বন করার। কারণ যে কোনো সময়ই হয়তো সম্মুখীন হতে পারেন রয়েল বেঙ্গল টাইগারের সামনে পড়ার অভিজ্ঞতার। মূলত এই অঞ্চলটি রয়েল বেঙ্গল টাইগারের উন্মুক্ত অভয়ারণ্য। চলছি বাংলাদেশ বন বিভাগের অফিসের সামনে, বিশ্ব ঐতিহ্যের ফলক ১৯৯৭ সালে বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় প্রধানমন্ত্রী এটি উদ্বোধন করেন। এখানে রয়েছে টেলিটক মোবাইল টাওয়ার। ফলে সর্বোচ্চ নেটওয়ার্ক সুবিধা পেতে সঙ্গে রাখতে পারেন টেলিটক সিম। হিরণ পয়েন্টের মিঠা পানির পুকুর পাড়ে। কথায় বলে ‘বাঘে মহিষে এক ঘাটে জল খায়’। তবে কথার এই কথাকে সত্য রুপ দিয়ে সত্যিই এখানে বাঘ-মহিষসহ সব জীবজন্তু এই পুকুরে আসে পানি পান করতে। উল্লেখ্য, এই পুকুরের পানি বিশুদ্ধ হওয়ায় স্থানীয় এবং দর্শনার্থীরাও প্রয়োজনে পান করে থাকেন। দুই পাশে গরান গাছের ঘন জঙ্গল। সময় স্বল্পতার কারণে পুকুরের চার পাশ হেঁটে আমাদের আবার আবার ট্রলারে উঠতে হলো। হিরণ পয়েন্টের এই অঞ্চলটিতে সর্বাধিক বাঘের আধিক্য লক্ষ্য করা যায়। তবে দিনের বেলা এবং জনসমাগমে বাঘের উপস্থিতি একেবারেই চোখে পড়বে না। ঘন এই জঙ্গলের মধ্যে একটু পর পরই এমন ছোট ছোট খাল এবং নালা ছড়িয়ে রয়েছে শিরা উপশিরার মতো। যেখানে লক্ষ্য করা যায় শ্বাসমূল। হিরণ পয়েন্ট একটি অভয়ারণ্য হওয়ায় এই স্থান প্রচুর বাঘ, হরিণ, বানর, পাখি এবং সরিসৃপের নিরাপদ আবাসস্থল। সুন্দরবন এলাকায় রয়েল বেঙ্গল টাইগার দেখার অন্যতম একটি স্থান হলো এই হিরণ পয়েন্ট। এখানে দেখা পাওয়া যায় চিত্রা হরিণ, বন্য শুকর। পাখিদের মধ্যে আছে সাদা বুক মাছরাঙা, হলুদ বুক মাছরাঙা, কালো মাথা মাছরাঙা, লার্জ এগ্রেট, কাঁদা খোঁচা, ধ্যানী বক ইত্যাদি।

এছাড়া এখানে রয়েছে প্রচুর কাঁকড়া এবং রং-বেরঙের প্রজাপতি। বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে স্বীকৃতিপ্রাপ্ত এই হিরণ পয়েন্ট থেকেই ১৯৯৫ খ্রিষ্টাব্দের ২৪ অক্টোবর ১৯শ শতাব্দের সর্বশেষ পূর্ণগ্রাস সূর্যগ্রহণ দেখা গিয়েছিল। যেই সূর্য গ্রহণটি স্থায়ী হয়েছিল ২ মিনিট ১০ সেকেন্ড। হিরণ পয়েন্টের মূল ভূখণ্ড থেকে এবার বের হওয়ার পালা। বিস্তৃত জলরাশির নৈসর্গিক সৌন্দর্য উপভোগ করতে করতে হিরণ পয়েন্টের যাত্রা সমাপ্তির সময় দূর থেকে বহুদূরে চোখ জুড়ানো নয়নাভিরাম সব দৃশ্যে আপনার মনে হবে আপনি কোনো স্বপ্নের পথ দিয়ে অতিক্রম করছেন। ছোট ছোট ঢেউ আর বিস্তৃত জলরাশির মধ্যে সূর্যের আলোক রশ্মির অনন্য ভিন্ন ধরনের মিতালি আপনার দৃষ্টিতে সৌন্দর্যের এক ভিন্নরকম মাত্রা যোগ করবে।

লেখক : জাতীয় সংসদ বিরোধীদলীয় নেত্রীর সহকারী একান্ত সচিব!

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত