ভূমিকম্পের মতো অপ্রত্যাশিত দুর্যোগে কিডনিসহ অন্যান্য রোগীরা অধিক ঝুঁকিতে থাকেন। এই অবস্থায় এ ধরনের দুর্যোগ মোকাবিলায় ইমার্জেন্সি রেসপন্স এবং অসুস্থ রোগীদের চিকিৎসাসেবা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে প্রস্তুতি নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন চিকিৎসক, প্রকৌশলী ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা সংশ্লিষ্টরা। গতকাল শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে কিডনি এওয়ারনেস মনিটরিং অ্যান্ড প্রিভেনশন সোসাইটির (ক্যাম্পস) আয়োজিত ‘অপ্রকাশিত দুর্যোগে ঝুঁকিপূর্ণদের সহায়তায় করণীয়’ শীর্ষক গোলটেবিল বৈঠকে আলোচকরা এসব কথা বলেন। বক্তারা বলেন, ভূমিকম্প হলে অনাকাঙ্ক্ষিতভাবে অনেক মানুষ আহত হয় আর তাদের স্থান হবে হাসপাতালে।
আবার অনেকে গৃহহারা হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এসব মানুষের আশ্রয়স্থল হবে স্কুল-কলেজের মতো বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান। তাই সবার আগে এসব প্রতিষ্ঠানগুলোর ভূমিকম্প সহনীয়তা নিশ্চিত করতে হবে, যেন ইমার্জেন্সি রেসপন্স নিশ্চিত করা যায়। যে কোনো দুর্ঘটনায় চিকিৎসকদের একটা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রয়েছে। ইমার্জেন্সি রেসপন্সে তাদের ভূমিকা সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। তাই হাসপাতালকে পরিকল্পনা অনুযায়ী প্রস্তুত করতে হবে। হাসপাতালগুলো চালু রাখার ব্যবস্থা না করলে দুর্ঘটনায় রোগীদের জীবন বাঁচানো যাবে না বলেও জানান আলোচকরা। গোলটেবিল বৈঠকে মূল প্রবন্ধ উপস্থাপন করেন ক্যাম্পসের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি অধ্যাপক ডা. এমএ সামাদ। তিনি তার মূল প্রবন্ধে বলেন, কিডনি রোগী দুর্যোগের সময়ে সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। কিডনি রোগের প্রাদুর্ভাব ব্যাপক। সারাবিশ্বে ৮৫ কোটি লোক কিডনি রোগে আক্রান্ত। বাংলাদেশে দুই কোটিরও অধিক কিডনি রোগী রয়েছে।
প্রতি বছর দেশে ৩৫ থেকে ৪০ হাজার লোক কিডনি সম্পূর্ণ বিকলের শিকার হয়। আরও ১৫ থেকে ২০ হাজার আকস্মিক কিডনি বিকল হয়। এদের বেঁচে থাকার জন্য ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজন প্রয়োজন হয়। কিডনি বিকলের চিকিৎসা অত্যন্ত ব্যয়বহুল বিধায় শতকরা ১০ জনের ব্যয় সংকুলান করতে পারে। চিকিৎসা করতে গিয়ে অনেক পরিবার আর্থিকভাবে নিঃস্ব হয়ে যায়। সবার জন্য কিডনি স্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজন বিমার আওতায় আনতে হবে। দুর্যোগের সময় কিডনি রোগীদের বিড়ম্বনার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমরা জানি কিডনি সম্পূর্ণ বিকল হয়ে গেলে বেঁচে থাকার জন্য প্রয়োজন ডায়ালাইসিস ও কিডনি সংযোজন। ডায়ালাইসিস সাধারণত সপ্তাহে ২-৩ দিন করতে হয়। দুর্যোগের কারণে ডায়ালাইসিস বন্ধ হলে মৃত্যু এগিয়ে আসবে। কিডনি সংযোজনের রোগীদের নিয়মিত ওষুধ খেতে হবে, ওষুধ নিয়মিত না খেলে সংযোজিত কিডনি বাতিল হয়ে যেতে পারে। আবার দুর্যোগের সময়ে আঘাত, রক্তক্ষরণ, দুর্যোগ পরবর্তী ডায়রিয়া ইনফেকশন এসব কারণে তীব্র মাত্রার আকস্মিক কিডনি বিকল হতে পারে। যার জন্য ডায়ালাইসিস প্রয়োজন। অল্প মাত্রার দীর্ঘস্থায়ী কিডনি রোগ প্রয়োজনীয় চিকিৎসার অভাবে সম্পূর্ণ কিডনি বিকল হয়ে যেতে পারে। তখন ডায়ালাইসিস এর প্রয়োজন হবে। তাই কিডনি রোগী দুর্যোগের সময় সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে থাকে। এই কিডনি বিশেষজ্ঞ বলেন, দুর্যোগের মোকাবেলায় কিডনি রোগীদের নিজ পূর্ব প্রস্তুতি অত্যন্ত জরুরি যেমন প্রয়োজনীয় ওষুধসহ জরুরি ‘কীটবক্স’ প্রস্তুত রাখা, বিকল্প ডায়ালাইসিস সেন্টার সম্পর্কে আগে থেকে ধারণা নিয়ে রাখা, সাহায্যকারী নেটওয়ার্ক তৈরি করে রাখা, যেমন-বন্ধু, আত্মীয় প্রতিবেশীদের সহায়তা। ডায়ালাইসিস পেতে বিলম্ব হলে সাময়িক খাদ্যাভ্যাস পরিবর্তন, যেমন-পানি কম, মাছ- মাংস কম, পটাশিয়াম যুক্ত খাবার যেমন-ফল ও সবজি পরিহার।
বিশেষ অতিথির বক্তব্যে কিডনি ফাউন্ডেশনের সভাপতি অধ্যাপক ডা. হারুন-উর রশিদ বলেন, দুই থেকে আড়াই কোটি রোগী ধীরে ধীরে কিডনি রোগে আক্রান্ত হয়। শতকরা ৮০ ভাগ ক্রনিক ডিজিজের কোনো লক্ষণ থাকে না। ৫০ ভাগ মানুষ জানেই না, তারা সুপ্ত কিডনি রোগে ভুগছে। ২৫ ভাগকে চিকিৎসা দেয়ার সক্ষমতা আমাদের আছে, বাকি ৭৫ ভাগের নির্মম ভাগ্য বরণ করার সম্ভাবনা আছে। কিন্তু সতর্ক থাকলে ৫০-৬০ শতাংশ আকস্মিক কিডনি বিকল রোধ করা সম্ভব।
অধ্যাপক ডা. হারিসুল হক বলেন, অনাকাঙ্ক্ষিত স্বাস্থ্য বিপর্যয় থেকে রক্ষা পেতে নীতি-নির্ধারকদের নতুন করে ভাবতে হবে। অসংক্রামক ব্যাধিসমূহ প্রতিরোধ করার পাশাপাশি নতুন রোগ শনাক্তকরণ এবং কিডনি রোগসহ হৃদরোগ, ডায়াবেটিস, ক্যান্সার ইত্যাদি রোগের সুচিকিৎসা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে স্বাস্থ্যসেবায় নিয়োজিত সবাইকে নিয়ে সমন্বিত কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। সরকারের উচিত হবে আপৎকালীন সময়ে এসব রোগীকে চিকিৎসা পৌঁছে দেয়ার প্ল্যান প্রণয়ন এবং রোগীদের উচিত হবে তাদের হাতের কাছে সর্বদা একটা কিট সংরক্ষণ করা যাতে প্রয়োজনীয় ওষুধপত্রের পাশাপাশি খাবারও রাখা যায়। ক্যাম্পাসের নির্বাহী পরিচালক রেজওয়ান সালেহীন বলেন, ক্যাম্পাস কিডনি রোগ প্রতিরোধের জন্য নিয়মিত সচেতনতার বাণী প্রচার করে যাচ্ছে।
আমরা যদি কিছু নিয়ম কানুন মেনে চলি তা হলে কিডনি রোগ প্রতিরোধ করা সম্ভব। তাই সরকারি ও বেসরকারি পর্যায় থেকে যদি সবাই এগিয়ে আসেন তাহলে এই রোগ নিরাময় করা অনেকটাই সহজ হবে। এছাড়াও গোলটেবিল বৈঠকে দেশের সরকারি পর্যায়ের নীতিনির্ধারক, চিকিৎসক, সাংবাদিক, শিল্পী, শিক্ষাবিদ, ক্রীড়াবিদসহ বরেণ্য ব্যক্তিরা বক্তব্য প্রদান করেন। বক্তারা অভিমত ব্যাক্ত করেন যে, চিকিৎসা করে নয় বরং প্রতিরোধ করেই এ রোগের প্রাদুর্ভাব প্রশমন করতে হবে আর এ জন্য সচেতনতাই একমাত্র উপায়। কিডনি রোগ প্রতিরোধে গণসচেতনতা বৃদ্ধি করতে ক্যাম্পাসের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকার প্রশংসা করেন এবং বিত্তবানদের এমন মহৎ কাজে সহযোগিতার আহ্বান জানান। একইসঙ্গে ভূমিকম্পের মতো দুর্যোগ মোকাবিলা ও আপৎকালীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিতে নানা পরামর্শ তুলে ধরেন।