গবেষণা প্রতিবেদন

স্কুলে ভর্তির আগেই স্মার্টফোনে আসক্ত দেশের ৮৬ ভাগ শিশু

প্রকাশ : ২০ এপ্রিল ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

বাংলাদেশের ৮৬ শতাংশ প্রি-স্কুল শিশু স্মার্টফোনে আসক্ত। এর মধ্যে ২৯ শতাংশ শিশুর মারাত্মকভাবে স্মার্টফোনের আসক্তি রয়েছে। কিন্তু প্রতি ১০ জন মায়ের মধ্যে ৪ জনই সন্তানের স্মার্টফোনের আসক্তি সম্পর্কে জানেন না। সম্প্রতি তিন থেকে পাঁচ বছরের ৪০০ প্রি-স্কুল শিশুর ওপর পরিচালিত এক গবেষণায় এমন তথ্য উঠে এসেছে। গবেষণার মূল প্রবন্ধটি ‘এলসভিয়ারের জার্নাল অব ইফেক্টিভ ডিসঅর্ডার’ নামে জার্নালের ৩২৯ নম্বর সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিসংখ্যান বিভাগের অধ্যাপক ড. মোহাম্মাদ নাজমুল হক, সহযোগী অধ্যাপক মো. মোয়াজ্জেম হোসেন এবং আরটিএম আল-কবির টেকনিক্যাল ইউনিভার্সিটির প্রভাষক ফারুক আব্দুল্লাহ্-এর নেতৃত্বে একটি গবেষক দল গবেষণা কর্মটি পরিচালনা করেছে।

গবেষণায় দেখা গেছে, বাংলাদেশের প্রায় ৮৬ শতাংশ প্রি-স্কুল শিশু স্মার্টফোনে আসক্ত, যার মধ্যে ২৯ শতাংশের মারাত্মকভাবে স্মার্টফোনের আসক্তি রয়েছে। কিন্তু প্রতি ১০ জন মায়ের মধ্যে ৪ জনই স্মার্টফোনের আসক্তি সম্পর্কে অবগত নন। বাবা-মা সন্তানের সময় কম দেয়ার কারণে ৮৫ শতাংশ শিশু স্মার্টফোন আসক্তিতে ভুগছে। এছাড়াও খেলার মাঠের অভাবে ৫২ শতাংশ ও খেলার সাথীর অভাবে ৪২ শতাংশ শিশু স্মার্টফোনের দিকে আসক্ত হচ্ছে। ৭৯ শতাংশ প্রি-স্কুল শিশু কার্টুন বা কল্পকাহিনী দেখার জন্য, ৪৯ শতাংশ গেম খেলার জন্য, ৪৫ শতাংশ শিশু টেলিভিশন/ভিডিও দেখা বা গান শোনার জন্য স্মার্টফোন ব্যবহার করে। অন্যদিকে, শুধু ১৪ শতাংশ শিশু অধ্যয়নের উদ্দেশ্যে স্মার্টফোন ব্যবহার করে। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, নির্বাচিত ৪০০ শিশুর প্রত্যেকে স্মার্টফোন ব্যবহার করে, যাদের মধ্যে ৯২ শতাংশ তাদের বাবা-মায়ের স্মার্টফোন ব্যবহার করে এবং ৮ শতাংশ শিশুর ব্যবহারের জন্য পৃথক স্মার্টফোন আছে।

এক জরিপে দেখা যায়, বাংলাদেশের শিশুরা প্রতিদিন গড়ে প্রায় ৩ ঘণ্টা স্মার্টফোন ব্যবহার করে, যা বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা (ডব্লিউএইচও) কর্তৃক সুপারিশকৃত সর্বোচ্চ সময়ের প্রায় ৩ গুণ। অভিভাবকরা কেন সন্তানদের স্মার্টফোন ব্যবহার করতে দেন, এই প্রশ্নের জবাবে, ৭৩ শতাংশ মা বলেছেন, তারা তাদের বাচ্চাদের স্মার্টফোনের সাথে ব্যস্ত রাখতে চান, যাতে তারা তাদের কাজ বিনা বাধায় করতে পারেন। ৭০ শতাংশ মা তাদের বাচ্চাদের স্মার্টফোন দেন কারণ তাদের বাচ্চারা স্মার্টফোন ব্যবহার করতে পছন্দ করে। ৬৭ শতাংশ মা তাদের সন্তানকে খাওয়ানোর জন্য এবং ৩১ শতাংশ মা শিশুকে ঘুম পারানোর জন্য স্মার্টফোন ব্যবহার করেন। গবেষণায় আরও দেখা গেছে, মা-বাবার প্রতিদিনের স্মার্টফোনের ব্যবহারের মাত্রা তাদের সন্তানের স্মার্টফোন আসক্তির কারণ।

কেননা যেসব মা ও বাবা প্রতিদিন ৩ ঘণ্টা বা তার বেশি সময় স্মার্টফোন ব্যবহার করেন তাদের সন্তানরা স্মার্টফোনে আসক্ত হওয়ার সম্ভাবনা প্রায় ৯০ গুণেরও বেশি। পেশাজীবী মায়ের বাচ্চারা অধিকহারে স্মার্টফোন আসক্তিতে ভুগছে, কেননা তারা তাদের সন্তানদের প্রয়োজন অনুসারে সময় দিতে পারছেন না। পারিবারিক এবং সামাজিক অবস্থান ও প্রি-স্কুল শিশুদের স্মার্টফোন আসক্তির কারণ। অধিক আয়ের পরিবারের (মাসিক ২৫০০০ টাকা বা তার বেশি) বাচ্চারা অধিক হারে স্মার্টফোনে আসক্ত।

এক অনুসন্ধানে দেখা গেছে, স্মার্টফোন আসক্তিতে বাচ্চাদের ঘন ঘন মেজাজ পরিবর্তন, কারণ ছাড়াই রেগে যাওয়া, অপর্যাপ্ত এবং অনিয়মিত ঘুম, অমনোযোগিতা, ভুলে যাওয়া, ভাষার দক্ষতা বিকাশ না হওয়া এবং ভাইবোন, বাবা-মা ও খেলার সাথীদের সাথে বিচ্ছিন্নতাসহ বিভিন্ন মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যা হয়।

একই সাথে এই গবেষণায় অনেক রকম শারীরিক সমস্যার কথা উঠে এসেছে। যেমন স্মার্টফোনে আসক্ত বাচ্চারা সচরাচর মাথাব্যথা, হাত ও পিঠে ব্যথা, ক্ষুধা হ্রাস, অনিয়মিত খাবারের সময়, ওজন এবং উচ্চতার অসামঞ্জস্যপূর্ণ এবং শ্রবণ ও দৃষ্টি শক্তির সমস্যায় ভুগছে।

স্মার্টফোনে আসক্ত শিশুরা স্মার্টফোনে আসক্ত নয় এমন বাচ্চাদের তুলনায় মারাত্মক হারে মানসিক স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকিতে আছে। একই সাথে স্মার্টফোনে আসক্ত বাচ্চাদের শারীরিক স্বাস্থ্য সমস্যার ঝুঁকিও কম নয়, যা স্মার্টফোনে আসক্ত নয় এমন বাচ্চাদের তুলনায় ২৩০ গুণ বেশি। কিন্তু প্রতি ১০ জনে ৫ জন মা-ই বিশ্বাস করেন যে, তাদের সন্তান স্মার্টফোন ব্যবহার করে অনেক কিছুই শিখতে পারে। গবেষকদল মনে করে, বাবা-মায়েদের উচিত তাদের প্রি-স্কুল সন্তানদের প্রস্তাবিত সময়ের বেশি স্মার্টফোন ব্যবহার করতে না দেয়া, তাদের সাথে পর্যাপ্ত সময় ব্যয় করা এবং তাদের খেলার পরিবেশ ও খেলার সাথী নিশ্চিত করা; যা ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে স্মার্টফোনের আসক্তির বিরূপ প্রভাব থেকে রক্ষা করতে সহায়ক ভূমিকা পালন করবে।

এছাড়াও সংশ্লিষ্ট সরকারি প্রতিষ্ঠান অতিমাত্রায় স্মার্টফোন আসক্তির বিরূপ প্রভাব সম্পর্কে সন্তানদের বাবা-মায়েদের সতর্ক করতে পারে। এ বিষয়ে একটি জাতীয় পর্যায়ের গবেষণা হওয়া প্রয়োজন এবং তার ফলাফলের ওপর ভিত্তি করে প্রি-স্কুল বাচ্চাদের স্মার্টফোন ব্যবহারের জন্য একটি নির্দেশানাবলী তৈরি করে সেই অনুযায়ী কমিউনিটি পর্যায়ে সচেতনতামূলক প্রোগ্রাম করা প্রয়োজন। অন্যথায় আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে মানসিক এবং শারীরিকভাবে সুস্থ ও সৃজনশীল রাখা অসম্ভব হয়ে পড়বে।