দেশের প্রায় ৫ কোটি মানুষ বিভিন্ন থাইরয়েড সমস্যায় ভুগছে বলে জানিয়েছে অ্যাসোসিয়েশন অব ক্লিনিক্যাল এন্ড্রোক্রাইনোলজি অ্যান্ড ডায়াবেটোলজিস্ট অব বাংলাদেশ (এসিইডিবি)। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, তাদের মধ্যে বেশিরভাগ রোগীই জানেন না যে, তারা থাইরয়েড জটিলতায় আক্রান্ত। তবে এ সমস্যায় পুরুষের তুলনায় নারীরা চার থেকে পাঁচ গুন বেশি আক্রান্ত হন। গতকাল বুধবার রাজধানীর মোতালেব টাওয়ারে বিশ্ব থাইরয়েড দিবস ২০২৩ উপলক্ষ্যে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে এসব তথ্য জানানো হয়। এতে জানানো হয়, থাইরয়েড গ্রন্থিটি গলার সামনের দিকের উঁচু হাড়ের নিচে অবস্থিত। এটি দেখতে প্রজাপতির মতো, ট্রাকিয়া বা শ্বাসনালিকে পেঁচিয়ে থাকে। এটি ছোট গ্রন্থি হলেও এর কার্যকারিতা ব্যাপক। থাইরয়েড গ্রন্থি থেকে নিঃসৃত হরমোন মানব পরিপাক প্রক্রিয়ায় অন্যতম ভূমিকা পালন করে। ভ্রƒণ অবস্থা থেকে আমৃত্যু থাইরয়েড হরমোনের প্রয়োজন অপরিহার্য। থাইরয়েডের তারতম্যের প্রভাব তুলে ধরে বলা হয়, এই হরমোনের তারতম্যের জন্য শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধি, শরীর মোটা হওয়া, ক্ষয় হওয়া, মাসিকের বিভিন্ন সমস্যা, ত্বকের বিভিন্ন সমস্যা, হার্টের সমস্যা ও চোখ ভয়ঙ্করভাবে বড় হয়ে যেতে পারে। বন্ধ্যাত্বের অন্যতম কারণও থাইরয়েডের তারতম্য। শারীরিক কার্যক্ষমতা ঠিক রাখতে নির্দিষ্ট মাত্রায় এই হরমোন শরীরে থাকা জরুরি। নবজাতকের সুস্থতার সাথে থাইরয়েডের সম্পর্ক তুলে ধরে বলা হয়, সুস্থ নবজাতকের জন্য সুস্থ মা প্রয়োজন। মায়ের থাইরয়েড হরমোনের সমস্যা থাকলে এর প্রভাব নবজাতকের ওপর পড়ে। নবজাতকের থাইরয়েড হরমোনের অভাব শিশুর স্বাভাবিক শারীরিক ও মানসিক বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটায়। ফলে শিশু প্রতিবন্ধীতে পরিণত হতে পারে। শিশুকে এই প্রতিবন্ধিতার হাত থেকে রক্ষায় প্রতিটি নবজাতকের জন্মের সাথে সাথে থাইরয়েড হরমোন পরীক্ষা করা প্রয়োজন।
আয়োডিনের ঘাটতির বিষয়ে আলোচকরা বলেন, হরমোন নরমাল থাকলেও থাইরয়েড গ্রন্থি ফুলে যেতে পারে। সাধারণত আয়োডিনের অভাবে গলাফুলা রোগ হয়ে থাকে, যাকে আমাদের সাধারণ ভাষায় ‘ঘ্যাগ’ রোগ বলা হয়। যদিও আমাদের দেশে আয়োডিন যুক্ত লবণ খাওয়া হচ্ছে, কিন্তু বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) ডায়াবেটিস ও হরমোন বিভাগের উদ্যোগে পরিচালিত সাম্প্রতিক গবেষণায় দেখা গেছে, দেশের বেশিরভাগ স্কুলগামী শিশু এবং গর্ভবতী মায়েদের আয়োডিনের অভাব রয়ে গেছে। এই আয়োডিন শরীরে অতি প্রয়োজনীয় থাইরয়েড হরমোন তৈরিতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। থাইরয়েড হরমোন স্বাভাবিকভাবে তৈরিতে সুষম খাদ্যে পর্যাপ্ত পরিমাণ সেলেনিয়াম এবং আয়রন প্রয়োজন বলে জানিয়েছেন এন্ড্রোক্রাইনোলজি বিশেষজ্ঞরা। আলোচনায় অংশ নিয়ে থাইরয়েড বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক ডা. মীর মোশাররফ হোসেন বলেন, থাইরয়েডের বিষয়ে সচেতনতা জরুরি। অজ্ঞতার কারণে থাইরয়েডের বিষয়ে স্বচ্ছ ধারণা না থাকায় অনেকে দেরিতে চিকিৎসা নিচ্ছেন। আবার অনেকে নানান জনের পরামর্শে ওষুধ খান। এতে অনেক সময় ভুল ওষুধ খাচ্ছেন। ফলে তার রোগের জটিলতা বাড়ছে। থাইরয়েডে পার্থক্য রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, হাইপো থাইরয়েড হলে, অল্প খাবার খেয়েও মানুষের ওজন বেড়ে যাবে, শরীর দুর্বল লাগবে। এসব রোগীর কোষ্ঠকাঠিন্য দেখা দেয়। নারীদের ক্ষেত্রে অনিয়ন্ত্রিত মাসিকের সমস্যা হয়। অন্যদিকে হাইপার থাইরয়েডের ক্ষেত্রে তার বিপরীত লক্ষণ দেখা যায়। ফলে এর চিকিৎসাও ভিন্ন হবে। অধ্যাপক ডা. ইন্দ্রজিৎ প্রসাদ বলেন, বন্ধ্যাত্বের অন্যতম কারণ থাইরয়েড সমস্যা। তাই গর্ভধারণে সমস্যার ক্ষেত্রে গাইনি বিশেষজ্ঞের পরামর্শের পাশাপাশি থাইরয়েডের চিকিৎসকের পরামর্শ নেয়া উচিত। অন্যথায় নবজাতকের মানসিক ও শারীরিক বৃদ্ধিতে ব্যাঘাত ঘটতে পারে। শিশু হাবাগোবা হিসেবে বেড়ে উঠতে পারে। এই অবস্থা থেকে উত্তরণে গর্ভবতী অবস্থায় ও প্রসবের আগে থাইরয়েড পরীক্ষা জরুরি। এছাড়া নবজাতকের জন্মের সাত দিনের মধ্যে স্ক্রিনিং ও পরীক্ষা করা পরামর্শ দিয়েছেন প্রখ্যাত এই থাইরয়েড বিশেষজ্ঞ। সংবাদ সম্মেলনে দেশে থাইরয়েড চিকিৎসার তথ্য তুলে ধরে জানানো হয়, সরকার পুরোনো আটটি মেডিক্যাল কলেজের সাথে নতুন করে আরো ছয়টি মেডিক্যাল কলেজে এন্ড্রোক্রাইনোলজি বিভাগ খোলার মাধ্যমে হরমোনজনিত রোগের চিকিৎসার জন্য জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করেছেন। বর্তমানে সরকারি পর্যায়ে প্রায় ১০০ হরমোন বিশেষজ্ঞ কাজ করে যাচ্ছেন। আর বেসরকারি পর্যায়ে ২০০ জন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কাজ করছেন। এই বিশেষজ্ঞদের পদায়নের মাধ্যমে এনসিডির লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সহায়ক শক্তি হিসেবে কাজে লাগানো সম্ভব। এনসিডির মাধ্যমে থাইরয়েড হরমোনের রোগের ব্যাপারে জনসচেতনতা বৃদ্ধি করা যেতে পারে বলে অভিমত জানিয়েছে এসিইডিবির সদস্য থাইরয়েডের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসারা।