ঢাকা ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৭ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

পঞ্চগড়ের সমতলে গোচারণ ভূমি

চা শিল্পে ঘটেছে বিপ্লব দাম নিয়ে হতাশ চাষি

চা শিল্পে ঘটেছে বিপ্লব দাম নিয়ে হতাশ চাষি

উত্তরের জেলা পঞ্চগড়ের সমতলের গো চারণ ভূমিতে ঘটেছে চা শিল্পের নীরব বিপ্লব। দুই দশকের বেশি সময় ধরে চা শিল্পের এমন প্রসারে এ অঞ্চলে চা উৎপাদনের রেকর্ড ঘটেছে। দেশের তৃতীয় বৃহত্তম চা উৎপাদনকারী অঞ্চল হিসেবেও স্থান করে নিয়েছে পঞ্চগড়। উৎপাদনের রেকর্ড গড়লেও চায়ের দাম নিয়ে হতাশা বিরাজ করছে চা চাষিদের মধ্যে। কেননা তারা তাদের চা পাতার সঠিক দাম পাচ্ছেন না।

চা চাষিদের অভিযোগ, চা বাগান ঘিরে কারখানা বাড়লেও বাড়ছে না চা পাতার দাম। চা শিল্প ঘিরে তৈরি হয়েছে এক ধরণের সিন্ডিকেট। কয়েক বছর ধরেই চা চাষিরা পাচ্ছেন না তাদের উৎপাদিত কাঁচা চা পাতার ন্যায্য মূল্য। চলতি মৌসুমে চা পাতা কারখানাগুলো যে দামে চা কিনছে, তাতে করে তাদের উৎপাদন খরচও উঠছে না। বছরের শুরুতেই টানতে হচ্ছে লোকসানের ঘানি।

চা চাষিরা জানান, সরকারিভাবে ১৮ টাকা দরে দাম নির্ধারণ করা হলেও সে দামে পাতা কিনছেন না কারখানাগুলো। তারা কৃষকদের জিম্মি করে পাতা কিনছে ১৩-১৫ টাকা দরে। তার মধ্যে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে পাতা কেটে নিচ্ছে ৪০-৫০% পর্যন্ত। প্রতি কেজি চা পাতা উৎপাদনে খরচ হয় ১৫ থেকে ১৬ টাকা। তার মধ্যে অর্ধেক পাতা কেটে নেয়ার পর অর্ধেক বিক্রি করে আসছে না উৎপাদন খরচও। দিনের পর দিন কিছু অসাধু ব্যক্তিদের সিন্ডিকেটের কবলে পড়ে লোকসান গুনছেন সমতলের ৭ হাজারের বেশি চা চাষি। যারা ঋণ করে চা বাগানে বিনিয়োগ করেছিলেন তারা লোকসান গুনতে গুনতে নিঃস্ব হয়ে যাচ্ছেন। কেউ কেউ ক্ষোভে তাদের স্বপ্নের বাগান কেটে ফেলছেন।

তেঁতুলিয়া উপজেলার চিমনজোত এলাকার ক্ষুদ্র চা চাষি কাজিমদ্দিন ও সাঈদসহ কয়েকজন চা চাষি চা বাগান কেটে ফেলেছেন। এমন সিদ্ধান্ত তারা কেন নিলেন এটা জানতে চাইলে কাজিমদ্দিন বলেন, এক বিঘা জমিতে চা আবাদ করেছিলাম। কিন্তু কয়েক বছর ধরে লোকসান গুনতে গুনতে আর পারছি না। চা পাতার দাম নেই। তাই চা বাগান কেটে ভিন্ন আবাদের কথা ভাবছি। একই কথা বললেন, আরেক চা চাষি সাঈদও। তিনি জানান, সরকারিভাবে চা পাতার দাম ১৮ টাকা নির্ধারণ করা হলেও কারখানাগুলো ১৩-১৫ টাকা কেজি দরে পাতা কিনছেন। তার মধ্যে বিভিন্ন অজুহাত দেখিয়ে সেখান থেকে ৩০-৫০% পর্যন্ত পাতা কেটে নিচ্ছেন। ১০০ কেজি পাতা কারখানা নিলে ৫০ কেজি কেটে নিচ্ছে। বাকি ৫০ কেজির দামও পাচ্ছি কম। ঘর থেকে আর কতো লোকসান গুনবো। সার-কীটনাশক, শ্রমিক খরচও উঠছে না। তাই চা আবাদ বাদ দেয়া ছাড়া কোন উপায় দেখছি না। এরকম অভিযোগ চা চাষি ইউসুফ আলী, সোহাগ হোসেন, বাদশা, সিদ্দিক ও বাসেদসহ জেলার বিভিন্ন উপজেলার চাষিদের। তারা বিভিন্ন সময় ধরে রাজপথে চা পাতার দাম পেতে আন্দোলন করে আসছেন।

চা বোর্ডের পঞ্চগড় আঞ্চলিক কার্যালয় সূত্রে জানা যায়, ২০০০ সালে পঞ্চগড়ে বাণিজ্যিকভাবে চা শিল্পের বিপ্লব ঘটে। গত দুই দশকে বদলে যায় তার চিত্রপট। এক সময়ের পতিত গোচারণ ভূমি হয়ে উঠে সবুজ চা বাগান। সবুজ পাতায় জেগে উঠে নতুন অর্থনীতি। চা উৎপাদনে সিলেটের পর দ্বিতীয় অঞ্চল হয়ে উঠেছে এ জেলা। প্রায় ১০ হাজার একর জমিতে গড়ে উঠেছে ছোট-বড় প্রায় সাড়ে সাত হাজার চা-বাগান। গত বছর এক কোটি ৫২ লাখ কেজি তৈরি চা উৎপাদিত হয়েছে শুধু পঞ্চগড়ে। জেলার লক্ষাধিক মানুষ জড়িয়ে পড়েছেন চা শিল্পে। বেকারদের একটি বড় অংশ চাকরির আশা ছেড়ে দিয়ে চা চাষে বিনিয়োগ করেছেন। বর্তমানে জেলায় ২৩টি চা প্রক্রিয়াজাত কারখানা চালু রয়েছে।

তবে কারখানার মালিকরা বলছেন ভিন্ন কথা। তারা বলছেন চা বাগান থাকলে চা ফ্যাক্টরি চলবে। তাই সিন্ডিকেটের প্রশ্নই আসেনা। তেঁতুলিয়ার বিসমিল্লাহ টি ফ্যাক্টরি লিমিটেডের পরিচালক সাইদুর রহমান মিয়া বলেন, চাষিরা যে সিন্ডিকেটের কথা বলছেন তা ঠিক নয়। মূলত তারা কারখানায় ভাল মানের পাতা দিতে পারছেন না। আর এবারের প্রকৃতি অনুকুল না থাকায় খরার কারণে অনেক কৃষকের চা পাতা নষ্ট হয়ে গেছে। যার কারণে ভালো পাতা পাচ্ছি না। দুটি পাতা একটি কুড়ি অর্থাৎ তিন পাতা থেকে সাড়ে চার পাতা পর্যন্ত আমরা ১৮ টাকার মধ্যে নিতে পারি। কিন্তু চাষিরা বাগান থেকে কাঁচি দিয়ে কেটে ৭-৮ পাতা পর্যন্ত নিয়ে আসছে। এখানে আমরাও নিরুপায়, ভালপাতা না পেলে ভাল প্রডাকশন কিভাবে করবো, নিলাম বাজারে যদি দাম না পাই তাহলে চাষিদের কিভাবে ভাল দাম দেব। এক্ষেত্রে চাষিরা যদি তাদের বাগানে কাঁচি দিয়ে নয়, মেশিনের সাহায্যে পাতা তুলতে পারেন তাহলে তারা দাম পাবেন। তাই চা বোর্ডকে চা শিল্পকে বাঁচাতে আরও সময়োগযোগী পদক্ষেপ গ্রহণ করার অনুরোধ জানাচ্ছি।

গ্রিন কেয়ার এগ্রো লিমিটেটের চা কারখানার ম্যানেজার মঞ্জুরুল আলম জানান, চট্টগ্রামের অকশন মার্কেটে সিলেটের তৈরিকৃত চায়ের তুলনায় আমাদের চায়ের দাম কম। কারণ তারা যে নিয়ম মেনে বাগান থেকে চা উত্তোলন করে, আমরা সেই নিয়মের ধারে-কাছেও নেই। আমাদের এখানকার ক্ষুদ্র চা চাষিরা হাতের বদলে কাঁচি দিয়ে আট থেকে ১০ পাতা পর্যন্ত ডালসহ কেটে কারখানায় নিয়ে আসেন। অথচ নির্ধারণ করা আছে চার থেকে সাড়ে চার পাতা পর্যন্ত। এ কারণে আমরাও চায়ের মান ঠিক রাখতে পারছি না। যার কারণে আমাদের চায়ের চাহিদা কমে যায়। চাহিদা কমে গেলে দামও কমে যায়। তাই চা চাষিরা ভালো মানের পাতা সরবরাহ করলে আমরা মূল্য নির্ধারণ কমিটির দর অনুযায়ী কাঁচাপাতা কিনব। সেক্ষেত্রে আমরাও ভালো মানের চা উৎপাদন করতে পারবো এবং অকশন মার্কেটে আমাদের চায়ের চাহিদাও বৃদ্ধি পাবে।

আওয়ামী কৃষকলীগের কেন্দ্রীয় সহ-সভাপতি আব্দুল লতিফ তারিন বলেন, এ জেলার মধ্যে তেঁতুলিয়ার বেশির ভাগ মানুষ চা চাষের ওপর নির্ভরশীল। কিন্তু তারা চা পাতার দাম না পেয়ে লোকসান গুনতে গুনতে হতাশ হয়ে উঠেছেন। কারখানা মালিকদের সিন্ডিকেটে পড়ে লোকসান হওয়ায় তাঁরা বাগান ভেঙে ফেলছেন। কারখানা মালিকরা দাম কমার পেছনে বড় পাতাকে দায়ি করছেন। কিন্তু তারা কম দাম ও ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ওজন থেকে বাদ দিয়ে ঠিকই বড় পাতা নিয়েই চা বানাচ্ছেন। এ ছাড়া তাঁরা ভালো মানের চা কাস্টমস কর্মকর্তাদের যোগসাজসে প্রতিদিন কালোবাজারে বিক্রি করছেন। আর নিম্নমানের চা নিলাম বাজারে সরবরাহ করে কম দাম পাওয়ার অভিযোগ তুলছেন। তাই এ বিষয়টি নিয়ে চা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও জেলা প্রশাসকের সাথে কথা বলেছি। একই সাথে উত্তরাঞ্চলের চা শিল্পের স্বপ্ন বুনন করেছিলেন প্রধান মন্ত্রী। এখন এ অঞ্চলের চা শিল্প বাঁচাতে প্রধানমন্ত্রীর হস্তক্ষেপ কামনা করছি।

চা বোর্ড পঞ্চগড় আঞ্চলিক অফিসের উন্নয়ন কর্মকর্তা আমির হোসেন সাংবাদিকদের বলেন বলেন, বর্তমানে সমস্যাটা দুদিকেই। কারখানা মালিকরা নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করে খেয়াল-খুশি মতো দরে চা পাতা কিনছেন। আর চাষিরাও পাতা তোলার সময় নিয়ম মানছেন না। তারা ৭-৮ পাতা পর্যন্ত বাগান থেকে পাতা তুলে কারখানা নিয়ে যাচ্ছেন। বিশেষত আমরা চা শিল্প উন্নয়নে বিগত বছর ধরেই ক্যামেলিয়া নামের খোলা স্কুল খুলে চাষিদের হাতে-কলমে শেখাচ্ছি। আগামী মাসে দেশের তৃতীয় নিলাম কেন্দ্র চালু হচ্ছে এ জেলায়। এরই মধ্যে প্রয়োজনীয় প্রস্তুতিও নেয়া হয়েছে। নিলাম কেন্দ্র চালু হলে চাষিরা উপকৃত হবেন।

জেলা প্রশাসক মো. জহুরুল ইসলাম বলেন, কারখানা মালিকদের বিরুদ্ধে কাঁচা চা পাতার কম দাম ও কর্তন করে দাম দেওয়ার অভিযোগ এসেছে। শিগগিরই চা সংশ্লিষ্ট সবাইকে নিয়ে বসে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেয়া হবে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত