কক্সবাজারের চকরিয়ায় মরহুম বাবার গড়া পাঞ্জাখানা মসজিদ ও অজুখানা ভেঙে ফেলায় ভাইয়ের বিরুদ্ধে অভিযোগ দিয়ে বিচার চেয়েছেন বোন। গত রোববার জেলা প্রশাসকের কাছে লিখিত অভিযোগ দিয়ে এ ব্যাপারে প্রশাসনের সহযোগিতা চেয়েছেন চকরিয়ার ডুলাহাজারার পশ্চিম মাইজপাড়ার মরহুম বশির আহম্মদ চৌধুরীর মেয়ে লুৎফুন্নেছা কহিনুর। আবেদনের অনুলিপি ধর্ম ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়েও পাঠানো হয়েছে। মরহুম বাবার নিদর্শন মসজিদটি রক্ষায় দখল প্রচেষ্টাকারী দুর্বৃত্তদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি করেছেন তিনি। এ তথ্য প্রচারের পর এলাকায় চাঞ্চল্যের পাশাপাশি মিশ্র প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে।
অভিযুক্তরা হলেন মরহুম বশির আহম্মদ চৌধুরীর ছেলে আনোয়ারুল হক চৌধুরী, বাগানবাড়ির কেয়ারটেকার ডুলাহাজারা ইউনিয়নের সীমান্তবর্তী বান্দরবানের লামার ফাঁশিয়াখালী ইউনিয়নের মৃত নূরুচ্ছবির ছেলে ৬নং ওয়ার্ড মেম্বার মোহাম্মদ হেলাল উদ্দিন। তাদের সাথে আরো অজ্ঞাতনামা ১০ থেকে ১২ জন রয়েছে বলে অভিযোগে উল্লেখ করা হয়।
অভিযোগে লুৎফুন্নেছা কহিনুর উল্লেখ করেন, কক্সবাজারের চকরিয়ার ডুলাহাজারার পশ্চিম মাইজপাড়ার বাসিন্দা বশির আহমদ চৌধুরী চকরিয়ার রিংভং মৌজার বিএস ৮৬নং খতিয়ানের ২১ একর ৩০ শতক জমির রেকর্ডীয় মালিক। সেই জমিতে বাগানবাড়ী করে চাষাবাদের পাশাপাশি নানান খামারও গড়ে তুলেন বশির চৌধুরী। তা স্থানীয়ভাবে মালুমঘাট চা-বাগান এলাকার মৌলভীকাটার বাগানবাড়ি হিসেবে পরিচিত। বাগান, খামার ও চাষাবাদে থাকা কর্মচারী, স্থানীয় এলাকার লোকজন ও অন্যজমির চাষিদের নামাজ আদায়ের লক্ষ্যে সেই বাগানবাড়িতে ১৯৭৫ সালে আলী মদন পাঞ্জাখানা মসজিদ প্রতিষ্ঠা করেন। সেখানে ৫ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করতে ইমাম ছিলেন হাফেজ আব্দু শুক্কুর। তিনি যুগ যুগ ধরে সেখানে ৫ ওয়াক্তিয় এবং রোজায় খতমে তারাবিসহ এলাকার মোসল্লিদের নিয়ে নিয়মিত জামাতে নামাজ আদায় করতেন। পাঞ্জাখানা মসজিদটি প্রথমে কাঁচা ও টিনের বেড়া থাকলেও কয়েক যুগ আগে তা সেমিপাকা করা হয়। নলকূপ বসিয়ে গড়া হয় ওজুখানা, টয়লেট।
তিনি আরো লিখেন- জমির রেকর্ডীয় মালিক বশির চৌধুরী মৃত্যুবরণে তার স্বত্ব পান পাঁচ ছেলে এফজালুল হক চৌধুরী, নাছির আহমদ চৌধুরী, তমিজুল হক চৌধুরী, আজিজুল হক চৌধুরী, আনোয়ারুল হক চৌধুরী ও ৯ মেয়ে তাহেরা বেগম, তৈয়বা খানম, তফুরা বেগম, জাহানারা বেগম, দিল আফরোজা বেগম, দিলরুবা বেগম, তসলিমা বেগম, মুসলিমা বেগম ও লুৎফুননেছা কহিনুর। ছেলেরা প্রত্যেকে যথাক্রমে ২ একর ২৪ শতক আর মেয়েরা প্রতিজন পেয়েছে ১ একর ১২ শতক জমি। সেভাবেই সকল ওয়ারিশ জমি ভোগ করে আসছিলেন। এর মাঝে বোন তছলিমা বেগম চৌধুরী জমি ভোগদখল থাকাবস্থায় মৃত্যুবরণ করলে তার স্বত্ব স্বামী, ছেলেমেয়েরা পান।
এদিকে ওয়ারিশদের মধ্যে আনোয়ারুল হক চৌধুরী চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের কার্ডিওলজি বিভাগের প্রধান থাকাকালীন বাগানবাড়িটিতে মা ওমেদা খাতুন ও বাবা বশিরের নামে ট্রাস্ট গঠনের কথা বলে অন্য ওয়ারিশগণের কাছ থেকে কৌশলে তাদের অংশ নিজ নামে লিখে নেন। ৫ ভাই ৯ বোনের মাঝে মৃত বোন তছলিমার ওয়ারিশ ও লুৎফুন্নেছা তাদের অংশ লিখে দেননি। জমি নেয়া পর্যন্ত ওমেদা বশির নামে সাইনবোর্ড ব্যানার থাকলেও চলতি বছরের শুরু হতে মায়ের নামের স্থলে ডা. আনোয়ারুল হক চৌধুরীর নামে সাইনবোর্ড ও ব্যানার উঠে। এরই মধ্যে কোনো ওয়ারিশকে না জানিয়ে পুরোবাগান বাড়ি বিক্রি করার বিজ্ঞাপন দেন। এলাকার কাশেম নামে ধর্মান্তরিত এক খ্রিষ্টান (বর্তমানে আমেরিকা প্রবাসী) জায়গাটি নিতে রাজি হন। তবে, শর্ত দেন বাগানে বিদ্যমান মসজিদটি তুলে ফেলতে হবে। তাতে রাজি হয়ে সম্প্রতি সবার অগোচরে কেয়ারটেকার মেম্বার হেলাল লোকজন এনে মসজিদ, অজুখানাসহ সবকিছু গুঁড়িয়ে দিয়ে সেখানে মসজিদের কোনো চিহ্নই রাখেননি। এলাকার লোকজনকে ধোঁকা দিতে প্রচার করা হয় পুনর্নির্মাণের জন্য তা ভেঙে ফেলা হয়েছে। এলাকায় থাকা কাশেমের এক ভাইয়ের নামে বাগানবাড়ি বায়না করা হয়েছে। কিন্তু নিজের ভাগের জমিতে হলেও মসজিদটি রাখতে চান লুৎফুন্নেছা। তবে, তার জমিটিও বাউন্ডারির ভেতরে রেখে দেয়া হয়েছে। গত রমজানেও এ মসজিদে খতমে তারাবির নামাজ আদায় হয়েছে উল্লেখ করে হাফেজ আবদু শুক্কুর বলেন, আমার জন্মের আগে হতেই এ পাঞ্জাখানা মসজিদ সচল বলে বাপ-দাদারা বলেছেন। বশির আহমদ চৌধুরী ও তার বড় ছেলে এফজালুল হক চৌধুরী ধর্মপ্রাণ মানুষ ছিলেন তারাই এখানে স্থানীয় ও কৃষি শ্রমিকদের নামাজের ব্যবস্থা করে গেছেন। কিন্তু জমি একজনের হাতে যাওয়ার পর সব ওলট-পালট হয়ে মসজিদটিও নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে।
ডুলাহাজারা মালুমঘাট চাবাগান ৩নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুহাম্মদ ইসহাক বলেন, কয়েক যুগের পুরোনো পাঞ্জাখানা মসজিদটি ভেঙে ফেলার খবর পেয়ে কেয়ারটেকার হেলালকে জিজ্ঞেস করা হয়। বলেছিল পুননির্মাণের জন্য ভাঙা হচ্ছে। এখন জানছি সবকিছু গুঁড়িয়ে পুরো বাগানই বিক্রি করা হচ্ছে। কেয়ারটেকার হেলাল উদ্দিন মেম্বার বলেন, একই সীমানায় হলেও আমরা পার্বত্য এলাকা আর ডাক্তার আনোয়ারুল হক চৌধুরীরা সমতলের বাসিন্দা। আমার বাড়ির পাশে হওয়ায় তার বাগানবাড়িটি ২০ বছরের জন্য আমি লিজ নিয়েছিলাম। আমিই বছর দুয়েক আগে এ পাঞ্জাখানা মসজিদ তৈরি করেছি। এখন ওনি বাগান বিক্রি করে দেয়ায় আমার গড়া খামারসহ পাঞ্জাখানা মসজিদও ভেঙে নিয়ে এসেছি।
বাগানবাড়ির মালিক ডা. আনোয়ারুল হক চৌধুরী বলেন, বাবার বন্দোবস্তি জমি আমার অংশ ছাড়াও বাকি ওয়ারিশদের কাছ হতে কিনে নিয়েছি। যারা বিক্রি করেনি তাদের জমি অন্যস্থানে আছে। আমার বাবার আমলে নয়, ১৯৮৫ সালে বাগানবাড়ির কর্মচারী, কৃষি শ্রমিক পথচারীদের নামাজের সুবিধার্থে পাঞ্জাখানা মসজিদটি আমি করেছিলাম। এখন বাগানবাড়িটি বিক্রি করছি, তাই আমার গড়া সব স্থাপনা তুলে নেয়া হচ্ছে। আমার জমিতে আমি ইবাদতখানা রাখতে না চাইলে কার কী বলার থাকতে পারে?
মালুমঘাট চা বাগান মদিনাতুল উলুম মাদ্রাসার পরিচালক মুফতি আবদুল্লাহ ও মুফতি মাহমুদুল হক বলেন, কোনো জায়গায় ঘর তৈরি হয়ে পাঁচ ওয়াক্ত নামাজ আদায় করে এলে তা আল্লাহর ঘর হিসেবে পরিগণিত। তা নিশ্চিহ্ন করা ইসলাম সমর্থন করে না। তারা কিন্তু এলাকায় প্রচার করেছিল পুনর্নির্মাণের জন্য পুরোনো পাঞ্জাখানা ভাঙা হচ্ছে। কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, একটা অভিযোগ পেয়েছি। খোঁজ নিয়ে পরবর্তী ব্যবস্থা নেয়ার নির্দেশনা দেয়া হয়েছে।