ঢাকা ২৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৮ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

ঝুঁকিপূর্ণ পথে পাকিস্তানিদের ইউরোপ যাওয়া বেড়েছে

ঝুঁকিপূর্ণ পথে পাকিস্তানিদের ইউরোপ যাওয়া বেড়েছে

ইউরোপে কাজ পেতে লিবিয়া রুট ব্যবহার করছে হাজার হাজার পাকিস্তানি। এই পথে ইউরোপে যেতে হলে নৌকায় সাগর পাড়ি দিতে হয়। এ পথ কতটা বিপজ্জনক, তা বোঝা যায় জুন মাসের একটি ঘটনায়, যখন গ্রিসের উপকূলে একটি অতিরিক্ত যাত্রীবোঝাই নৌকা ভূমধ্যসাগরে ডুবে বহু মানুষের মৃত্যু হয়। এ বছর প্রায় ১৩ হাজার পাকিস্তানি মিশর ও লিবিয়ার উদ্দেশে দেশ ছেড়েছে। তাদের বেশির ভাগই ফেরেনি। এর মধ্যে ছিল ফরহাদ ও তৌহিদ নামের দুই তরুণ। তাদের মায়ের কাছে শেষ বার্তা ছিল দুশ্চিন্তা না করার। গত ১৪ জুন লিবিয়া থেকে গ্রিসে যাওয়ার পথে সাগরে ডুবে যায় অভিবাসনপ্রত্যাশীদের বহনকারী একটি নৌ। তাতে প্রায় ৩০০ জন পাকিস্তানি আরোহী নিখোঁজ হন। তাদের সবাই ডুবে মারা গেছেন বলেই আশঙ্কা করা হচ্ছে। আটক লোকেদের অধিকাংশই ধরা পড়েছে ওই ঘটনার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত থাকার অভিযোগে। নিখোঁজ ৩০০ জনের মধ্যে ছিল ফরহাদ ও তৌহিদও। যাদের বয়স যথাক্রমে ১৫ ও ১৮ বছর। তাদের মধ্যে একজনের নাম হলো হুসেইন শাহ। গত একদশক ধরেই তিনি একজন মানব পাচারকারী এবং এ নিয়ে তৃতীয় বারের মতো গ্রেপ্তার হয়েছেন তিনি। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ১৪ জুনের নৌকাডুবিতে তিনি বড় ভূমিকা পালন করেছেন। তবে তা অস্বীকার করছেন হুসেইন শাহ। হুসেইন শাহ বলেন, এখানে বেকারত্ব এত বেশি যে, লোকে নিজ থেকেই আমাদের বাড়িতে এসে জানতে চান, আমি এমন কাউকে চিনি কি না যে, তার ভাই ও ছেলেদের বিদেশে নিয়ে যেতে পারবে। তার দাবি, এত বছর ধরে মানব পাচারের কাজ করার ফলে তিনি হাজার হাজার লোককে নিয়ে গেছেন। তিনি বলেন, আমি এ কাজ শুরু করেছিলাম কারণ এখানে আর কোনো ব্যবসা নেই। এ কাজে আমি প্রধান ভূমিকায় নেই। বরং লিবিয়াতে যারা বসে আছে, তারাই বিরাট লোক, অনেক ধনী। আমরা অর্থের সিংহভাগ পাই না। এমনকি ১০ ভাগের ১ ভাগও নয়। এভাবে যেতে গিয়ে যারা মারা গেছেন তাদের জন্য কী তার কোনো অপরাধবোধ কাজ করে না- এ প্রশ্ন করতে হুসেইন শাহের গলার স্বর পাল্টে গেল। আমি দুঃখ বোধ করি, আমরা সত্যিই লজ্জিত। কিন্তু আমরা কি করব? আমি যদি না করি, তাহলে অন্য কেউ এ কাজ করবে। পাকিস্তানের অর্থনৈতিক অবস্থা এখন গুরুতর সংকটাপন্ন। মুদ্রাস্ফীতি প্রায় ৪০ শতাংশ, দেশটির মুদ্রা রুপির মূল্যমান ক্রমাগত নামছে। এ কারণে অনেকেই চাইছে বিদেশে চলে যেতে। সেখানে নিম্ন বেতনের কাজ করলেও তা হবে দেশে থেকে তারা যা আয় করবে তার চেয়ে বেশি। গত বছরের শেষ দিকে করা এক জরিপে দেখা গেছে, পাকিস্তানে ১৫ থেকে ২৪ বছর বয়সের তরুণদের ৬২ শতাংশই দেশ ছেড়ে চলে যেতে চান। এর মধ্যে কিছু আছে যারা বৈধ পথে বিদেশে যাওয়ার চেষ্টা করবে, কিন্তু অন্যরা বের করে নেবে বিকল্প পথ। অবৈধ অভিবাসন এমন একটি জিনিস, যার সংখ্যা নিরুপণ করা খুবই কঠিন। কিন্তু পাকিস্তানের কর্তৃপক্ষ বলেছে, সাম্প্রতিক গ্রিসের জাহাজডুবি থেকে এটা স্পষ্ট হয়ে গেছে যে, পাকিস্তানিদের জন্য আজকাল সবচেয়ে জনপ্রিয় রুট হচ্ছে এটাই, প্লেনে দুবাই হয়ে মিশর বা লিবিয়া, তারপর পূর্ব লিবিয়া থেকে একটা বড় নৌকায় করে সাগর পাড়ি দিয়ে ইউরোপ। ইরান বা তুরস্ক হয়েও যাওয়ার পথ আছে, কিন্তু সেসব পথে পাকিস্তানিদের সংখ্যা কম। তুরস্কের মতো দেশগুলোর সম্প্রতি অবৈধ পথে আসা লোকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিচ্ছে বলে জানান, পাকিস্তানের মোহাম্মদ আলম শিনওয়ারি। তিনি গ্রিসের জাহাজডুবির ঘটনাটি তদন্ত করছেন। তিনি বলেন, ২০২৩ সালের প্রথম ৬ মাসে প্রায় ১৩ হাজার লোক লিবিয়া বা মিশরের পথে দেশ ছেড়েছেন। ২০২২ সালে এর সংখ্যা ছিল ৭ হাজার। এ বছর যে ১৩ হাজার গেছেন, তাদের মধ্যে ১০ হাজার লোকই আর দেশে ফেরেননি। শিনওয়ারি বলেন, এসব রুটের ব্যাপারে তদন্ত করা এক জটিল ব্যাপার কারণ লোকে অভিযোগ করতে আসে না বরং নিজেদের মধ্যে মীমাংশা করে নেয়। পরিবারের সহায়তা ছাড়া এসব মামলা করা খুবই কঠিন বলেও জানান তিনি। যারা এভাবে গেছেন তাদের অনেকে এখন লিবিয়ায় আটকে আছেন। পাঞ্জাবে একটি পরিবারের সঙ্গে কথা বলতে গিয়ে দেখা যায়, এরকম পরিবার ওই এলাকায় আরো অনেক আছে। কেউ কেউ গেছেন মাত্র কয়েক সপ্তাহ আগে। তারা বন্ধু ও আত্মীয়দের কাছে বার্তা ও ভিডিও পাঠিয়ে আরো টাকা পাঠানোর অনুরোধ করছেন। এরকম একজনের বাবা আমাদের একটি ভিডিও দেখালেন। তাতে দেখা যাচ্ছে, জানালাহীন সাদা দেয়াল ও মেঝেওয়ালা একটি ঘরে একশ’রও বেশি লোককে রাখা হয়েছে। গরমের জন্য তারা তাদের জাঙ্গিয়া ছাড়া আর সবকিছু খুলে ফেলেছে। বেশ কয়েকজন ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে অনুনয় করছে- তাদের এখান থেকে নিয়ে যাওয়ার জন্য। এসব পরিবার জানে না যে এই লোকরা এখন কার হাতে আটক আছে- পাচারকারী, লিবিয়ান কর্তৃপক্ষ, নাকি অন্য কেউ। তারা পরিচয় প্রকাশ করতেও নিষেধ করলেন, বন্দিদের ওপর সম্ভাব্য প্রতিশোধের ভয়ে। তাদের দুই-তিন দিনে মাত্র একবার খাবার দেওয়া হয় বলে জানান এক পিতা। তিনি বলেন, আমার ১৮ বছরের ছেলে খুব কাঁদে, বলে এ কী বিপদে পড়ল সে, আমরাই টাকা দিয়েছি, আবার আমরাই মারা যাচ্ছি। এসব পরিবার এখন দ্বিধাবিভক্ত। একবার তারা বলছেন তারা চান তাদের ছেলেরা নিরাপদে ইউরোপে পৌঁছাক, আরেকবার বলছেন ওরা বাড়ি ফিরে আসুক।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত