কক্সবাজার জেলা কারাগার
ধারণক্ষমতার চেয়ে ৪ গুণ বেশি বন্দি : তবুও স্বস্তি
প্রকাশ : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
স্টাফ রিপোর্টার, কক্সবাজার
কক্সবাজার জেলা কারাগারের প্রধান ফটকে দেখা মিলে কক্সবাজারের রামু উপজেলার চাকমারকুল এলাকার সব্বির আহমদের ছেলে আবদুর রহমানের সাথে। তিনি যৌতুক দাবি সংক্রান্ত একটি মামলার গ্রেপ্তার হওয়ার পর কারাগারে হাজতি হিসেবে ছিলেন টানা ২০ দিন। গত সোমবার আদালত থেকে জামিন পাওয়ার পর কারাগার থেকে বের হন তিনি। ২০ দিনের কারাগার জীবন কেমন কেটেছে- এমন প্রশ্নের উত্তরে তিনি বলেন, ‘খুব ভালো কেটেছে।’
কারাগার জীবন কেমন আবার ভালো- এমন প্রশ্ন করলে তিনি হাসেন। বলেন, ‘নিজের ঘরে যে পরিবেশ ছিল, তেমন ভালো, প্রচলিত অর্থে কারাগার সম্পর্কে যে তথ্য আমি জানতাম, তার সাথে কারাগারের পরিস্থিতির মিল পাইনি।
আবদুর রহমানকে একটু বিস্তারিত বলতে বলা হলে তিনি জানান, কারাগারে একটি শৃঙ্খলিত এবং রুটিন মাফিক জীবন কাটিয়েছেন তিনি। মানসম্পন্ন খাবার, সপ্তাহের একদিন ৮ থেকে ১০ মিনিট মোবাইল ফোনে মিনিটপ্রতি ১ টাকা করে পরিশোধ করে পরিবারের স্বজনদের সাথে আলাপ, ১৫ দিনের একবার স্বজনরা কারাগারে এসে সাক্ষাৎ, স্বজনদের দেয়া পিসিতে জমা টাকা কার্ড প্রদর্শন করে কারা অভ্যন্তরে প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয়। সবমিলিয়ে ভালো গেছে।
একই সময় কারাগার থেকে জামিনে মুক্ত হয়ে বের হন টেকনাফের উত্তর শীলখালী এলাকার এলাকার মোস্তাক আহমদের ছেলে বাবুল (৩০)। তিনি মারামারি-সংক্রান্ত মামলায় দেড় মাস বন্দি থাকার পর মঙ্গলবার বের হয়েছেন। তিনিও আবদুর রহমানের সাথে একমত প্রকাশ করেছেন। তিনি বলেছেন, কারাগারে বন্দির থাকার জন্য ওয়ার্ড বণ্টন, চিকিৎসা ও ওষুধ বিতরণের ক্ষেত্রে আগের পরিস্থিতির উন্নয়ন হয়েছে। কারাগারের অভ্যন্তরে বড় এলইডি পর্দায় শিক্ষামূলক অনুষ্ঠান প্রচারণাসহ বিনোদনমূলক অনুষ্ঠান প্রচারণার ফলে বন্দিদের মানসিক অবস্থার ইতিবাচক হয়েছে। আগে কারা অভ্যন্তরের ক্যান্টিনে মূল্য তালিকা ছিল না, এখন সেই মূল্য তালিকা দেখেছেন তিনি।
তিনি বলেছেন, বছর কয়েক আগেও একটি মামলায় সপ্তাহ মতো কারাগারে ছিলেন তিনি। ওই সময়ের সাথে বর্তমান সময়কে মিলিয়ে কারা জীবনকে স্বস্তিকর বলে মন্তব্য করেন তিনি। তাদের কথার সত্যতা নিশ্চিত হওয়ার জন্য কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পাওয়া আরো কয়েকজনের সন্ধানে আদালত পাড়ায় আইনজীবীদের আশ্রয় নিতে হয়েছে।
আইনজীবীদের সহায়তায় কথা হয়েছে কারা মুক্ত আরো কয়েকজনের সাথে। তাদের একজন উখিয়ার কুতুপালংস্থ ৯ নম্বর রোহিঙ্গা ক্যাম্পের আছাদুজ্জামানের ছেলে সেলিম উল্লাহ। তিনি হত্যা মামলায় ৫ মাস কারাগারে ছিলেন। জামিন মিলেছে গত সোমবার। রোহিঙ্গা যুবক সেলিমের প্রথম কারাগারে থাকা। তিনিও কারাগার নিয়ে যা প্রশ্ন করা হল বললেন ভালো।
একইভাবে কথা হয়েছে চকরিয়া উপজেলার বরইতলী এলাকার জয়নাল আবেদীনের ছেলে আবদুল করিম, টেকনাফের মহেশখালীয়াপাড়ার আবু বক্করের ছেলে নুরুল আমিন, কক্সবাজার পৌরসভার পশ্চিম বাহারছড়া এলাকার কবির আহমেদের ছেলে জয়নাল আবেদীন, চকরিয়ার খুটাখালী এলাকার আবদুল জলিলের ছেলে হুমায়ুন কবিরের সাথেও, যারা সম্প্রতি বিভিন্ন সময় কারাগারে বন্দি থাকার পর জামিনে মুক্ত হয়েছেন।
এছাড়া গত মঙ্গলবার কারাগারের গেটে থাকা অনেক জনের সাথেও আলাপ হয়েছে প্রতিবেদকের।
এসব মানুষের সাথে প্রাপ্ত তথ্যে কারাগারে বন্দিদের মাঝে স্বস্তির এক গল্প উঠে এসেছে। এসব মানুষ বলেছেন, কক্সবাজার জেলা কারাগারের ব্যবস্থাপনায় উল্লেখযোগ্য ইতিবাচক পরিবর্তন দেখেছেন তারা। বন্দি সাক্ষাৎ, বন্দিদের খাবারের মান, স্বজনদের সাথে মোবাইলে কথা বলা, বন্দিদের জামিন, চিকিৎসা, বিনোদন সব মিলিয়েই এই ইতিবাচক পরিবর্তন। প্রাপ্ত তথ্য বলেছে, কারাভ্যন্তরে নগদ টাকা একে বারে বন্ধ রয়েছে। কোনো স্বজন পিসিতে টাকা দিলে রশিদ মূলে যে টাকা জমা হওয়ার পর বন্দির হাতে পৌঁছে যায় পিসি কার্ড। যে কার্ডটি ব্যবহার করে কারা ক্যান্টিনে প্রদর্শিত মূল্য তালিকা দেখে মালামাল ক্রয় করতে হয়।
কারা কর্তৃপক্ষের তথ্য বলেছে, বর্তমানে ধারণ ক্ষমতার ৪ গুণ কাছাকাছি বন্দি রয়েছে। প্রাপ্ত তথ্য মতে, ১২ দশমিক ৮৬ একর আয়তনের এ কারাগারে ধারণ ক্ষমতা ৯০০ জন হলেও বর্তমানে বন্দির সংখ্য ৩ হাজার ২৭০ জন। ২০০১ সালে উদ্বোধন হওয়া কক্সবাজার জেলা কারাগারে ৮৬৬ জন পুরুষ এবং ৩৪ জন নারী বন্দি থাকার কথা। কিন্তু বর্তমানে এ কারাগারে বন্দি রয়েছে নারী রয়েছে ১৫৫ জন, শিশু রয়েছে ৩২ জন আর পুরুষ বন্দির সংখ্যা ৩ হাজার ৮৩ জন।
যেখানে ৬ শতাধিক রোহিঙ্গা রয়েছে।
কক্সবাজার জেলা কারাগারের সুপার মো. শাহ আলম খান জানিয়েছেন, ধারণ ক্ষমতার ৪ গুন বেশি বন্দি এবং অপ্রতুল জনবল নিয়েও সবার সহযোগিতায় কারাগারের শৃঙ্খলা ফেরাতে সফল হয়েছি। আন্তর্জাতিক সংস্থা আইসিআরসির সহযোগিতায় শিশুদের জন্য বিনোদনের কক্ষ, বিনোদন সামগ্রী পাওয়া গেছে। এছাড়া এসব শিশুদের লেখা পড়া, ২ বেলা দুধসহ পর্যাপ্ত খাবার সরবরাহ নিশ্চিত করা হচ্ছে। এর বাইরে সুপেয় পানির জন্য একই সংস্থার অধিনে কারা অভ্যন্তরে প্রকল্পের কাজও চলছে।
নিয়মিতভাবে কারাগার পরিদর্শন, বন্দিদের সাথে আলাপ করে যেকোনো সমস্যা সমাধানের ব্যবস্থা নেন উল্লেখ করে তিনি বলেন, আমি নিজেই নিয়মিত খাবারের মান পরিমাণ তদারকি করে এবং প্রতিদিনের খাবারের যথাযথ মান নিশ্চিত করে বন্দিদের সরবরাহের ব্যবস্থা করি। মোবাইল ফোনে আলাপ, সাক্ষাৎ স্বচ্ছতার সাথে করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। জামিনে খালাসে মুক্তি প্রদানের যে কোনো হয়রানি রোধে প্রতিদিন জামিনপ্রাপ্ত বন্দিদের নাম কারা ফটকের সামনে এলইডি ডিসপ্লের মাধ্যমে প্রকাশ করা হয়।
ফলে জামিন নিয়ে এক শ্রেণির প্রতারক চক্রের অপতৎপরতা বন্ধ হয়ে গেছে। যারা সাক্ষাতের জন্য কারাগারে আসেন তাদের বিনোদনের জন্য গেইটের পাশে দর্শনার্থী বিশ্রামাগারে বড় টেলিভিশন ও ক্যান্টিনের ব্যবস্থা করা হয়েছে। তিনি বলেন, কর্মকর্তা-কর্মচারী ও বন্দিদের সব কাজে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা ও সুশাসন নিশ্চিত করতে আমি আন্তরিকভাবে কাজ করে যাচ্ছি।