সচিবালয়ে হচ্ছে বহুতল কারপার্কিং বাঁচবে সময়, কমবে ভোগান্তি

* যানজট নিরসনে স্মার্ট গাড়ি ব্যবস্থাপনা * অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি এড়াতে স্টিল স্ট্রাকচার

প্রকাশ : ২৩ নভেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  ফারুক আলম

প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়ে গাড়ির জটলা বা যানজট নিরসনে বহুতল মেকানিক্যাল কারপার্কিং করা হচ্ছে। সচিবালয়ের ভেতরে দুটি ১৬ তলা এবং পরিবহণ পুলে একটি কারপার্কিং নির্মাণ হবে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করবে গণপূর্ত অধিদপ্তর।

সংশ্লিষ্টরা জানান, গৃহায়ন ও গণপূর্ত এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের কারপার্কিংয়ের প্রস্তাবিত প্রকল্পগুলো অনুমোদনে পরিকল্পনা কমিশনের প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি-পিইসির সভায় আলোচনা হয়। ওই সভায় কারপার্কিংয়ের উন্নয়ন প্রকল্প প্রস্তাবে (ডিপিপি) কিছু পরিবর্তন আনতে বলা হয়। সেই আলোকে ভবনের নক্শার কিছু সংশোধন এনে গত ৯ নভেম্বরে পরিকল্পনা কমিশনে ডিপিপি জমা দিয়েছে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়। অপরদিকে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরিবহণ পুলে বহুতল কারপার্কিংয়ের ডিপিপি সংশোধন করা হয়েছে। কাজটি করছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের পরিকল্পনা অধিশাখা। ডিপিপি সংশোধনের পরেই জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটিতে (একনেক) উঠবে প্রকল্পটি।

পরিকল্পনা কমিশন সূত্র জানায়, সচিবালয়ের সম্মুখে আব্দুল গণি রোডস্থ সরকারি যানবাহন মেরামত কারখানার স্থানে তিনটি বেজমেন্টসহ ২০ তলাবিশিষ্ট ভবনটি নির্মাণের প্রস্তাব করা হয়েছে। ভবনের তিনটি বেজমেন্ট ফ্লোরসহ ১০ম তলা পর্যন্ত ৮০২টি গাড়ি পার্কিংয়ের সুবিধা রাখা হয়েছে। এছাড়া ১১তম থেকে ২০তম তলা পর্যন্ত পরিবহণ কমিশনারের কার্যালয় এবং জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন দপ্তরসহ অফিস স্পেস, মাল্টিপারপাস হল, ক্যাফেটরিয়া ইত্যাদির সংস্থান রাখা হয়েছে।

সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সচিবালয়ে কর্মরত কর্মকর্তারা গাড়ি নিয়ে সচিবালয়ে প্রবেশ করে নিজ অফিস ভবনের সামনে থেকে গাড়িতে ওঠানামা করেন। সচিবালয়ের ভেতরে গাড়ি রাখার আয়তনের তুলনায় কয়েকগুণ বেশি গাড়ি প্রতিদিন আসছে। পার্কিংয়ের পর্যাপ্ত জায়গা না থাকায় ভেতরে তীব্র যানজট তৈরি হয়। স্বল্প দূরত্বে একটি গাড়ি বের হতে ৩০-৩৫ মিনিট সময় লাগে। অনেকে সচিবালয়ে গাড়ি রাখতে না পেরে বিদ্যুৎ, রেল, শিক্ষা ভবন ও খাদ্য ভবনের সামনের রাস্তার উপরে গাড়ি রাখছে, এতে গাড়ির জটলা তৈরি হয়। একটা-দুটো করে গাড়ি বের হতে ঘণ্টাখানেক সময় লেগে যায়। ফলে যানজটে চরম ভোগান্তিতে পড়ছেন মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিবসহ অন্যান্য কর্মকর্তা-কর্মচারীরা।

সচিবালয়ের গাড়ি পার্কিং ব্যবস্থা সমাধানের লক্ষ্যে কাজ চলছে এমন মন্তব্য করে গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী ওয়াছি উদ্দিন আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, সচিবালয় গাড়ির চাপে নুয়ে পড়ছে। এই সমস্যা সমাধানে সচিবালয়ের ভেতরে বহুতল মেকানিক্যাল কারপার্কিং নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং যেমন বন্ধ হবে, তেমনি গাড়ির চাপও কমে আসবে।

তিনি বলেন, স্মার্ট গাড়ি ব্যবস্থাপনা নিশ্চিতে স্টিল স্ট্রাকচারে ১৬ তলাবিশিষ্ট মেকানিক্যাল কারপার্কিংয়ে একসঙ্গে ৫১০টি গাড়ি রাখা যাবে। ভবন দুটি ১০০ বছরের বেশি সময় মজবুত থাকবে। স্ট্রিল নির্মিত ভবন, প্রয়োজনে সচিবালয় থেকে যে কোনো জায়গায় সহজেই স্থানান্তর করা যাবে।

সচিব আরো বলেন, সচিবালয়ে টিনশেড ক্যান্টিনে একটি এবং অন্যটি ৫ ও ৬ নম্বর ভবনের মাঝামাঝি ফাঁকা জায়গায় নির্মাণ করা হবে। ভবন দুটি নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় ২০৩ কোটি টাকা। এখানে ১৭টি লিফ্টের ব্যবস্থা থাকবে। এসব লিফট দিয়ে ১৬ তলা থেকে নিচ তলায় গাড়ি নামাতে সর্বোচ্চ ৯০ সেকেন্ড সময় লাগবে। এতে মানুষের বাঁচবে সময়, কমবে ভোগান্তি।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্টরা জানান, সরকারের নিয়ম অনুযায়ী উপসচিব মর্যাদার কর্মকর্তা থেকে শুরু করে তদূর্ধ্ব কর্মকর্তাদের ব্যক্তিগত গাড়ি দিয়েছে সরকার। এতে সচিবালয়ের কর্মকর্তাদের মধ্যে ব্যক্তিগত গাড়ির ব্যবহার বেড়েছে। কিন্তু সে তুলনায় পার্কিং বাড়েনি। এছাড়া কোনো কোনো মন্ত্রণালয়ের অধীনে বৈঠক থাকলে অধিদপ্তর, পরিদপ্তর ও বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের যুগ্ম সচিব মর্যাদার কর্মকর্তারা গাড়ি নিয়ে ভেতরে ঢোকেন। গাড়ির চাপে সচিবালয়ের ভেতরে প্রায়ই যানজট তৈরি হয়। ভেতরের জায়গা পূর্ণ হয়ে গেলে অনেক সময় গাড়ি পার্কিং করতে হয় পাশের রাস্তায়। এতে গণি রোডে প্রায়ই তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়। গাড়ির জটলা বা যানজটন নিরসনে সরকারি যাবনহন মেরামত কারখানার জায়গায় ২০ তলাবিশিষ্ট ভবন নির্মাণ করা হবে। ভবনটিতে কারপার্কিংয়ের ব্যবস্থাসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের দপ্তর থাকবে।

জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব (উন্নয়ন অধিশাখা) ড. সুভাষ চন্দ্র বিশ্বাস আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, সচিবালয়ে যানজট নিরসনে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরিবহন পুলে কারপার্কিংয়ের জন্য বহুতল ভবন নির্মাণের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। ইতোমধ্যে ডিপিপি তৈরিসহ মন্ত্রণালয়ের কয়েকটি মিটিং অনুষ্ঠিত হয়েছে। কারপার্কিং ভবন নির্মাণের প্রয়োজন রয়েছে, এ ব্যাপারে কমিটির সবাই একমত পোষণ করেছেন। ফলে ডিপিপি কিছুদিনের মধ্যেই পরিকল্পনা কমিশনে পাঠানো হবে।

সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের আওতাধীন পরিবহন পুলে যে ২০ তলা কারপার্কিং ভবন নির্মাণ হবে, এর ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৪৮ কোটি ৯৯ লাখ টাকা। সচিবালয়ের চারপাশে যানজট নিরসন ও মানুষের চলাচলের সুবিধার্থে তিনটি বহুতল ভবনের ডিপিপির ওপর প্রকল্প মূল্যায়ন কমিটি-পিইসির সভা অনুষ্ঠিত হয়। এতে প্রকল্প প্রস্তাবের বিভিন্ন অংশ নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করা হয়।

সচিবালয়ে গাড়ির প্রবেশদ্বারে দায়িত্বে থাকা নিরাপত্তাকর্মীরা বলছেন, সচিবালয়ে কর্মরত কর্মকর্তা ছাড়াও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় থেকে ইস্যুকৃত স্টিকারে কিছু গাড়ি ভেতরে ‘পার্কিং’ করছে। আবার খুব কড়াকড়িও নেই। আসলে পার্কিংয়ের জায়গা না থাকায়, যে যেখানে খালি পাচ্ছেন সেখানেই গাড়ি রাখছেন। সচিবালয়ের ভেতরে দুটি বহুতল ভবন (২০ তলা) রয়েছে। এদের মধ্যে অর্থ মন্ত্রণালয়ের অধীনে থাকা ভবনে বেজমেন্টে এক ফ্লোরে পার্কিংয়ের ব্যবস্থা রয়েছে। অন্যান্য মন্ত্রণালয় ও বিভাগ থাকলেও সেখানে কোনো পার্কিংয়ের ব্যবস্থা নেই। ফলে বাধ্য হয়েই অনেকে ভবনের আশপাশের জায়গায় গাড়ি পার্কিং করছেন।

শিক্ষা মন্ত্রণালয়ে কাজে আসা মাজেদুল নয়ন বলছেন, সচিবালয়ের সামনের রাস্তায় গাড়ি পার্কিং করায় সৃষ্টি হচ্ছে যানজট। অধিকাংশ গাড়ি সচিবালয়ে আসা মানুষদের। গাড়িগুলো রাস্তার একটি অংশে দখল করে, একারণে দুই লেনের রাস্তা সরু হয়ে যায়। ঢাকা শহরের যানজটের অন্যতম কারণ যত্রতত্র গাড়ি পার্কিং। সেজন্য মন্ত্রণালয়ের উচিত, রাস্তার ওপর থেকে গাড়ির জটলা কমানো।

গণপূর্ত অধিদপ্তরের ই/এম বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী মহিবুল ইসলাম আলোকিত বাংলাদেশকে বলেন, সচিবালয়ের সার্বিক নিরাপত্তা এবং অগ্নিকাণ্ডের ঝুঁকি এড়াতে স্টিল স্ট্রাকচারের মেকানিক্যাল কারপার্কিং ভবনে ফায়ার কোটেড পেইনের ব্যবস্থা থাকবে। এছাড়াও অ্যালুমিনিয়াম শীট প্লেট (এসিপি) বা ফায়ার রোটেডের মাধ্যমে ভবন দুটি ঢেকে রাখার হবে। এতে ভবনে আগুন লাগলে ক্ষয়-ক্ষতির পরিমাণ কমানো সম্ভব হবে।

প্রসঙ্গত, ব্যস্ততম নগরী রাজধানী ঢাকায় মাত্র ১৭ দশমিক ৫৩ একর জমিতে প্রশাসনের প্রাণকেন্দ্র সচিবালয়। ছোট্ট এই জায়গায় ২০ তলা দুটি ভবন, তিনটি টিনশেডসহ রয়েছে ১১টি ভবন, ৮টি ক্যানটিন ও কয়েকটি ব্যাংকের বুথ রয়েছে। এখানে মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, সচিবসহ দেশের গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি, কর্মকর্তা, কর্মচারী ও দর্শনার্থীসহ দিনে প্রায় ২০ হাজারের অধিক মানুষ যাতায়াত করছেন। এতে প্রতিদিন বিপুলসংখ্যক গাড়ি প্রবেশ করছে। কিন্তু গাড়ির তুলনায় নেই পর্যাপ্ত পার্কিং সুবিধা। ফলে সচিবালয়ের ভেতরে তীব্র যানজট সৃষ্টি হয়।