কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন

সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ১৪ ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বেড়েছে ৩,৭৭৪ কোটি টাকা

প্রকাশ : ২৭ ডিসেম্বর ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ১৪টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি ৩,৭৭৪ কোটি টাকা বেড়েছে বলে জানা গেছে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদনে। ব্যাংকখাতে খেলাপি ঋণ বৃদ্ধির ফলে ঝুঁকিভিত্তিতে অ্যাসেট বাড়তে থাকায় মূলধন ঘাটতি বাড়ছে বলে মনে করছেন ব্যাংকাররা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের প্রতিবেদন অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন প্রান্তিকে ১৫টি ব্যাংকের মূলধন ঘাটতির পরিমাণ ছিল ৩৩, ৭৩২ কোটি টাকা। এর মাত্র তিন মাস পর সেপ্টেম্বর প্রান্তিক শেষে ১৪টি ব্যাংকের ঘাটতি বেড়ে দাঁড়িয়ছে ৩৭,৫০৬ কোটি টাকায়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য বলছে, চলতি বছরের সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোর খেলাপি ঋণ কমেছে ৬৪২ কোটি টাকা। অথচ এই সময়ে মূলধন ঘাটতি বেড়েছে প্রায় ৪ হাজার কোটি টাকা, যা একেবারেই ভিন্ন চিত্র। ব্যাংকাররা বলছেন, সেপ্টেম্বর প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোর প্রকৃত খেলাপি ঋণ কমেনি। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত্ব ব্যাংকের বড় পরিমাণে খেলাপি ঋণ পুনঃতফসিল করায় মোটের ওপর খেলাপি ঋণ কমেছে। এ সময়ে যেসব ব্যাংকের খেলাপি ঋণ বেড়েছে, তাদের মূলধন ঘাটতিও বেড়ে গেছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৯টি রাষ্ট্রীয় মালিকানাধীন ও বিশেষায়িত ব্যাংকের মধ্যে ছয়টি- জনতা, অগ্রণী, রূপালী, বেসিক, বাংলাদেশ কৃষি এবং রাজশাহী কৃষি উন্নয়ন ব্যাংকের- সেপ্টেম্বর শেষে ঘাটতি ছিল ৩১,৪০৬ কোটি টাকা। যদিও আগের জুন প্রান্তিকে ব্যাংকগুলোর ঘাটতির পরিমাণ ছিল ২৮,৪৭৩ কোটি টাকা। ছয়টি বেসরকারি ব্যাংক-বাংলাদেশ কমার্স ব্যাংক, আইসিবি ব্যাংক, ন্যাশনাল ব্যাংক, পদ্মা ব্যাংক, বেঙ্গল কমার্শিয়াল ব্যাংক এবং সিটিজেন ব্যাংক সেপ্টেম্বর শেষে ৬ হাজার ২৩ কোটি টাকা মূলধন ঘাটতির সম্মুখীন হয়েছে। জুন শেষে ব্যাংকগুলোর ঘাটতি ছিল ৫,১৮৫ কোটি টাকা। এছাড়া, দুটি বিদেশি ব্যাংক- হাবিব ব্যাংক ও ন্যাশনাল ব্যাংক অব পাকিস্তানের মূলধন ঘাটতি রয়েছে ৭৭ কোটি টাকা। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা বলেন, ‘খেলাপি ঋণ, প্রভিশন ঘাটতি যত বাড়বে, এই মূলধনের ঘাটতিও বাড়তে থাকবে। দেশের ব্যাংকগুলোর আর্থিক সূচক মান অবনতি ক্রমান্বয়ে বাড়তে থাকায় মূলধন সংকট দেখা দিয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘ব্যাংকগুলোর প্রকৃত মূলধন ঘাটতি আরো বেশি। কারণ ১৬টি ব্যাংক কেন্দ্রীয় ব্যাংক থেকে প্রভিশন ডেফারেল নিয়েছে প্রায় ৫০ হাজার কোটি টাকা। এই ডেফারেলের কারণে ৫০ হাজার কোটি টাকার বিপরীতে মূলধন সংরক্ষণে ছাড় পেয়েছে।’ আন্তর্জাতিক নীতিমালার আলোকে ব্যাংকগুলোকে মূলধন সংরক্ষণ করতে হয়। বাংলাদেশে বর্তমানে ব্যাসেল-৩ নীতিমালার আলোকে ব্যাংকের রিস্ক ওয়েটেড অ্যাসেটের ১০ শতাংশ অথবা ৪০০ কোটি টাকার মধ্যে যেটি বেশি, সে পরিমাণ মূলধন রাখতে হচ্ছে। কোনো ব্যাংক এই পরিমাণ অর্থ সংরক্ষণে ব্যর্থ হলে মূলধন ঘাটতি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। নিয়মানুযায়ী, ব্যাংকের উদ্যোক্তাদের জোগান দেওয়া অর্থ ও মুনাফার একটি অংশ মূলধন হিসেবে সংরক্ষণ করা হয়। কোনো ব্যাংক মূলধনে ঘাটতি রেখে তার শেয়ারহোল্ডারদের লভ্যাংশ দিতে পারে না। এছাড়া, বিদেশি ব্যাংকগুলো কোনো স্থানীয় ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করার আগে ব্যাংকের মূলধন পরিস্থিতি বিবেচনায় নিয়ে থাকে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য দেখায়, ব্যাংকিং খাতে ক্যাপিটাল অ্যাডিকুয়েসি রেশিও বা ক্যাপিটাল টু রিস্ক (ওয়েটেড) অ্যাসেট রেশিও (সিআরএআর) জুনের ১১.১৯ শতাংশ থেকে কমে সেপ্টেম্বরে ১১.০৮ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। গত ডিসেম্বরে এই অনুপাত ছিল ১১.৮৩ শতাংশ। একটি ব্যাংক কতটা ভালোভাবে সকল নিয়মনীতি ও শর্তপূরণ করছে তা নির্ধারণের একটি সূচক হল সিআরএআর। এটি রিস্ক-ওয়েটেড অ্যাসেটের সঙ্গে মূলধনের তুলনা করে পর্যবেক্ষকদের ব্যাংকের ব্যর্থতার ঝুঁকি নির্ধারণে সহায়তা করে। এটি আমানতকারীদের অর্থ সুরক্ষিত রাখতে এবং বিশ্বব্যাপী আর্থিক ব্যবস্থার স্থিতিশীলতা ও দক্ষতা প্রচারে ব্যবহৃত হয়। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, জুনের তুলনায় সেপ্টেম্বরে ব্যাংকিং খাতের উদ্বৃত্ত মূলধন ১,২৭৯ কোটি টাকা কমে ১১,৪৮৩ কোটি টাকা হয়েছে। গত ডিসেম্বর শেষে উদ্বৃত্ত মূলধন ছিল ২১,৭৯৮ কোটি টাকা। মূলধন ঘাটতিতে থাকা ব্যাংকগুলো বাদে অল্প কয়েকটি ব্যাংকে উদ্বৃত্ত মূলধন বৃদ্ধি পেয়েছে। একটি রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকের এমডি নাম প্রকাশ না করা শর্তে বলেন, ‘ব্যাংকগুলোর মূলধনেই প্রকাশ পায় ব্যাংকের সার্বিক অবস্থান। কোনো ব্যাংকের মূলধন ঘাটতি বেড়ে গেলে বিদেশি ব্যাংকগুলোর লেনদেন কিংবা এলসি কমিশনও বেড়ে যায়। যার কারণে কেন্দ্রীয় ব্যাংক ব্যাংকগুলোকে প্রভিশন ঘাটতি কম দেখাতে ডেফারেল সুবিধা দেয়।’

তিনি আরো বলেন, রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকগুলো সরকারের অনেক সেবা ন্যূনতম ইন্টারেস্ট নিয়ে দিয়ে থাকে। তার বিপরীতে প্রকৃত ইন্টারেস্ট নিলে তাদের আয়ও বাড়ত; যা প্রভিশনিং ও মূলধন সংরক্ষণে সহায়ক হতো- যোগ করেন তিনি।