টাঙ্গাইলে সন্ধ্যা হলেই টপসয়েল কাটার ধুম
রাতে নদীতীর এলাকায় তৈরি হয় উৎসবের আমেজ
প্রকাশ : ১৭ মার্চ ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
টাঙ্গাইল প্রতিনিধি
টাঙ্গাইলের নিউ ধলেশ্বরী নদীর সাত কিলোমিটার এলাকার ছয়টি স্পটে তীর কেটে বিক্রির প্রতিযোগিতায় নেমেছে মাটিখেকোরা। প্রতিদিন সন্ধ্যা নামলেই শুরু হয় তীর কাটার মহোৎসব। দিনের আলোয় সুনসান নিরবতা থাকলেও প্রশাসনের চোখ ফাঁকি দিতে রাত ৯টার পর নদীতীর এলাকায় উৎসবের আমেজ তৈরি হয়। জনস্বার্থে নদীতীর ও জমির টপসয়েল কাটা বন্ধে পৌরসভার উদ্যোগে মাইকিং করা হলেও কেউ কর্ণপাত করছে না। কালিহাতী উপজেলা প্রশাসনের পক্ষে সহকারী কমিশনার (ভূমি) মোহাম্মদ সিফাত বিন সাদেকের নেতৃত্বে ভ্রাম্যাণ আদালতের একাধিক অভিযান চালানো হচ্ছে। তবে ব্যবসায়ীরা আদালতের অভিযান চলাকালে আত্মগোপনে থাকে। অভিযানের পর পরই কৌশলে প্রতিযোগিতামূলকভাবে মাটি-বালু কেটে বিক্রিতে মেতে ওঠে তারা।
জানা যায়, নিউ ধলেশ্বরী নদীর টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বড় বাসালিয়া ও এলেঙ্গা পৌরসভার অংশে ছয়টি স্পটে দুই তীর কেটে মাটি ও বালু বিক্রি করছে এক শ্রেণির সংঘবদ্ধ ব্যবসায়ী। স্পটগুলো হচ্ছে টাঙ্গাইল সদর উপজেলার মগড়া ইউনিয়নের বড় বাসালিয়ায় দুইটি এবং এলেঙ্গা পৌরসভার চরভাবলা, হায়াতপুর, চরবাঁশি স্পট। এর মধ্যে বড় বাসালিয়ার দুইটি স্পটে উজ্জ্বল, খোকন, সুমন, নাজমুল, আলামিন, জয় প্রমুখ; একই এলাকার অপর স্পটে ফেরদৌস, নাজু প্রমুখ; এলেঙ্গা পৌরসভার চরভাবলা স্পটে অসিম উদ্দিন, নজরুল ইসলাম, এসকে আলম প্রমুখ; হায়াতপুর স্পটে স্থানীয় কাউন্সিলর মো. ছানোয়ার হোসেন, এরশাদ, বকুল তালুকদার, আরিফ, লাবু, জাহিদ প্রমুখ; চরবাঁশি দুইটি স্পটে আওয়ামী লীগ নেতা মাজেদুর রহমান, আব্দুল হালিম এবং অপর স্পটে রফিক, শফিক প্রমুখ তৎপর রয়েছে। সরেজমিন দেখা যায়, এলেঙ্গা পৌরসভার চরভাবলা স্পটে নিউ ধলেশ্বরী নদীর বাম তীরে প্রায় আটশ’ মিটার এলাকার তীর কেটে মাটি-বালু বিক্রি করা হয়েছে। উজান ও ভাটিতে মাটি কাটার ফলে স্থানীয় মৃত সোলেমান মিয়ার প্রবাসী ছেলে শরীফদের বসতবাড়ি পুরোপুরিভাবে ভাঙনের ঝুঁকিতে পড়েছে। মৃত সোলেমান মিয়ার এক ছেলে দুই মেয়ের মধ্যে মেয়েদের অন্যত্র বিয়ে হয়েছে। শরীফ প্রবাসে থাকেন। বাড়িতে শুধুমাত্র তার মা শাহিদা আক্তার বসবাস করেন। শাহিদা আক্তার জানান, তাদের বাড়ির তিন দিকে মাটি কেটে স্থানীয় ব্যবসায়ী অসিম উদ্দিন, নজরুল ইসলাম ও এসকে আলম বিক্রি করেছে। তিনি বার বার নিষেধ করলেও তারা মানেনি। পৌরসভায় জানিয়েও কোনো সুফল হয়নি। বর্ষা মৌসুমে তার বাড়ি নদীগর্ভে হারিয়ে যাওয়ার সমুহ আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। হায়াতপুর স্পটে দিন-রাত চারটি ভেকু মেশিন (খনন যন্ত্র) দিয়ে ২০-২৫ ফুট গভীর করে নদীতীর কেটে প্রতিদিন দেড় শতাধিক গাড়ি মাটি-বালু বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হয়। দিনের আলোয় কয়েক দফায় ভ্রাম্যমাণ আদালতের অভিযান চালানোর কারণে এখন রাত ৯টার পর থেকে নদীতীরসহ আশপাশের তিন ফসলি জমি কেটে মাটি বিক্রি করা হচ্ছে। এ স্পটের মাটি ব্যবসায়ীরা নাম প্রকাশ না করে জানান, তারা প্রশাসনকে ম্যানেজ করেই নদীতীর কেটে মাটি-বালু বিক্রি করছেন। এজন্য তারা এখন দিনে মাটি কাটেন না বা পরিবহনও করেন না। তাছাড়া আগামী বর্ষা মৌসুমে যমুনার পলি জমে কেটে নেওয়া জমিগুলো ভরাট হয়ে যাবে।
চরবাঁশি স্পটে গিয়ে দেখা যায়, নিউ ধলেশ্বরী নদীর ডান তীরে তিনটি ভেকু বসিয়ে রাখা হয়েছে। চারিদিকে সুনসান নিরবতা। রাত ৯টার পর সেখানে মাটি-বালু ব্যবসায়ীদের পদচারণায় মুখর হয়ে ওঠে। শ্রমিকরা মাটি কেটে ভেকু দিয়ে ট্রাক ভরে দেন। কেউ মাটি কাটা তদারকি করেন, কেউ পরিবহনের ট্রাকে স্লিপ দেন। এ কারণে রাতে সেখানে অস্থায়ী দোকানও বসে।
টাঙ্গাইল সদর উপজেলার বড় বাসালিয়ার দুইটি স্পটে তিনটি ভেকু দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা যায়। সেখানে দিনের আলোয় কোনো কাজ করা হয় না। সন্ধ্যা হলেই পুরো এলাকা শত শত ছোট ছোট ট্রাক ও ভেকু মেশিনের আলোয় ঝলমলিয়ে ওঠে। নিউ ধলেশ্বরী নদীর বামতীরে জমে থাকা পলি কেটে বিক্রি করা হয়। সেখানকার স্পট দুটি টাঙ্গাইল সদর উপজেলা ও কালিহাতী উপজেলার এলেঙ্গা পৌরসভার সীমান্ত এলাকায় অবস্থিত। জমে থাকা পলিমাটি সদর উপজেলার বড় বাসালিয়া ও এলেঙ্গা পৌরসভার যৌথ অংশে হলেও তা কালিহাতীর এলেঙ্গা পৌরসভার সড়ক দিয়ে পরিবহন করতে হয়। ফলে প্রায় দুই কোটি পঁয়ত্রিশ লাখ টাকা ব্যয়ে সদ্য নির্মিত পৌরসভার সড়কটি যেকোন সময় ধ্বসে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে।