ঢাকা ২৮ নভেম্বর ২০২৪, ১৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

জবি শিক্ষার্থী অবন্তিকার আত্মহনন

‘উত্যক্তকারী পলিটিকাল বলে প্রক্টর অফিসে স্টেপ নেয়া হয়নি’

‘উত্যক্তকারী পলিটিকাল বলে প্রক্টর অফিসে স্টেপ নেয়া হয়নি’

‘প্রক্টর অফিসে উত্যক্ত করার লিখিত অভিযোগ দেয়ার পর ২ মাস পার হয়ে গেলেও কোনো স্টেপ নেয়া হয়নি, উত্যক্তকারী আমার ডিপার্মেন্টের পলিটিকাল হওয়ায়। এটার রেমিডি কেউ বলতে পারেন? আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীদের এমনিতেও কখনো মূল্য ছিল না এনাদের (প্রক্টরিয়াল বডির)। আর কত অত্যাচার করবে? এতো সিভিয়ার একটা ইস্যুতে তাদের কোনো স্টেপ নেই, ছেলে পলিটিকাল বলে। এখানে আমরা সাধারণ শিক্ষার্থীরা বানের জলেই ভেসে আসছি বলে ওরা মনে করে, এজন্য এতো ইনজাস্টিস’।

আত্মহত্যার দুই মাস আগে গত ১৬ জানুয়ারি এটাই ছিল জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের আত্মহত্যা করা শিক্ষার্থী অবন্তিকা ফাইরুজের ‘মেসেজ খাদিজার মুক্তি চাই’ হোয়াটসঅ্যাপ গ্রুপে এই মেসেজ দেয় তিনি। তার এসব অভিযোগ মোড় ঘুরিয়ে দিচ্ছে পূর্বে ঘটে যাওয়া ঘটনার। রূপ নিচ্ছে নতুন বিশ্লেষণের। ধরা ছোঁয়ার বাইরে থাকা সাবেক প্রক্টর মোস্তফা কামালের নাম সরাসরি উল্লেখ না করলেও প্রক্টরিয়াল বডির প্রতি ক্ষোভ থেকেই লিখেন এসব কথা।

এতে অবন্তিকা উত্যক্তকারী আম্মান সিদ্দিকীকে রাজনীতিক বলে উল্লেখ করেন। বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, আম্মান বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইব্রাহীম ফরাজির কর্মী।

তবে ইব্রাহিম ফরাজি বলেন, আম্মান ওইভাবে ছাত্রলীগ করত না। ডিবেটিংয়ের সুবাদে মাঝে মাঝে সাইদের সাথে আসত। এ ঘটনার পরে জানতে পারি এটাই আম্মান।

এছাড়া অবন্তিকার আত্মহত্যায় প্ররোচনার মামলায় অবন্তিকার মা তাহমিনা বেগম উল্লেখ করেন, লাকি আক্তার লাকি ও রাফিসহ আরো কয়েকজন আমার মেয়ের ওপর নজর রেখে বিভিন্নভাবে মানসিক নিপীড়ন দিতে থাকে। এই লাকি আক্তারও জবি ছাত্রলীগের সভাপতি ইব্রাহীম ফরাজির একনিষ্ঠ কর্মী। লাকি ছাত্রী হলে থাকেন। ছাত্রী হলেও ছাত্রলীগের প্রভাব দেখিয়ে অবন্তিকাকে মানসিক নিপীড়ন করা হতো। যার কারণে তিনি হলে থাকতে পারেননি বলে জানান অবন্তিকার মা।

এদিকে আম্মানসহ উত্যক্তকারী বাকি সহপাঠীদের কয়েকজন ছাত্রলীগের কর্মী হওয়ায় গত বছরের নভেম্বরে অবন্তির দেয়া অভিযোগ কোনো আমলেই নেননি সাবেক প্রক্টর মোস্তফা কামাল। বরং এর আগে অবন্তিকার নামে আম্মানসহ তার সহপাঠীরা অভিযোগ দিলে অবন্তিকার বাবা-মাকে ডেকে এনে মুচলেকাসহ হেনস্তা করা হয়। অভিযোগ আছে, শুধু অবন্তিকাই নয়, পান থেকে চুন খসলেই ভোগান্তির শিকার হন সাধারণ শিক্ষার্থীরা। সাধারণ শিক্ষার্থীদের সঙ্গে ছাত্রলীগের নেতাকর্মীদের কোনো ঝামেলা হলে সাবেক প্রক্টরিয়াল বডির সঙ্গে শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইব্রাহীম ফরাজি ও সাধারণ সম্পাদক এসএম আক্তার হোসাইন মীমাংসা করত বলে জানা গেছে।

প্রক্টর অফিসে বিচার দিয়ে বিচার না পাওয়া, মানসিক ভোগান্তির শিকার হয়েছে বলে অভিযোগ পাওয়া গেছে প্রায় অনেক শিক্ষার্থীর মুখে। গত জানুয়ারি মাসে সাবেক প্রক্টর মোস্তফা কামালের সময়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের ভূমি ব্যবস্থাপনা ও আইন বিভাগের শিক্ষার্থী আলী নূর রহমান বাসে ছাত্রলীগের কিছু কর্মী দ্বার হেনস্তার শিকার হন। এর বিচার চেয়ে প্রক্টর অফিসে অভিযোগ দেন তিনি। কিন্তু এখনো কোনো বিচারই পাননি। আলী নূর বলেন, জায়গা পেয়ে বাসের সিটে বসলে পরীক্ষার আগে আমাকে আধা ঘণ্টা আটকিয়ে রাখে তারা। এখনো আমি বিচার পাইনি। বিচার পাব বলে মনে হচ্ছে না।

২০২৩ সালের ৩১ অক্টোবর তুচ্ছ ঘটনায় জবির ১৫তম ব্যাচের চারুকলা বিভাগের শিক্ষার্থী উম্মে তহমিনা জেরিফ মিশু এবং একই ব্যাচের ফিল্ম অ্যান্ড টেলিভিশন বিভাগের শিক্ষার্থী ছোলায়মান খানকে মারধর করে শাখা ছাত্রলীগের কর্মীরা। এ ঘটনায় বিচার হয়নি।

জবির মেডিকেল সেন্টারে চিকিৎসাসেবা নেওয়ার সময় ২০২৩ সালের ১ আগস্ট সৌরভ দাশ নামে রসায়ন বিভাগের এক শিক্ষার্থীকে মারধর করেন ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদকের অনুসারী নেতাকর্মীরা। এ ঘটনায়ও সৌরভ দাশ বিচার পাননি।

উত্যক্তকারী পলিটিকাল বলে প্রক্টর অফিসে অবন্তির অভিযোগে ব্যবস্থা নেয়া হয়নি বিষয়ে সাবেক প্রক্টর মোস্তফা কামালের কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, অবন্তিকা অভিযোগ দেওয়ার পর তাকে ফোনে পাওয়া যায়নি। প্রক্টর অফিসে সেও আর যোগাযোগ করেনি। যোগাযোগ করলে অবশ্যই ব্যবস্থা নিতাম। আমরা যে কোনো ঘটনায় ব্যবস্থা নিয়েছি।

এদিকে বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা যায়, শাখা ছাত্রলীগের সভাপতি ইব্রাহীম ফরাজি ও সাধারণ সম্পাদক এসএম আক্তার হোসাইন প্রতিদিন প্রক্টর অফিসে দুপুরের খাবার খেতেন। সাবেক প্রক্টরিয়াল টিমের সঙ্গে তাদের ছিল বিশেষ সখ্যতা। ছাত্রলীগের নেতাকর্মীরা দোষ করলে তাই পেত বিশেষ সুবিধা। এ বিষয়ে সাবেক প্রক্টর মোস্তফা কামাল বলেন, প্রক্টর অফিসে ছাত্রলীগ নিয়মিত খাওয়া দাওয়া করত এমন ঘটনা নেই। হয় তারা কোনো প্রোগ্রাম হলে খাওয়া দাওয়া করত।

এদিকে অবন্তিকার মৃত্যুর পর ছাত্রলীগ নিজেদের দোষ ঢাকতে উল্টো বিচারের আন্দোলনে কর্মী পাঠায়। পরবর্তীতে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন অভিযুক্তদের বহিষ্কার ও আইনের আওতায় আনার মতো সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিলেও আন্দোলনের হুমকি দিয়ে নিজেদের স্বার্থসিদ্ধির চেষ্টা চালাচ্ছে।

জানা যায়, বিশ্ববিদ্যালয়টির নতুন ক্যাম্পাসে তাদের পছন্দের ঠিকাদারদের ২০০ কোটি টাকার মাটি ভরাটের টেন্ডার পাইয়ে দিতে তারা নেপথ্যে সাধারণ শিক্ষার্থীদের মাঝে কর্মী ঢুকিয়ে আন্দোলন চলমান রেখেছে। আম্মান ও লাকি ছাত্রলীগের কর্মী কি না জানতে চাইলে একাধিকবার ফোন করেও ছাত্রলীগের সভাপতি ইব্রাহীম ফরাজি বলেন, আম্মান ওইভাবে ছাত্রলীগ করত না। ডিবেটিংয়ের সুবাদে মাঝে মাঝে সাইদের সাথে আসত। এ ঘটনার পরে জানতে পারি এটাই আম্মান।

অবন্তিকার আত্মহত্যার পর তার মা তাহমিনা বেগম বলেন, অবন্তিকা বলত লাকি, আম্মান পলিটিকাল। তাকে বিভিন্নভাবে ভয় দেখাত। লাকি ছিল সবকিছুর নাটের গুরু। তাদের সঙ্গে রাফি, রিমি, মাহিমা, গিতাসহ ৮-১০ জন ছিল। লাকি, রিমিসহ আরো কয়েকজন হলে থাকে। তাদের অত্যাচারে আমার মেয়ে হলে থাকতে পারেনি। আমার মেয়ে খুব মেধাবী। প্রথম থেকে তৃতীয় পর্যায়ে রেজাল্ট ছিল। রাফি প্রথম হবে বলে মানসিক হেনস্তা করে রেজাল্ট খারাপ করতে চাইত। মানসিক ট্রমার ভেতর রাখত। অবন্তিকার মৃত বাবাকে নিয়ে নানা কটূ কথা বলত। দীর্ঘদিন ধরে মানসিক অত্যাচারে আমার মেয়ে আত্মহত্যার পথ বেছে নেয়।

এসব বিষয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর ড. মোহাম্মদ জাহাঙ্গীর হোসেন বলেছেন, আমি ২০-২৫ দিন হলো প্রক্টরের দায়িত্ব পেয়েছি। ঘটনাগুলো অনেক পুরোনো। তবুও একটি একটি করে সব অভিযোগ তদন্ত করে ব্যবস্থা নিব। প্রক্টর অফিসে সবাই সমান। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ড. সাদেকা হালিম বলেছেন, ঘটনাগুলো সব আগের। আমি দায়িত্ব নেয়ার পর একের পর এক অভিযোগ নিষ্পত্তি করছি। অবন্তিকার ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয়ে আইন অনুযায়ী সর্বোচ্চ ব্যবস্থা নিয়েছি। তদন্তে প্রমাণিত হলে যেই হোক তার ব্যবস্থা নেয়া হবে আমার প্রশাসনে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত