‘আমরা বৃষ্টির সময় বৃষ্টির পানি, আর খড়া মৌসুমে তো নদীর পানি খাই। এখন সকাল-বিকাল দুই বেলা নদী থাকি পানি নিয়া খাওয়াসহ ভাত-তরকারি রান্না করি। ভালো পানির খুব সমস্যা আমার এই চরোত। এই চরটার বয়স ১৩-১৪ বছর হইবে। তখন থাকি পানির খুব কষ্ট এডাই (এখানে)।’ এভাবেই কথাগুলো বলছিলেন কুড়িগ্রামের নাগেশ্বরী উপজেলার দুধকুমার নদবেষ্টিত বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের কুঠি বামনডাঙ্গা গ্রামের শামসুল আলমের স্ত্রী মোর্শেদা বেগম। তিনি আরও বলেন, ‘আমার এই চরের প্রায় সব বাড়িত ভালো পানির সমস্যা। সবার কলে খালি আয়রন পানি। এই পানি খাওয়া তো দূরের কথা ভাত-তরকারি রান্না করা যায় না। ভাত-তরকারি রান্না করলে কালা হয়। এই কলের পানি দিয়া ভাত-তরকারি রান্না করলে কেউ খাবার পারে না। এই আয়রন পানিত গোসল করলে হাত পায়োত (পায়ে) চুলকানি হয়। কাপড়-চোপড় নষ্ট হয়া যায়। এখানকার পানিত এতো পরিমাণে আয়রন, না দেখলে বিশ্বাস করবেন না। এডাই সবাই গরিব। ৫০-৬০ ফিট গভীর করে কল বসাইবে তাহে পায় না। আমার মনে হয় ১০০ ফিট গভীর করে কল বসালে পানি ভালো হবার পায়।’ খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নাগেশ্বরী উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়নের দুধকুমার নদের অববাহিকায় প্রায় ১৩-১৪ বছর আগে গড়ে উঠেছে কুটি বামনডাঙ্গা গ্রাম। গ্রামটিতে ৩০০ পরিবারের বসবাস। এখানকার মানুষজন প্রায় সবাই কৃষি কাজের সঙ্গে জড়িত। এছাড়া চরের প্রায় প্রতিটি বাড়িতে নলকূপ স্থাপন করা থাকলেও অতিরিক্ত আয়রনের কারণে সেই পানি ঠিকমতো ব্যবহার করতে পারছেন না তারা। তাই তারা বর্ষা মৌসুমে বৃষ্টির পানি আর শুকনো মৌসুমে নদীর পানি ব্যবহার করছেন। রেশমী বেগম নামের আরও এক নারী বলেন, এই পানি দিয়ে গোসল করলে চুল আঠা হয়ে যায়। এক ঘণ্টা বালতিতে রাখলে লাল হয়ে যায়। এই আয়রন পানির কারণে গায়ে চুলকানি হয়। এই পানি খাওয়ার কারণে মনে হয় পেটের ভিতরে জং ধরছে। আয়রনের ফলে সবার দাঁত কালো হয়ে গেছে।
এই চরে আয়রন মুক্ত পানির সংকটে শুধু মোর্শেদা বেগম ও রেশমী বেগম নন, তাদের মতো অসংখ্য পরিবার বিশুদ্ধ পানির সংকটে রয়েছেন। এখানকার বাসিন্দারা আক্রান্ত হচ্ছেন পানিবাহিত বিভিন্ন রোগে। বিশুদ্ধ পানি পান করতে অনেকে দুধকুমার নদের পানি সংগ্রহ করে রান্নার পাশাপাশি এই পানি পান করছেন। সারছেন সংসারের প্রয়োজনীয় কাজও। অপর দিকে কাউকে এক কিলোমিটার দূর থেকে এসেও এ নদ থেকে বোতল ও কলসি ভরে পানি নিয়ে যেতে দেখা গেছে। সচেতন মানুষজন বলছেন, সরকারিভাবে যদি ওই চরটিতে গভীর নলকূপ স্থাপন করে দেয়া যায়, তাহলে হয়তো চরবাসীর জন্য বিশুদ্ধ পানির সংকটের বিষয়টি সমাধান হবে। নাগেশ্বরী উপজেলার বামনডাঙ্গা ইউনিয়ন পরিষদের (ইউপি) চেয়ারম্যান আসাদুজ্জামান রনি বলেন, আমার ইউনিয়নের চারটি ওয়ার্ডই চর। এই চারটি চরেই বিশুদ্ধ পানির সংকট। কম-বেশি সবার নলকূপে আয়রন পানি। এ কারণে অনেকে নদী থেকে পানি সংগ্রহ করে তা ব্যবহার করছেন। তাই বলব সরকারিভাবে যদি আমার চরগুলোতে গভীর নলকূপ স্থাপন করা যায়, তাহলে হয়তো চরবাসী বিশুদ্ধ পানি খেতে পারত। নাগেশ্বরী উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) কাউছার আহাম্মেদ বলেন, আমার উপজেলায় বামনডাঙ্গা ইউনিয়নে আয়রন পানির সমস্যাটি রয়েছে। জনস্বাস্থ্যের নির্বাহী প্রকৌশলী সেখানে গিয়েছিলেন। আমি আবারও তাদের সঙ্গে কথা বলব। আশা করছি ভালো কিছু হবে। কুড়িগ্রাম জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তরের নির্বাহী প্রকৌশলী হারুনর রশীদ জানান, জেলার যেখানে পানির সমস্যা রয়েছে, আমরা ১০টি করে বাড়ি মিলিয়ে একটি করে গভীর নলকূপ স্থাপন করছি। সেখানেও সমস্যা থাকলে গভীর নলকূপ স্থাপন করা হবে। কুড়িগ্রামের সিভিল সার্জন ডা. মঞ্জুর-এ মোর্শেদ বলেন, নলকূপের এরকম আয়রন পানি পান করলে তো অ্যাসিডিটির সমস্যা হতে পারে। নদীর পানি খাওয়া যাবে, তবে অবশ্যই সেই পানি ছেঁকে ফুটিয়ে খেতে হবে। এছাড়া পানি বিশুদ্ধকরণ ট্যাবলেটও রয়েছে। অতিরিক্ত আয়রন পানির বিষয়ে মেডিসিন বিশেষজ্ঞ ডাক্তাররা ভালো বলতে পারবেন।