দেশ-বিদেশে সুঘ্রাণ ছড়াচ্ছে মৌলভীবাজারের আগর-আতর

প্রকাশ : ১১ মে ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

চায়ের রাজ্য মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলাকে বলা হয় আগর-আতরের আঁতুড়ঘর। এই শিল্পের খ্যাতি দেশের গণ্ডি পেরিয়ে এখন বহির্বিশ্বেও ছড়িয়ে পড়েছে। আগর-আতরকে বাংলাদেশের ভৌগোলিক নির্দেশক (জিআই) পণ্য হিসেবে অনুমোদন দিয়ে এরইমধ্যে জার্নাল প্রকাশিত হয়েছে। জানা গেছে, বাংলাদেশে আগর শিল্পের ইতিহাস এই সুজানগর পুরোটা দখল করে আছে। এই জনপদ থেকে প্রতিবছর কোটি কোটি টাকার কাঁচা আতর মধ্যপ্রাচ্য, ইউরোপসহ বিভিন্ন দেশে রপ্তানি হয়। চাহিদা ভালো থাকায় প্রচুর পরিমাণে আগর কাঠও রপ্তানি হচ্ছে। এসব কাঠ ধূপের মতো জ্বালিয়ে সুগন্ধি তৈরি করে। মৌলভীবাজার জেলায় ৪০০ বছর ধরে রাজত্ব করছে আগর-আতর। এ খ্যাতি সেই মোঘল আমল থেকে। আগরগাছ থেকে প্রক্রিয়াজাতের মাধ্যমে আতর তৈরি করে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্রি করা হয়, যার সুঘ্রাণ ছড়িয়েছে দেশে দেশে। জানা যায়, বড়লেখা উপজেলার সুজানগরকে বলা হয় আগরের রাজধানী। পাহাড়ি এলাকায় সবচেয়ে বেশি আগরের চাষ হয়ে থাকে। আবার বাগান তৈরির পাশাপাশি বসতবাড়ির আশপাশে গাছ লাগানো হয়। বাড়ির আঙিনা থেকে এই চাষ এখন শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। বাণিজ্যিকভাবে আগরের চাষ বেড়েছে এ অঞ্চলে। এই শিল্পের সঙ্গে মৌলভীবাজারের ৪০ থেকে ৫০ হাজার মানুষ প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে যুক্ত রয়েছেন। সুজানগর ইউনিয়নে গেলে দেখা মিলবে বাগানে ও বসতঘরের পাশে দাঁড়িয়ে আছে সারি সারি আগরগাছ। গ্রামীণ মেঠোপথ ধরে হাঁটলেই নাকে আসে আগর-আতরের সুঘ্রাণ। কারখানার মালিক ও শ্রমিকদের কেউ বাড়ির উঠানে আগরগাছের ছোট ছোট ফালি কাটছেন, আবার কেউবা ব্যস্ত কারখানায় আতর তৈরিতে। আগর-আতর ব্যবসায় জড়িত জেলার ব্যবসায়ীদের নিয়ে গঠিত হয়েছে বাংলাদেশ আগর অ্যান্ড আতর ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশন।

এ সংগঠন সূত্র জানায়, সুজানগরে প্রায় ২৫০টি ছোট ও মাঝারি আগর-আতর কারখানা গড়ে উঠেছে। এছাড়া জেলার অন্যান্য স্থানে রয়েছে আরও প্রায় ৫০টির মতো। জেলা থেকে বছরে আনুমানিক ৫ হাজার লিটার কাঁচা আতর এবং ১০ থেকে ১৫ হাজার কেজি আগরকাঠ বিদেশে রফতানি হয়। প্রাকৃতিকভাবে সৃষ্ট পরিপক্ক আগরগাছের প্রতি কেজি কাঠ ৮০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকায় বিক্রি হয়। আর সাধারণ কাঠ মানভেদে ২শত থেকে হাজার টাকায়। একেকটি কারখানায় মাসে ১ থেকে ৫ লিটার তরল আতর উৎপাদিত হয়। মানভেদে প্রতি তোলা (১১.৬৬ গ্রাম) আতর ৬ থেকে ১০ হাজার টাকায় টাকায় বিক্রি হয়। তবে রফতানির ক্ষেত্রে পণ্যের দাম আরো বেশি। সংশ্লিষ্টরা জানান, আগর থেকে আতর সংগ্রহের পদ্ধতিটি সনাতন। প্রাকৃতিকভাবে আগরগাছে সৃষ্ট ক্ষতে জমে কষ। গাছের ক্ষতস্থান কেটে তা জ্বাল দিয়ে তৈরি হয় সুগন্ধি আগর। কিন্তু প্রাকৃতিকভাবে গাছে কখন ক্ষত হবে। এজন্য অপেক্ষা করতে হতো বছরের পর বছর। প্রাকৃতিক উপায়ে উৎপাদনের চাহিদা পূরণ করা ছিল অসম্ভব। তাই এখানকার বাসিন্দারা আবিষ্কার করেন বর্তমান লোহার পেরেক মারা পদ্ধতি। ফলে সাত-আট বছরের মাথায় একটি আগরগাছ থেকে এখন আগর-আতর উৎপাদন সম্ভব হচ্ছে। জানা যায়, বর্তমানে এ প্রক্রিয়ায় গাছ লাগানোর পাঁচণ্ডছয় বছর পর পুরো গাছে এক ইঞ্চি পরপর পেরেক মেরে ক্ষত সৃষ্টি করা হয়। তখন গাছ থেকে একধরনের রস বের হয়। পেরেকের চারপাশে সেই রস জমে কালো রঙ হয়। এভাবে কয়েক বছর রাখার পর গাছ কাটা হয়। ছোট ফালি করে কাটার পর পেরেক খুলে ছোট ছোট টুকরো করা হয়। পরে ওই টুকরোগুলো ১৫ দিন থেকে ১ মাস ড্রামের পানিতে ভিজিয়ে রাখা হয়। তারপর সেগুলো স্টিলের ডেকচির মধ্যে দিয়ে অনবরত জ্বাল দেওয়া হয়। তখন পাতন পদ্ধতিতে একটি নলের মাধ্যমে ফোঁটায় ফোঁটায় আতর নির্দিষ্ট পাত্রে জমা হয়। সুজানগরের আগর চাষি আব্দুর রহমান সামছু জানান, এ গ্রামের মানুষ বংশপরম্পরায় আগর-আতর শিল্পের সঙ্গে জড়িত। পুরো প্রক্রিয়ায় নারী-পুরুষ সম্মিলিতভাবে কাজ করে থাকেন। গত কয়েক বছরে দেশ-বিদেশে চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় শিল্পটির সঙ্গে নতুন করে যুক্ত হয়েছেন অনেকে। ফলে আশপাশের এলাকায়ও গড়ে উঠেছে নতুন নতুন বাগান ও কারখানা। বদলে দিয়েছে অনেকের জীবন। আগর-আতর ব্যবসায়ী মো. আফজাল হোসেন জানান, পর্যাপ্ত মূলধনের অভাবে বিশ্বায়নের সঙ্গে তাল মিলিয়ে আতর উৎপাদনে নতুন প্রযুক্তির ব্যবহার করা যাচ্ছে না। তাছাড়া এখানকার কারখানাগুলো অনেক ছোট, সবার পক্ষে পুরো প্রক্রিয়া শেষ করে রপ্তানিও সম্ভব হচ্ছে না। বাংলাদেশ আগর অ্যান্ড আতর ম্যানুফ্যাকচারার অ্যান্ড এক্সপোর্টার অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কবির আহমেদ চৌধুরী বলেন, মহা মূল্যবান এই আতরের মূল বাজার মধ্যপ্রাচ্যসহ বিশ্বের বিভিন্ন দেশে। মধ্যপ্রাচ্যে অবস্থানরত এই অঞ্চলের প্রবাসীরা আতর ব্যবসার সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। এখানে আগর শিল্পের অপার সম্ভাবনা থাকলেও রয়েছে অনেক সমস্যা। সেই সমস্যা সমাধান করা হলে এ শিল্প আরো বিকশিত হবে বলে তিনি জানান। জেলা প্রশাসক ড. উর্মি বিনতে সালাম জানান, আগর ও আতর দুটি পণ্য জিআই স্বীকৃতি পেয়েছে। বর্তমানে সনাতন পদ্ধতির পরিবর্তে আধুনিক পদ্ধতি সংযোজন করে অগ্রসর করার লক্ষ্যে আমরা কাজ করছি, পাশাপাশি আরো অনেকগুলো উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।