জাবিতে অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণ
হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য
মাস্টারপ্ল্যানের দাবি শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের
প্রকাশ : ০২ জুন ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
জাবি প্রতিনিধি
দেশজুড়ে সবুজের স্বর্গখ্যাত প্রাণ প্রকৃতির অন্যতম আশ্রয়স্থল জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়। পরিযায়ী পাখিসহ প্রায় সব প্রজাতির দেশীয় বন্য প্রাণীর জন্য এটি একটি নিরাপদ আশ্রয়স্থল। অথচ সম্প্রতি বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসনের অব্যবস্থাপনায় ক্রমাগত মাস্টারপ্ল্যানহীন ভবন নির্মাণের জেরে পুকুর ও জলাশয় ভরাট এবং বৃক্ষ নিধনের জন্য হুমকির মুখে জীববৈচিত্র্য। বিশ্ববিদ্যালয়ের অভ্যন্তরে গত এক মাসে সরেজমিন পর্যবেক্ষণে দেখা গেছে অপরিকল্পিত ভবন নির্মাণের কাজে গত প্রায় ছয় শতাধিক বৃক্ষ নিধন ও মৌসুমে ক্যাম্পাসের অভ্যন্তরে সবচেয়ে বেশি সংখ্যক পরিযায়ী পাখির প্রধানতম আশ্রয়স্থল পুরোনো রেজিস্ট্রার ভবনের সামনে অবস্থিত ‘মেইন বার্ডস লেক’ ভরাট করে ৬ তলাবিশিষ্ট ‘চারুকলা অনুষদ ভনন’ নির্মাণের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। এ নিয়ে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (ইআইএ) ও মাস্টারপ্ল্যানের জোর দাবি জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষক-শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয় সূত্রে জানা গেছে, গত ৬ মে বিশ্ববিদ্যালয় জলাশয় ব্যবস্থাপনা কমিটির সভায় লেকটিকে মেইন বার্ডস লেক নামে শনাক্ত করা হয়। ৭.১৫ একর আয়তনের লেকটিকে ওই সভায় সংস্কারের জন্য সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। কিন্তু ওই স্থানে বহুতল ভবন নির্মাণ করা হলে, নির্মাণকালীন সময়ে উৎপন্ন শব্দ ও বিশৃঙ্খলায় লেকটি আর পরিযায়ী পাখির জন্য বাসাযোগ্য থাকবে না বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। জলাশয় ব্যবস্থাপনা কমিটির এ সিদ্ধান্ত গত ২৩ মে অনুষ্ঠিত সিন্ডিকেট সভায় অনুমোদিত হয় বলেও জানা গেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রকল্প অফিসে খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, প্রকল্পটি বাস্তবায়নে পরিবেশগত প্রভাব মূল্যায়ন (এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট-ইআইএ) করা হয়নি। তবে কিছুদিন আগে শিক্ষার্থীদের সাথে একটি বৈঠকে ফিজিবিলিটি স্টাডিকে (সুবিধাদি পর্যালোচনা) ইআইএ বলে উপস্থাপন করা হয়। এটিকে প্রতারণা বলছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশ সচেতন শিক্ষার্থীরা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের সচেতন শিক্ষার্থী ও পরিবেশবিদদের দাবি, লেকটিতে পরিযায়ী পাখির প্রধান আবাসস্থল এবং বিভিন্ন প্রজাতির প্রায় পাঁচশত গাছপালা রয়েছে সেখানে। এসব বিবেচনায় এটি পরিযায়ী পাখি ও জীববৈচিত্র্যের জন্য গুরুত্বপূর্ণ। বিশ্ববিদ্যালয়ের বিকল্প জায়গা থাকলেও সেখানে ভবন করতে বললে চারুকলা অনুষদ কর্তৃপক্ষ তাদেরকে ভবন নির্মাণে বিরোধী হিসেবে দেখিয়ে পরিবেশকে ধ্বংস করে ভবন নির্মাণের চেষ্টা চালাচ্ছে বলেও অভিযোগ করেছেন অনেকে। অভিযোগকারীদের দাবি, এখানে ভবন নির্মাণ করা হলে নির্মাণকালীন উচ্চ শব্দে আর কোনো পরিযায়ী পাখি আসবে না। পাশাপাশি লেকটির জীববৈচিত্র্য সম্পূর্ণ নষ্ট হয়ে যাবে। মাস্টারপ্লান প্রণয়ন করে ভবন নির্মাণ নিয়ে চারুকলা অনুষদ কর্তৃপক্ষ বারবার নানা অজুহাত দেখিয়ে আসছে। একান্ত প্রয়োজন হলে বিকল্প জায়গার পরামর্শ দেওয়া হলেও কর্তৃপক্ষ বিষয়টি আমলে নিচ্ছে না। আর ইআইএ না করে এতদিন প্রতারণা করা হয়েছে।
এ বিষয়ে আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিভাগের শিক্ষার্থী তৌহিদ মোহাম্মদ সিয়াম বলেন, চারুকলা অনুষদের জন্য নির্ধারিত জায়গায় পরিবেশের বাস্তুতন্ত্র রক্ষার জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। ক্যাম্পাসের সব থেকে জীববৈচিত্র্যপূর্ণ লেকটি অবস্থিত ওই জায়গায়। কয়েক শতাধিক গাছ কাটা পড়বে বলে জেনেছি। প্রতিবছরই লেকটির পাড়ে অতিথি পাখিরা আসে। ঠিক এমনই একটা জায়গা যখন কর্তৃপক্ষ নির্ধারণ করে, তখন আসলে তারা চরম অদক্ষতার পরিচয় দেয়। আমরা আসলে ভবনের বিরুদ্ধে না, আমরা চাই ভবন হোক, চারুকলার শিক্ষার্থীদের শ্রেণীকক্ষ সংকট দূর হোক। তবে অবশ্যই তা মাস্টারপ্ল্যান করে করা হোক। আর যদি মাস্টারপ্ল্যান পর্যন্ত অপেক্ষা করতে না পারে তাহলে বিকল্প জায়গায় ভবনটি করতে হবে।
ছাত্র ইউনিয়ন জাবি সংসদের একাংশের সভাপতি আলিফ মাহমুদ বলেন, পরিবেশ-বিজ্ঞানিরা বলছে ওই জলাশয়ের পাড়ে বহুতল ভবন নির্মাণ হলের পাখির ফ্লাইট জোন নষ্ট হয়ে যাবে। সেক্ষেত্রে পাখি কোনোভাবেই আসবে না। এর পাশে একটি একতলা টিনশেড ভবন আছে। সেসময় পাখির কথা চিন্তা করেই সেখানে বহুতল ভবন করা হয়নি। যাতে গাছ দিয়ে টিনশেড ঢাকা পড়ে যায়। কিন্তু এসব আমলে নেওয়া হচ্ছে না। এখানে বাস্তুতন্ত্রের জন্য সংবেদনশীল জায়গায় ভবন নির্মাণ হলেও ইআইএ করা হয়নি। এটি এক ধরনের প্রতারণা যা মেনে নেওয়া যায় না। এর আগেও সিন্ডিকেটে সিদ্ধান্ত মোতাবেক উপাচার্য জাবির সুন্দরবন নামে খ্যাত আইবিএ ভবনের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করলেও শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের তোপে স্থান পরিবর্তনে প্রশাসন বাধ্য হয়েছে। আমরা চাই মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন করে ভবন নির্মাণ করা হোক।
পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ আমির হোসেন ভূঁইয়া বলেন, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের জায়গা নির্ধারণ করা হয়েছিল মূলত প্রাকৃতিক সৌন্দর্যকে বিবেচনা করেই। এখানে যতগুলো লেক আছে সেগুলা হলো তার সৌন্দর্যের অন্যতম বাহক। নব্বইয়ের দশকে লেকের পাড়গুলোতে এবং যে সমস্ত জায়গায় টিলা রয়েছে সেখানে বৃক্ষরোপণ কর্মসূচি গ্রহণ করা হয়েছিল। একটা ‘গ্রিন জোন’ তৈরি করা হয়েছিল। যার কারণে প্রাণ-প্রকৃতি আরো বৈচিত্র্যপূর্ণ হয়ে উঠেছিল। বিশ্ববিদ্যালয়ের সব শিক্ষক-শিক্ষার্থী চেষ্টা করেছে বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশকে রক্ষা করে একাডেমিক কার্যক্রম পরিচালনা করার। কিন্তু সম্প্রতি অধিকতরে উন্নয়ন প্রকল্পে গাছপালা কেটে ও জলাশয় ভরাট করে খেয়াল খুশি মতো ভবন নির্মাণ করে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণপ্রকৃতি ও জীববৈচিত্র্য নষ্ট করা হচ্ছে। এখানে মাস্টারপ্লানকে বিবেচনায় আনা হয়নি। বর্তমানে যেখানে চারুকলা ভবন তৈরি করা হচ্ছে সেখানে ভবন নির্মাণ একেবারেই অনুচিত। এটাই ছিল আমাদের প্রথম জলাধার যেখানে অতিথি পাখি বসত। কাজেই সেখানে আবার কীভাবে পাখি ফিরিয়ে নেওয়া যায়, পাখির জন্য নিরাপদ আশ্রয়স্থল করা যায় সে ব্যবস্থা আমাদের নেওয়া উচিত। এমনই অনেক বিকল্প জায়গা আছে যেখানে তারা ভবন করতে পারবে।
বিশ্ববিদ্যালয়ে সম্প্রতি গঠিত মাস্টারপ্ল্যান প্রণয়ন কমিটির সদস্য সচিব এবং নগর ও অঞ্চল পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক মো. আকতার মাহমুদ ইআইএ নিয়ে বলেন, চারুকলা অনুষদের জন্য নির্ধারিত জায়গা জীববৈচিত্র্য এবং পরিযায়ী পাখির জন্য খুবই গুরুত্বপূর্ণ। এ ধরনের স্থানগুলোতে ভবন নির্মাণের আগে ইআইএ করা বাঞ্ছনীয়। কারণ এই জায়গাকে কেন্দ্র করে জীববৈচিত্র্য ও বাস্তুতন্ত্রের ভারসাম্যতা গড়ে ওঠে। পরিবেশের উপর ভবনটি কিরূপ প্রভাব ফেলবে এটা অবশ্যই চিন্তা করতে হবে। এসব অভিযোগের বিষয়ে চারুকলা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক এমএম ময়েজউদ্দিন বলেন, ‘আমরা অংশীজনের মতামতের ভিত্তিতেই চারুকলা অনুষদের ভবনের জন্য জায়গা নির্ধারণ করেছি। আমাদের ভবনটি জলাশয়ের কোনো ক্ষতি করবে না। ইচ্ছা করলেই আমরা জায়গা পরিবর্তন করতে পারি না, বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্য আমাদের যে জায়গা নির্ধারণ করে দিয়েছে আমরা সেভাবেই নকশা করেছি এবং ডিজাইনটা দাঁড় করিয়েছি। ভবন নির্মাণকালে উৎপন্ন উচ্চ শব্দের কারণে যদি পরিযায়ী পাখির কোনো ক্ষতি হয় তবে আমরা কাজ স্থগিত রাখব। তাছাড়া পরিবেশ কোনো ক্ষতি যাতে না হয় সেভাবেই আমরা কাজ করছি। লেকের পাড়ে ভবন নির্মাণের জন্য এনভায়রনমেন্টাল ইম্প্যাক্ট অ্যাসেসমেন্ট করা হয়েছে বললেও তিনি কোনো রিপোর্ট দেখাতে পারেননি। পরবর্তীতে তিনি ফিজিবিলিটি টেস্ট ছাড়া আর কিছু দেখাতে পারেননি। বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের স্থাপত্যবিদ্যা বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ও সংশ্লিষ্ট ভবনের স্থপতি আলিয়া শাহেদকে মুঠোফোনে একাধিকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি।