পর্যটন উন্নয়নের দোহাই দিয়ে কক্সবাজারকে ইট-পাথরের গিঞ্জি শহরে পরিণত করছে একদল অর্থলোভী। ভবনের পর ভবন করতে ইকোলুজিক্যাল ক্রিটিক্যাল এরিয়া (ইসিএ) আইনও অমান্য করা হচ্ছে। কক্সবাজার সৈকত হতে উপরে ৩০০ মিটারে নতুন কোনো স্থাপনা নির্মাণে ২০১৮ সালে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞা থাকলেও তা মানা হচ্ছে না। ভবন তৈরীতে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) ও জেলা প্রশাসন এবং অন্য প্রতিষ্ঠানের সঠিক অনুমতিও তোয়াক্কা করছেন না অনেক লোভী ব্যবসায়ী।
সূত্র মতে, পরিবেশগত বিবেচনায় কক্সবাজার সমুদ্রসৈকত থেকে টেকনাফ সমুদ্রসৈকতের ১০ হাজার ৪৬৫ হেক্টর এলাকার প্রাণবৈচিত্র্য, নির্মল জলরাশি এবং পরিবেশ-প্রতিবেশ রক্ষায় সরকার ১৯৯৯ সালে এ এলাকাকে প্রতিবেশগত সংকটাপন্ন এলাকা (ইসিএ) ঘোষণা করে। এ নির্দেশনা মতে, কক্সবাজার পৌরসভার নাজিরারটেক থেকে টেকনাফের বদর মোকাম পর্যন্ত ১২০ কিলোমিটার সমুদ্র সৈকত, সৈকতের ঝাউ গাছসমৃদ্ধ ৩০০ মিটার উন্নয়ন নিষিদ্ধ ও ৫০০ মিটার সংরক্ষিত এলাকা। এ এলাকায় সব ধরনের স্থাপনা বা অবকাঠামো নির্মাণ নিষিদ্ধ।
লাবণী পয়েন্টে ২০১৭ সালে সার্কিট হাউজ নির্মাণ প্রকল্পের অধীনে ১০তলা ভবন তৈরির সিদ্ধান্তে বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষ থেকে ছাড়পত্রও দেয়া হয়েছিল। কিন্তু ইসিএ’তে এমন কান্ড হচ্ছে দেখে ওই সময় বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) করা এক রিটের বিপরীতে ‘ডেভেলপমেন্ট প্ল্যান ফর কক্সবাজার টাউন অ্যান্ড সি আপ টু টেকনাফ’ মহাপরিকল্পনা অনুযায়ী জোয়ার ভাটার মধ্যবর্তী লাইন থেকে পৌরসভার প্রথম ৩০০ মিটার ‘নো ডেভেলপমেন্ট জোন’ উল্লেখ করে এ এলাকায় কোনো স্থাপনা নির্মাণ করা যাবে না বলে নির্দেশনা দেন উচ্চ আদালত।
এরপর ইসিএ হিসেবে চিহ্নিত এলাকায় পূর্বে বরাদ্দ পেলেও স্থাপনা নির্মাণ না হওয়া অর্ধশতাধিক প্লটের বরাদ্দ বাতিলের আবেদন করে কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। এর পরিপ্রেক্ষিতে ওইসব বাতিলও করে সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়। পাশাপাশি কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষও (কউক) সৈকত হতে ৩০০ মিটারে কোনো স্থাপনা নির্মাণ থেকে বিরত থাকতে প্রচারণা চালায় সেই সময় (২০১৭-২০১৮ সালে)। বাতিল বলে ঘোষণা হয় পূর্বে নেয়া স্থাপনা নির্মাণ অনুমতিও।
এরপর কলাতলী হতে লাবণী পয়েন্টে কোনো নতুন স্থাপনা উঠার তেমন নজির না থাকলেও চলতি বছরের শুরু হতে এসব এলাকার একাধিক প্লটে দেদারসে নির্মাণকাজ চলছে। প্রশাসনের নির্লিপ্ততায় গত মাস দেড়েক ধরে কলাতলীর তারকা হোটেল ওশান প্যারাডাইস ও ডিভাইন ইকো-রিসোর্টের মাঝখানে খালি জমিতে দিন-রাত সমান তালে নির্মাণকাজ চালাচ্ছেন একদল শ্রমিক। সৈকতের বালিয়াড়ির ১৫০-২০০ ফুট দূরত্বে চারপাশে দেয়াল তোলে ডজনাধিক শ্রমিক বিরামহীন কাজ করছেন। নিচের ব্যাজমেন্ট পাকা করণের পর প্রথম তলা তৈরি করতে পিলার ও ছাদের লোহা বাঁধার কাজ চলছে দ্রুত। এ প্লটে ভবন তৈরির কাজ হচ্ছে দেখে একই লাইনের খালি একাধিক প্লটে স্থাপনা নির্মাণের লক্ষ্যে মাটি ভরাটের কাজ চলানো হচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এতে ইসিএ রক্ষায় উচ্চ আদালতের নির্দেশনা মুখথুবড়ে পড়ছে বলে মনে করছেন পরিবেশবাদীরা।
যে প্লটে নির্মাণকাজ চলছে সেই জমির মালিকের নাম বলতে নারাজ শ্রমিকরা। কাজ তদারক করা প্রকৌশলী নুরুজ্জামান বলেন, কাজের সব কাগজপত্র প্রকল্পের প্রধান তদারককারী প্রকৌশলী মিজানের কাছে। এসব দেখাতে কক্সবাজার শহরের লালদিঘীর উত্তরপাড়ের তার (প্রকৌশলী মিজানের) অফিসে নিয়ে যান তিনি। কাজের বিপরীতে যে কাগজ দেখান, তা ২০১৫ সালে জেলা প্রশাসন ও ২০১৬ সালে গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলীর স্বাক্ষরে অনুমোদন পাওয়া প্লান। নিয়ম মতে কাজ শুরু না করায় আর ২০১৬ সালের শেষ দিকে স্বতন্ত্রভাবে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) কার্যক্রম শুরুর পর আগের অনুমোদনে ভবন তোলা সম্ভব কি না- এমন প্রশ্নে প্রকৌশলী মিজান বলেন, আমরা কউকের অথরাইজ অফিসারের সাথে কথা বলে কাজ করছি।
এ বিষয়ে যাত্রা থেকে তিন মেয়াদে দায়িত্ব পালন করা কউকের সাবেক চেয়ারম্যান লে. কর্নেল ফোরকান আহমেদ বলেন, কউক স্বতন্ত্র যাত্রা না করা পর্যন্ত জেলা প্রশাসক চেয়ারম্যান ও গণপূর্তের নির্বাহী প্রকৌশলী সচিব হিসেবে দায়িত্বপালন করতেন। তখন পৌর এলাকায় কক্সবাজার পৌরসভা থেকে পাওয়া অনুমতিতে ভবন নির্মাণ হয়েছে। পৌরসভা থেকে অনুমতি নিলেও ২০১৬ সালে কউক স্বতন্ত্র কার্যক্রম শুরুর আগ পর্যন্ত যেসব প্লটে নির্মাণকাজ নির্ধারিত পরিমাণ হয়নি, সরেজমিন তদন্তসাপেক্ষে সেসব প্লটের প্ল্যান বাতিল হিসেবে ঘোষণা করা হয়। ২০১৭ সালের পর থেকে নতুন কোনো স্থাপনা করতে গেলে কউক এবং সংশ্লিষ্ট আরো একাধিক প্রতিষ্ঠান হতে অনুমতিপত্র নেয়া বাধ্যতামূলক। তবে, সরকার ও উচ্চ আদালত কর্তৃক ঘোষিত ইসিএতে কোন মতেই অনুমতি দেয়ার সুযোগ কউক বা অন্য প্রতিষ্ঠানের নেই। যে প্লটের কথা আসছে তা তখন খালি থাকায় আগের অনুমোদন বাতিল ও নতুন কোনো অনুমতি পাওয়ার প্রশ্নই আসে না। প্লটের দেয়ালে লেখা রয়েছে, জমির মালিক এলিগেন্স ডেভেলপমেন্ট প্রপার্টিজ লিমিটেডের চেয়ারম্যান আলহাজ এমদাদ উল্লাহ। সেখানে দেয়া মুঠোফোন নম্বরে তার সাথে কথা হয়। তিনি প্রথমে অনুমতি সাপেক্ষে কাজ করছেন বলে দাবি করলেও ২০১৫ ও ২০১৬ সালের অনুমতি হিসেবে অটোবাতিল এবং সৈকতের বালিয়াড়ি হতে ৩০০ মিটারে কোনো স্থাপণা নির্মাণে উচ্চ আদালতের নিষেধাজ্ঞার বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করা হলে বলেন- আমি শুরুতে কিছু কাজ করেছিলাম। পরে আর্থিক অসঙ্গতির কারণে কাজ বন্ধ ছিল, এখন আবার করা হচ্ছে। আমার জায়গা আদালতের নিষেধাজ্ঞায় পড়েনি।
কিন্তু নির্মাণ শ্রমিকরা গত এক মাস ধরে বেইজ খুঁড়ে নতুন নির্মাণকাজ শুরু করেছেন বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছে, এমনটি বলার পর এমদাদ উল্লাহ বলেন, আমরা এরই মধ্যে জেলা প্রশাসক ও কউকের সংশ্লিষ্টদের সাথে বৈঠক করেছি। তাদের সাথে প্রাথমিক কথা হয়েছে, দুয়েক দিনের ভেতর কাজের পারমিশন ফাইনাল হয়ে যাবে উল্লেখ করে, কাজ এগিয়ে নিতে গণমাধ্যমকর্মীদের সহযোগিতা চান তিনি।
উচ্চ আদালতের নির্দেশনাকে বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে ইসিএ এলাকায় বিনা বাধায় রাত-দিনে বহুতল ভবন নির্মাণ চলতে থাকায় ব্যাপক প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়েছে। অভিযোগ উঠছে- অদৃশ্য কারণে কউকের কিছু দায়িত্বশীল বা জেলা প্রশাসনের কেউ নির্মাণ চালিয়ে নিতে সহায়তা দিচ্ছেন।
তবে, কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মুহম্মদ শাহীন ইমরান বলেন, কক্সবাজারে এখন ভবন নির্মাণ করতে হলে কউকের পারমিশন ছাড়া অসম্ভব। আমরা কাউকে বেআইনি সহযোগিতা দেয়ার প্রশ্নই আসে না। এ নামের (এমদাদ) কাউকে আমি চিনি না, ইসিএ এলাকায় ভবন নির্মাণ বিষয়ে কারো সাথে আমার বৈঠক বা কথাও হয়নি।
নীরব সহযোগিতায় ভবন নির্মাণের অভিযোগের বিষয়ে জানতে কক্সবাজার উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (কউক) চেয়ারম্যান কমোডর মোহাম্মদ নুরুল আবছারের হোয়াটসঅ্যাপ নম্বরে সবিশেষ লিখে বার্তা পাঠানো হয়। তিনি এক বাক্যে রিপলেতে লিখেন- ওকে, আই স্যাল লুক ইনটু ইট (ঠিক আছে বিষয়টি আমি দেখব)।
তবে, কউক সচিব মো. আবুল হাসেম গণমাধ্যমককে বলেন, বিষয়টি চেয়ারম্যান স্যারের নলেজে আছে। তিনি যেভাবে নির্দেশনা দেবেন, সেভাবে এগোনো হবে।