ডিসিদের আহ্বায়ক করে তদন্ত কমিটি
সারা দেশের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ হচ্ছে
প্রকাশ : ২৭ জুলাই ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
ফারুক আলম
সরকারি চাকরিতে কোটাপদ্ধতি সংস্কার আন্দোলনকে ঘিরে রাজধানীসহ সারা দেশে ব্যাপক ভাঙচুর, সহিংসতা ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটেছে। তবে বর্তমানে আন্দোলন নিয়ন্ত্রণে আসায় সারা দেশের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ের দিকে নজর দিয়েছে সরকার। সেজন্য জেলা প্রশাসককে (ডিসি) আহ্বায়ক করে জেলায় জেলায় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। এই কমিটি সরকারি গুরুত্বপূর্ণ অবকাঠামো, স্থাপনা ও যানবাহনসহ সব ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করবে।
মন্ত্রিপরিষদের সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, কোটা পদ্ধতি সংস্কার আন্দোলনে রাষ্ট্রীয় নানা গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনার পাশাপাশি বেসরকারি স্থাপনারও ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে। এসব ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ণয়ে ডিসিদের তাগাদা দেওয়া হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ করে একটি তালিকার হার্ডকপি ও সফটকপি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠাতে বলা হয়েছে।
মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের মাঠপ্রশাসন সমন্বয় অধিশাখার উপসচিব মো. মামুন স্বাক্ষরিত চিঠিতে বলা হয়, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের নামে সহিংসতায় বিভিন্ন জেলায় ১৭ জুলাই থেকে এপর্যন্ত দুষ্কৃতকারীকর্তৃক ক্ষতিগ্রস্ত সরকারি অবকাঠামো যানবাহন ও অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ প্রযোজ্যক্ষেত্রে ছবিসহ নিম্নোক্ত ছক অনুযায়ী হার্ডকপি ও সফটকপি প্রেরণের জন্য নির্দেশক্রমে অনুরোধ করা হয়েছে। নির্ধারিত ছকে জেলার নাম, প্রতিষ্ঠানের নাম, ক্ষয়ক্ষতির বিবরণ, ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ, ক্ষয়ক্ষতির সম্ভাব্য মূল্য, মন্তব্য প্রেরণের জন্য উল্লেখ করা হয়।
জানা গেছে, কোটা পদ্ধতি সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে দেশব্যাপী ব্যাপক পরিসরে ধ্বংসযজ্ঞ চালানো হয়। ক্ষয়ক্ষতি নিরূপণ কমিটিতে জেলা প্রশাসক আহ্বায়ক ও সদস্যসচিব উপ-পরিচালক (ত্রাণ ও পুনর্বাসন)। কমিটির সদস্য হিসেবে থাকবেন, জেলা পুলিশ সুপার (এসপি), নির্বাহী প্রকৌশলী (সড়ক ও জনপথ), নির্বাহী প্রকৌশলী (গণপূর্ত), নির্বাহী প্রকৌশলী (এলজিডি), নির্বাহী প্রকৌশলী (বিআরটিএ), উপ-পরিচালক-সহকারী পরিচালক (বিআরটিএ), উপ-পরিচালক-সহকারী পরিচালক (ফায়ার সার্ভিস)।
জেলা প্রশাসক ছাড়াও এরইমধ্যে সরকারি বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নিরূপণ করতে নিজেরা তদন্ত কমিটি গঠন করেছে। তেমনি রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। তদন্ত কমিটি বলছে, কোটা সংস্কার আন্দোলনের সময় ভাঙচুর করা হয়েছে রেলের ইঞ্জিন ও কোচ। পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন ট্রেনের বগি। ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে রেলপথ। সব মিলিয়ে রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের ক্ষতির পরিমাণ ২১ কোটি ৭০ লাখ টাকা। রেলওয়ের উচ্চপর্যায়ের এক তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন থেকে এ তথ্য জানা গেছে।
রেলওয়ের পূর্বাঞ্চলের দপ্তর প্রধানদের নিয়ে গঠিত কমিটি প্রতিবেদনে বলেছে, দুষ্কৃতকারীরা রেলের এই ক্ষয়ক্ষতি করেছে। প্রধান সংকেত ও টেলিযোগাযোগ প্রকৌশলী সুশীল কুমার হালদার কমিটির প্রধান। তিনি বলেন, সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে বাণিজ্যিক বিভাগের, এরপর যান্ত্রিক বিভাগের।
কমিটির প্রতিবেদন অনুযায়ী, চারটি ট্রেনের ৪০টি কোচ ভাঙচুর ও পুড়িয়ে দেওয়া হয়। সোনার বাংলা এক্সপ্রেস ট্রেনের ৭টি, চট্টলা এক্সপ্রেসের ১৩টি, জামালপুর এক্সপ্রেসের ৬টি, পারাবত এক্সপ্রেসের ৮টি ও কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেসের ২টি বগি ভাঙচুর করা হয়। কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেসের চারটি বগি পুরোপুরি পুড়িয়ে দেওয়া হয়। এ ছাড়া চট্টলা এক্সপ্রেস, কিশোরগঞ্জ এক্সপ্রেস ও কর্ণফুলী কমিউটারের ইঞ্জিন ভাঙচুর করা হয়। রেলওয়ে সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ট্রেন চলাচল বন্ধ থাকায়। ১৮ থেকে ২৩ জুলাই বিভিন্ন গন্তব্যে ট্রেন চলাচল না করায় যাত্রীদের টিকিটের টাকা ফেরত দিতে হবে। এর পরিমাণ ১৬ কোটি ২৮ লাখ টাকা। তদন্ত প্রতিবেদনের তথ্য অনুযায়ী, পূর্বাঞ্চলের আওতায় ঢাকা বিভাগের যাত্রীদের ফেরত দিতে হবে ১১ কোটি ৭০ লাখ টাকা এবং চট্টগ্রাম বিভাগের যাত্রীদের ফেরত দিতে হবে ৪ কোটি ৫৮ লাখ টাকা।
এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে মাদারীপুরে দুই দিনে নাশকতাকারীদের তাণ্ডবে ৪০ কোটি টাকার ক্ষয়ক্ষতি হয়েছে বলে তদন্ত কমিটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। গত বুধবার জেলা প্রশাসনের গঠিন তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন হাতে পেয়ে এ তথ্য জানিয়েছেন অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মো. নাজমুল ইসলাম। তিনি জানান, গত বৃহস্পতি ও শুক্রবার (১৮ ও ১৯ জুলাই) এই দুই দিন কোটা সংস্কারের আন্দোলনে একদল দুর্বৃত্ত ঢুকে পড়ে। এসময় তারা জেলা প্রশাসকের কার্যালয়, আওয়ামী লীগ কার্যালয়, ট্রাফিক পুলিশ বক্স, বাস কাউন্ডার ও মুক্তিযোদ্ধা সংসদে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। তারা তেলের পাম্প, সার্বিক বাস ডিপো, পুলিশ ফাঁড়ি ও পৌর মুক্তিযোদ্ধা কমিউনিটি সেন্টারে আগুন দিয়ে সব পুড়িয়ে ফেলে। তাদের আগুনে পোড়ে অন্তত ৩২টি বিলাসবহুল বাসও। পরে এই ঘটনায় শনিবার জেলা প্রশাসন থেকে তিন সদস্যদের তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়। কমিটির প্রধান করা হয় গণপূর্ত বিভাগের নির্বাহী প্রকৌশলী শাহরিয়ার রহমানকে। বাকি দুই সদস্য হলেন- এলজিইডির নির্বাহী প্রকৌশলী বাদল চন্দ্র কীর্ত্তনীয়া, বিআরটিএর সহকারী পরিচালক মো. নুর হোসেন। ঘটনাস্থল পরিদর্শন ও ক্ষতিগ্রস্তদের সঙ্গে কথা বলে মঙ্গলবার রাতে ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ উল্লেখ করে প্রতিবেদন জমা দেন।
উল্লেখ্য, যাত্রাবাড়ী মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের টোলপ্লাজা, এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ের বনানী ও মহাখালী টোলপ্লাজা, বাংলাদেশ টেলিভিশন (বিটিভি) ভবন, সেতু ভবন, মেট্রোরেলের স্টেশন, বিআরটিএ ভবন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরসহ মিরপুর ফায়ার সার্ভিস স্টেশনের গাড়ি আগুনে পোড়ানো হয়। তাণ্ডবের শিকার হয়েছে ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের আঞ্চলিক কার্যালয়, মিরপুরের ইনডোর স্টেডিয়াম, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবন, নারায়ণগঞ্জে আঞ্চলিক পাসপোর্ট অফিস ও সিটি কর্পোরেশনের নগর ভবন। সেতু বিভাগের ৫৫টি গাড়ি সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। ঢাকা উত্তর সিটি কর্পোরেশনের কয়েকটি আঞ্চলিক কার্যালয়ে হামলা চালিয়ে ৩০টি গাড়িতে আগুন দেওয়া হয়, ভাঙচুর করা হয় ১৭টি গাড়ি। মশার ওষুধ ছিটানোর স্প্রে মেশিন, মশার ওষুধ নষ্ট করা হয়, তুলে নেওয়া হয়েছে সড়কবাতি। হামলায় ডিএনসিসির প্রায় ২০৫ কোটি টাকার ক্ষতি হয়েছে বলে জানিয়েছেন মেয়র মো. আতিকুল ইসলাম। হামলাকারীরা মহাখালীর দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ভবনে ৫৩টি গাড়ি ও ১৬টি মোটরসাইকেল সম্পূর্ণ পুড়ে গেছে। ভবনের বৈদ্যুতিক সাবস্টেশন, সার্ভার, ইমার্জেন্সি রেসপন্স কো-অর্ডিনেশন সেন্টার, অফিসের যন্ত্রপাতিও নষ্ট হয়েছে। মেট্রোরেলের মিরপুর-১০ ও কাজীপাড়া স্টেশনে বড় ধরনের নাশকতা চালিয়েছে হামলাকারীরা। টিকিট বিক্রির মেশিন, কম্পিউটার, প্রিন্টার, সময়সূচির মনিটর, ভেঙে ফেলা হয়েছে।
ঢাকা মহানগর পুলিশ জানিয়েছে, আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে গুলশানে ট্রাফিক উপ-কমিশনারের অফিস। এসি রমনা, রামপুরা, মহাখালী ও উত্তরা অফিস পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে। পুরো ঢাকা শহরে মোট ৫৪টি ট্রাফিক পুলিশ বক্স পুড়িয়ে দেয়া হয়েছে।