কোটা সংস্কার আন্দোলন মামলা

কক্সবাজারে বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে ঘরছাড়া আ.লীগ ঘরনার লোক

আ.লীগ-ছাত্রলীগের মামলা নিয়ে বিব্রত পুলিশ

প্রকাশ : ০২ আগস্ট ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার

কোটা সংস্কার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কক্সবাজারে আওয়ামী লীগ অফিস ভাঙচুর ও ছাত্রলীগ নেতাকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগ মামলা হয়েছে। জেলায় মোট সাতটি মামলার ৪টি অজ্ঞাত হলেও বাকি ৩টি মামলার এজাহার নামীয় আসামি ৩ শতাধিক। জাসদ দায়েরকৃত মামলায় আসামিদের সবাই ছাত্র হলেও আওয়ামী লীগ ও ছাত্রলীগের মামলা নিয়ে নানা প্রশ্নের সৃষ্টি হয়েছে। নাশকতার এসব মামলায় বিএনপি-জামায়াত ও শিবির নেতাকর্মীদের সঙ্গে আসামি করা হয়েছে আওয়ামী পরিবারের লোকজনকেও। বিশেষ করে কক্সবাজার হোটেল শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক এনামুল কবিরকেও ছাত্রলীগের দায়েরকৃত মামলায় এজাহারনামীয় আসামি করা হয়েছে। তার দাবি, নাশকতার বিরুদ্ধে রাজপথে থেকেও ছাত্রলীগের মামলায় ব্যক্তিগত আক্রোশের জেরে আসামি করা হয়েছে তাকে।

তাছাড়া কক্সবাজার শহরে বিএনপি-জামায়াতের দুর্গ খ্যাত পৌরসভার ৭নং ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আজিজুল হকের একমাত্র উপার্জনক্ষম ছেলে এমরান ফারুক অনিককেও আসামি করা হয়েছে নাশকতার মামলায়। উন্নয়ন ইন্টারন্যাশনাল নামক ঠিকাদারি ফার্মের আইটি অফিসার হিসেবে চাকরি করেন তিনি। এজাহারে উল্লেখিত সময়ে অনিক তার কর্মস্থলেই ছিলেন।

এছাড়া এই দুই মামলায় আ.লীগ ঘরনার মানুষ, দিনমজুর ও অন্তঃসত্ত্বা এক নারীকেও আসামি করা হয়েছে। যার দরুন বিএনপি-জামায়াতের সঙ্গে ঘরছাড়া আ.লীগ ঘরনার অনেকেই। মামলার ১৭নং আসামি মো. এনাম কক্সবাজার জেলা শ্রমিক লীগের সাধারণ সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিব রহমানের আস্থাভাজন হিসেবে পরিচিত। ৮০নং আসামি গোল হোসেন পেশায় একজন টমটম চালক। মামলার ৭৭নং আসামি আনোয়ার প্রকাশ আল নুর জেলা ছাত্রলীগের সাবেক এক সাধারণ সম্পাদকের আত্মীয় এবং একজন কর্মজীবী। তাছাড়া মামলার ১০২ নং আসামি শাহরিয়ার পারভেজ একটি হোটেলের রিসিপশনিস্ট হিসেবে কর্মরত এবং তিনি কক্সবাজার জেলা দলের ফুটবল খেলোয়াড় ছিলেন।

এদিকে ইচ্ছেমতো আসামি করা নিয়ে এরইমধ্যে ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন জেলা আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতারা। আওয়ামী লীগের শীর্ষ নেতাদের পাশাপাশি বিব্রত পুলিশ কর্মকর্তারাও। মামলার তদন্তে গিয়ে রীতিমতো হাপিয়ে উঠছে পুলিশ। এজাহারে আসামির পূর্ণাঙ্গ পরিচয় না থাকা, ঘটনার সময় অন্যত্রে অবস্থান ও ব্যক্তিগত বিরোধের জেরে মামলায় অনেককেই আসামি করার প্রমাণও মিলছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা।

অন্তঃসত্ত্বা নারী আসামি

ছাত্রলীগের দায়ের করা মামলায় নওশাবা সিয়াম নামের ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা এক নারীকে আসামি করা হয়েছে। নওশাবা কক্সবাজার সদর উপজেলার পিএমখালী এলাকার মুক্তার আহমেদের মেয়ে। তার নানা আব্দুল হক সিকদার একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা বলে জানান তিনি।

নওশাবা সিয়াম বলেন, আমি ৮ মাসের অন্তঃসত্ত্বা। গত ৩ জুলাই আমি কক্সবাজার থেকে ট্রেনযোগে ঢাকা রওনা দেই। অর্থাৎ এজাহারে উল্লেখিত ঘটনার ১২ দিন আগে থেকে তিনি ঢাকায় তার শ্বশুরবাড়িতে অবস্থান করছি। আমার গ্রামের বাড়ি (কক্সবাজার) থেকে খবর আসে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন চলাকালে কক্সবাজার আওয়ামী লীগের কার্যালয়ে এক ছাত্রলীগ নেতাকে হত্যাচেষ্টার মামলায় আমাকে ৯৬ নম্বর আসামি করা হয়েছে। এটি শুনে আমার মাথায় আকাশ ভেঙে পড়ে। দিশাহারা হয়ে গেলাম। অথচ ঘটনার ১২ দিন আগে থেকে আমি ঢাকায়।

নওশাবা বলেন, আমার কাছে ট্রেনের টিকিট আছে। এরপর থেকে ঢাকার বিভিন্ন হাসপাতালে চিকিৎসা নিচ্ছি। তারিখসহ চিকিৎসকের শরণাপন্ন হয়েছি এমন প্রেসক্রিপশনও আছে। মামলায় উল্লেখিত ঘটনার দিন আমি মিরপুর-১ মাতৃসদন থেকে টিকা নিয়েছি তার তারিখ সম্বলিত কার্ডও আছে।

তাছাড়া আমার ট্রেনের টিকিট, মোবাইল নাম্বারের লোকেশন ও সিডিআর চেক করলে পুলিশ সঠিক বিষয়টি জানতে পারবে এবং আমার ডাক্তারের রিপোর্টও দেখতে পারবে। একজন নির্দোষ গর্ভবতী নারীকে কেন মিথ্যা মামলায় জড়ানো হয়েছে সে চিন্তায় আমি দিন দিন অসুস্থ হয়ে যাচ্ছি। আমি এমন মিথ্যা মামলা থেকে মুক্তি চাই, আমি বাঁচতে চাই।

এমরান ফারুক অনিক তার ফেইসবুক ওয়ালে যা লিখেছেন

লেখালেখি করাটা আমার শখ, সেই ২০০৫ সাল থেকে পত্রিকা দিয়ে শুরু; এখন একটি জীবনী পৃথিবীর বুকে প্রসবের অপেক্ষায়! লেখালেখি করাটা এখন অভ্যেসে পরিণত হয়েছে! এই লেখালেখিতে আবার অনেকের শরীরের ‘অনুচ্চারিত’ জায়গায় চুলকানি হয়!

আমার লিখনিতে ‘রাষ্ট্রবিরোধিতা’ খুঁজে পান আমাকে অপছন্দ করা লোকগুলো, অথচ আমি সরকার-সরকারি দল-বিরোধিদলগুলোসহ সবার আলোচনা-সমালোচনা করতে অভ্যস্ত!

আমার লিখনিতে যাদের গাত্রদাহ হয় তাদের বলছিÑ রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধিদের গায়ে গন্ডারের চামড়া হতে হয়, না হলে ওরা রাজনীতিবিদ বা জনপ্রতিনিধি হওয়ার যোগ্যতা হারিয়ে ফেলেন!

এই গোষ্ঠী প্রথমে আমাকে দিয়েছে কলঙ্ক, যার শুরুটা হয়েছে মিথ্যা মামলায় আসামি করে! ঘটনার সময় আমার কর্মস্থল উন্নয়ন ইন্টারন্যাশনাল এর কার্যালয়ে কর্মব্যস্ত, যার সিসিটিভি ফুটেজ এরইমধ্যে কক্সবাজারের পুলিশ প্রশাসনসহ গোয়েন্দা সংস্থার হাতে স্বউদ্যোগে বা অতিপ্রিয় শুভাকাক্সক্ষী মারফত পৌঁছানো হয়েছে। এরপর মানসিকভাবে আঘাত করা শুরু করেছে আমার পরিবার-পরিজনকে। তাতেও পেরে ওঠেনি, আল্লাহর অশেষ রহমতে। এখন আমার জীবিকায় আঘাত করছে! কান ভারি করা শুরু করেছে আমার শ্রদ্ধাভাজনদের, আর এতেই আমি ক্ষান্ত! আল্লাহ তুমি সাক্ষী ও সর্বশ্রেষ্ঠ বিচারক। আমার লিখনি ছিল মজলুমের পক্ষে, অন্যায়ের বিপক্ষে। আমার লিখনি অপছন্দকারিদের বলছিÑ তুমিও মানুষ আমিও মানুষ, তফাৎ শুধু শিরদাঁড়ায়! বিদায় লেখালেখি! এ ব্যাপারে মামলার বাদী রাজিবুল ইসলাম মোস্তাক সাংবাদিকদের বলেন, ‘ঘটনায় উপস্থিত না থেকেও ইন্ধনের কারণে অনেক কিছু হয়ে যেতে পারে। এই আসামির ফেসবুক প্রোফাইল ঘুরে আসলে বুঝা যাবে তিনি কেমন প্রকৃতির লোক। বিভিন্ন উসকানি ও সরকারবিরোধী পোস্টে ভরা তার ফেসবুক প্রোফাইল।’

তিনি আরো বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন তোমরা যারা মুক্তিযোদ্ধার কোটা নিয়ে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ভর্তি হয়েছ, তারা ভর্তি বাতিল করে আন্দোলন করো। অথচ এই আসামি মুক্তিযোদ্ধার নাতি বলে দাবি করছে। যদি মুক্তিযোদ্ধার নাতি হয়ে থাকে, তবে কেন সে কোটাবিরোধী আন্দোলনকে সমর্থন করল? তার অনলাইন ও মোবাইলে ইন্ধন, অপ-প্রচারসহ সরকারবিরোধী ও উসকানিমূলক ফেসবুক পোস্ট দেখলে বুঝা যাবে তাকে কেন আসামি করা হয়েছে। কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রকিবুজ্জামান বলেন, ছাত্রলীগ নেতা বাদী হয়ে এজাহার দিয়েছেন। সংশ্লিষ্ট কাগজপত্র দেখে এজাহারের সব কলাম পূরণ পূর্বক এজাহার গ্রহণ করেছি। অনেক আসামির পরিচয় সম্পর্কে আমরা অবগত নয়। তবে সুষ্ঠু তদন্ত করে চার্জশিট দেওয়া হবে।কক্সবাজারের পুলিশ সুপার মো. মাহফুজুল ইসলাম বলেন, কক্সবাজার শহরে সহিংসতার ঘটনায় কোনো নিরপরাধ ব্যক্তি যেন হয়রানি না হয়, সেদিকে সজাগ দৃষ্টি রাখবে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। এছাড়া ঘটনায় জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের খুঁজে বের করে দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির ব্যবস্থা করা হবে।

প্রসঙ্গত : কোটা আন্দোলনের শুরুতে কক্সবাজারের সার্বিক পরিস্থিতি শান্ত ছিল ও স্বাভাবিক ছিল। কিন্তু ১৬ জুলাই বেলা ১১টার দিকে মিছিল করে কক্সবাজার-চট্টগ্রাম সড়কের লিংকরোড এলাকায় অবস্থান নেয় কক্সবাজার পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের শিক্ষার্থীরা। এরপর থেকে পর্যটন শহরে কোটা সংস্কারের দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে কক্সবাজারের বিভিন্ন জায়গায় হামলা, ভাঙচুর ও ছাত্রলীগের ৪ নেতাদের মারধরের ঘটনায় এ পর্যন্ত ৭টি মামলায় ৬৪ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে।