ঢাকা ২০ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৫ আশ্বিন ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

অর্থ ছাড়া মেলে না সেবা কুড়িগ্রাম সমাজসেবা কার্যালয়ে

অর্থ ছাড়া মেলে না সেবা কুড়িগ্রাম সমাজসেবা কার্যালয়ে

অর্থ ছাড়া কোনো সেবাই যেন মেলে না কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা সমাজসেবা অফিসে। শিক্ষা উপবৃত্তি, বয়স্ক, প্রতিবন্ধী এবং বিধবা ভাতার আওতায় না পড়েও টাকার বিনিময়ে অথবা স্বজনপ্রীতির মাধমে অনেকেই সুবিধা গ্রহণ করছেন। একই কর্মস্থলে দীর্ঘদিন ধরে অবস্থান করে স্থানীয় কর্মকর্তা ও কর্মচারী এবং স্থানীয় জনপ্রতিনিধিদের নিয়ে গড়া সিন্ডিকেট চক্রের হাতে জিম্মি কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা সমাজসেবা অফিস। অনুসন্ধানে দেখা যায়, কুড়িগ্রাম সদর উপজেলা সমাজসেবা অফিসের কতিপয় কর্মকর্তা এসএম হাবিবুর রহমান ২০০৯ সাল থেকে এবং ফিল্ড অফিসার সুপারভাইজার রিয়াসাদ আজিম জীম, ইউনিয়ন সমাজকর্মী শহীদুর রহমান, শিউলি বেগমসহ কয়েকজন কর্মচারী দীর্ঘদিন ধরে একই কর্মস্থলে অবস্থান করছে। তাদের ছত্রছায়ায় স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, গ্রাম পুলিশদের নিয়ে গড়ে উঠেছে একটি শক্তিশালী সিন্ডিকেট চক্র। এই সিন্ডিকেট চক্রের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে সদর উপজেলার বয়স্ক, প্রতিবন্ধী, বিধবা ভাতা সুবিধাভোগীর তালিকা। সিন্ডিকেট চক্রের মাধ্যমে নিয়ন্ত্রিত হওয়ায় নানা ভোগান্তিতে পড়তে হচ্ছে সুবিধাভোগীদের। সিন্ডিকেট চক্রের সদস্য হলোখানা ইউনিয়নের সমাজকর্মী শিউলি বেগমের আত্মীয় হওয়ার সুবাদে প্রতিবন্ধী না হয়েও প্রতিবন্ধী ভাতা তোলেন সদর উপজেলার হলোখানা ইউনিয়নের উদ্যোক্তা সাইদুর রহমান।

যার উপকারভোগী নং-০৩৪৯০০৪১০৯৪। সাইদুর রহমানের মা সাহিদা বেগমণ্ড০৩৪৯০০৩৯৪২৪, পিতা আবুল হোসেন-০৩৪৯০০৩৯৪১৯, ফুফু আম্বিয়া খাতুন-০৩৪৯০০৩৮৭১৬। এছাড়াও প্রতিবন্ধী না হয়েও বিপুল মিয়া-০৩৪৯০০৪১৫৭৯, হাছেন আলী-০৩৪৯০০৩৮৭০১, হায়দার আলী-৩৪৯০০১৬৪৯৩ সুবিধা ভোগ করছেন। সদর উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নের মরাটারি ছত্রপুর গ্রামের বাসিন্দা শ্রমিক মেহের জামাল ও আছমা বেগম দম্পতির ছেলে নয় বছরের শিশু আবু আজাদ শারীরিক প্রতিবন্ধী। প্রায় দুই বছর আগে প্রতিবন্ধী ভাতার জন্য আবেদন করে পরিবারটি। পেয়েও যায় ২০১৫৪৯১৫২৮৫১০৭৮৭৭-০২নং একটি প্রতিবন্ধী কার্ড। এই কার্ড ইস্যু করা হয় ২০২২ সালের ২৭ আগস্ট। কিন্তু এই কার্ড জুটলেও ভাতার টাকা আজও জোটেনি শিশুটির ভাগ্যে। এই বিষয়ে একাধিকবার সমাজসেবা অফিসে যোগাযোগ করেও মেলেনি কোনো সুরহা। উল্টো সমাজসেবা অফিস তার নিকট থেকে নাম্বার পরিবর্তনের একটি আবেদন জমা নেন চলতি বছরের জুন মাসে। অথচ দীর্ঘদিন ধরে অন্য নাম্বারে টাকা গেলেও পরিবারটিকে সেই নাম্বার দেয়া হয়নি। পাশের ঘোগাদহ ইউনিয়নের হাজিরকুটি গ্রামের অসুস্থ বয়বৃদ্ধ রুপভান বেওয়া। তার ৪৯১৫২২৮২৪৬৩১৭নং-এ দুইবার ভাতা পেলেও তিন বছর ধরে তার প্রতিবন্ধী ভাতা বন্ধ রয়েছে। এখন অসহায় অবস্থায় খেয়ে না খেয়ে দিনাপাতিত করতে হচ্ছে বৃদ্ধা রুপভান বেওয়াকে। পরিবারের সদস্যরা মেম্বার, চেয়ারম্যান এবং সমাজসেবা অফিস গিয়েও আজও চালু করতে পারেনি এই বৃদ্ধার প্রতিবন্ধী ভাতা। বিধবা, প্রতিবন্ধী ভাতার তালিকাতেও রয়েছে গড়মিল। নাম, ঠিকানা সব ঠিক থাকলেও ঠিক নেই শুধু মোবাইল নাম্বার। এমন অসংখ্য মোবাইল নাম্বার পরিবর্তন করে মোটা অঙ্কের টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সিন্ডিকেট চক্রের সদস্যরা। অথচ সুবিধাভোগীরা কিছুই জানেন না। সদর উপজেলার পাঁচগাছি ইউনিয়নের ০৩৪৯০০৩৩১৮৪নং-এর মৃত শহিদুল ইসলাম। প্রায় এক বছর আগে মারা গেলেও প্রতিবন্ধী ভাতা তালিকা থেকে তার নাম কর্তন হয়নি। শুধুমাত্র ভাতা পাওয়া মোবাইল নাম্বার পরিবর্তন করে অন্য কেউ টাকা তুলে নিচ্ছেন। এরমধ্যে উল্লেখ্যযোগ্য, মোস্তনা খাতুন ভাতাভোগী নং-০৩৪৯০০৪০৭১৬, নুরমিনা খাতুন-২১৫৬৬, হাবিব-৩৭৬৭০, সফিকুল-২২৯৭৯, গণি মিয়া-৩৮৯৮১, রবিয়াল হক-৩৯০৬৫, গুলজান বিবি-২৩৫৮৬, আমেনা খাতুন- ৩৯৯৮২, খাদিজা বিবি-৪৫১৯৬, মতিয়ার রহমান-৩৯০৮২, ছপুরা পাগলী-৪০৩৭৮, সমশের আলী ২১৪৪৯, রুপভান বিবি-২৭৩৮৪, আবেয়া পাগলী-২১৯৬৬, শহিদুল ইসলামণ্ড৩৩১৮৪, মাছিমন-২২৬২১, রশেদা-৩৫৮৪৯, ছলিমা-৩২৫৯৭, আফরোজা-৩৪৪১৪১, তাজনিন আক্তার-২৪৩১২, কাছিরন বেগমণ্ড২২৮৫৭, ময়ফুল-৩৯০৪৮, মারুফা আক্তার-৩৯০৮৭, লুৎফা বেগমণ্ড৪১২৩১, জোসনা বেগমণ্ড৪০০২৬, মোহাম্মদ আলী-৩৯০৫০, সুমি খাতুন-১৫৯৮০, আজাদণ্ড৭৫৬৫৫, বালিজন-২২৮৬১, এনামুল হক-৩৮৯৬১, ছালেমা-৬৮২৫১, রাহেনা-৪০৯৮৪, হাছেন আলী-৫১১৩৭, উপিজন-৭৫৭৫৩, সানাউল্লা-৭৫৩৮৮, বাসন্তি-৭৫৩৬৮, অলোকা রানী-৬৩২৯৮। গত ২০২৩-২৪ অর্থবছরে উপজেলা সমাজসেবা কর্মকর্তা এসএম হাবিবুর রহমান স্বাক্ষরিত ইউনিয়ন পরিষদে পাঠানো চিঠিতে দেখা যায়, সেখানে শুধু বয়স্ক ও বিধবা ভাতার তালিকা চাওয়া হয়েছে। প্রতিবন্ধী ভাতার কোনো তালিকা চাওয়া হয়নি। কারণ খুঁজতে পাওয়া যায় চমকপ্রদ তথ্য। উপজেলায় প্রতিবন্ধী ভাতার জন্য বরাদ্দও ছিলো-১২৩৯টি। এরমধ্যে চেয়ারম্যানরা প্রতিস্থাপনের জন্য পাঠানো তালিকায় আবেদনকৃতদের নাম দিয়েছেন, হলোখানা ইউপি-৩৭টি, বেলগাছা-৪৯টি, মোগলবাসা-২৮টি, যাত্রাপুর-২৪টি, পাঁচগাছি-১৭টি, ঘোগাদহ-২৩টি এবং ভোগডাঙ্গা-২২টি। সিন্ডিকেট চক্র আবেদনের সময় শেষ হয়ে গেলেও অন্তত এই ২৩০টি ভাতা নিজেরা বিক্রি করেন। এই ২৩০ জনের মধ্যে আবার বেশিরভাগই টাকা পায়নি বা ভাতাভোগীর সঠিক বিকাশ নম্বর দেয়া হয়নি। আরো দেখা যায়, কাঁঠালবাড়ী ইউনিয়নে প্রতিবন্ধী ভাতাভোগী নম্বর-০৩৪৯০০৮০১৬৬ থেকে ০৩৪৯০০৮৬৯৪৬ এরমধ্যে ৩৮টি এবং হলোখানা ইউনিয়নে উপকারভোগী নম্বর-০৩৪৯০০৮৫১৩৯ থেকে ০৩৪৯০০৮৬৭৫৫-এর মধ্যে ৪৩টি, দুই ইউনিয়নে মোট ৮১টি ভাতাভোগী আবেদন না করেও চূড়ান্ত তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। এদের অনেকের প্রতিবন্ধী কার্ড নেই, অফিসে আটকিয়ে রাখা হয়েছে। অনেকেই জানে না তাদের নামে ভাতা হয়েছে। এই না জানা ব্যক্তিদের নিকট দুই থেকে পাঁচ হাজার টাকা নিয়ে ভাতা করে দেবার কথা বলে বিকাশ নম্বরটি সঠিক করে দেয়া হচ্ছে। নাম প্রকাশ্যে অনিচ্ছুক একাধিক সুবিধাভোগী জানান, শহীদুর রহমান ইউনিয়ন সমাজকর্মী পদে চাকরি হলেও তিনি অফিসারের আস্থাভাজন হওয়ায় তিনি সমাজসেবা অফিসেই কাজ করেন। টাকা ছাড়া তার নিকট থেকে কোনো কার্ড পাওয়া যায় না। প্রতিটি কার্ডের জন্য ৩০০ টাকা হতে পাঁচ হাজার করে টাকা নেন। আর জীম কম্পিউটারে কাজ করেন। অথচ সে নিজেও একজন প্রতিবন্ধী হয়েও ভাতা করে দেয়া এবং মোবাইল নাম্বার পরিবর্তন করার জন্য টাকা নেন। মাঠ পর্যায় এদের লোক রয়েছে। তাদের ছাড়া কোনো ভাতা পাওয়া যায় না। পরিবারের ৪ সদস্য প্রতিবন্ধী হবার কথা স্বীকার করে উদ্যোক্তা সাইদুর রহমান বলেন, আমার বাম হাতের ব্যাথার কারণে প্রতিবন্ধী হয়েছি। ভাতাও পেয়েছি বেশ কয়েকবার। আমার মা চোখে কম দেখে এবং বাবা অচল আর ফুফু পা বাঁকা করে হাঁটে। এজন্য আমার দূরসম্পর্কের বোন শিউলি বেগমের মাধ্যমে প্রতিবন্ধী ভাতা পেয়েছি। এখনো কাগজপত্র তার কাছে রয়েছে। বর্তমানে ভাতা বন্ধ রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি। সাইদুর রহমানের মা সাহিদা বেগম বলেন, আমার ছেলে প্রতিবন্ধী নয় এবং স্বামী ও আমি দুজনে অসুস্থ। তাই বেশ কয়েকবার প্রতিবন্ধী ভাতা পেয়েছি। হায়দার আলী বলেন, আমার বয়স হয়েছে। ভারি কাজ করতে পারি না। হাঁটুতে ব্যথা হবার কারণে জামাইকে দিয়ে দু’হাজার টাকা অফিসে খরচ করে প্রতিবন্ধী তালিকায় নাম তুলেছি। কিন্তু এখনো কোনো টাকা বা কার্ড পাইনি।

মেহের জামাল বলেন, আমার ছেলে শারীরিক প্রতিবন্ধী। কিন্তু দু’বছর থেকে উপজেলা সমাজসেবা অফিস ঘুরেও টাকা পাচ্ছি না। এক বছর আগে প্রতিবন্ধী কার্ড পেয়েছি। অনলাইন আবেদনে ২৩৩৯নং মোবাইল নাম্বার দিয়েছি। কিন্তু শুনেছি সেই নাম্বার বদলে ৯৯৭৪ নাম্বারে টাকা যাচ্ছে। সেজন্য কম্পিউটারে কাজ করে রিয়াসাদ আজিম জীম স্যারকে বললে তিনি বলেন কোনো নাম্বার দেখানো যাবে না। উল্টো আমার কাছ থেকে মোবাইল নাম্বার পরিবর্তনের জন্য ২৩ জুন একটি আবেদনে টিপ সই নেন। সেখানেও আমার পূর্বে দেয়া মোবাইল নাম্বারটি দিয়েছি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত