বিএনপির সৃষ্টি খাইরু’র

আ.লীগের শাসন আমলের রাজত্বে লাগাম টানতে অবশেষে মামলা

প্রকাশ : ০৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  সাঈদ মুহাম্মদ আনোয়ার, উখিয়া

‘সরকার যেটি আসে আমার তার সঙ্গে থাকতে হবে’ প্রকাশ্যে এমন বক্তব্য দিয়ে নিজের দ্বিচারিতাকে জাহির করেছিলেন কক্সবাজারের উখিয়ার রত্মাপালং ইউনিয়ন পরিষদের সাবেক চেয়ারম্যান খায়রুল আলম চৌধুরী।

দেশের বৃহত্তম রাজনৈতিক দল বিএনপির সঙ্গে শুরু রাজনৈতিক ক্যারিয়ার। উখিয়া উপজেলা শাখার সহ-সভাপতি ও কক্সবাজার জেলা কমিটির সদস্য পদ সামলানোর পাশাপাশি দলটি সরকারে থাকাকালীন তিনি ছিলেন সবচেয়ে প্রভাবশালী ও বিচক্ষণ দাপুটে নেতা। ২০০৫ সালে বিএনপির সরকারের পতনের সঙ্গে সঙ্গে দলটির সঙ্গে সম্পর্ক বিচ্ছেদ ঘটিয়ে স্বৈরাচারী সরকারের শাসনামলে আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে এই মানুষটির ভয়ঙ্কর ক্ষমতার অপব্যবহারের সাক্ষী হয়েছে উখিয়াবাসী। ইয়াবার মাফিয়া খ্যাত সাবেক সংসদ সদস্য আব্দুর রহমান বদির সারাক্ষণ আস্থাভাজন হয়ে দেখা গেছে যার বিচরণ। স্থানীয়দের কাছে বিএনপির ধান চাষ করে আওয়ামী লীগের নৌকাতে চড়ার মতো আচরণের কারণে সময়ের সঙ্গে ভোল পাল্টানো লোক হিসেবে খায়রুল আলম চৌধুরীর অপকর্মের বিরুদ্ধে অবশেষে এবার রুখে দাঁড়াচ্ছেন স্থানীয় ভুক্তভোগীরা। অপহরণের পর পাহাড়ে তুলে নিয়ে গিয়ে পাশবিক নির্যাতনের অভিযোগে খায়রুল আলম চৌধুরীকে প্রধান আসামি করে ৫ জনের বিরুদ্ধে সিনিয়র জুডিসিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট (উখিয়া)-এর আদালতে করা হয়েছে মামলা। গত বুধবার দায়ের করা এই মামলার বাদী উখিয়া উপজেলার রত্মাপালং ইউনিয়ন বিএনপির সাংগঠনিক সম্পাদক মোহাম্মদ আলম। মামলার বিবরণীতে বলা হয়, আলম ২০১৮ সালের ৩০ ডিসেম্বর জাতীয় সংসদ নির্বাচনের দিন ভালুকিয়া উচ্চ বিদ্যালয় কেন্দ্রে ধানের শীষ প্রতীকের প্রার্থীর এজেন্ট হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে যান। কিন্তু কেন্দ্রে প্রবেশ করার সঙ্গে সঙ্গেই সেদিন আওয়ামী লীগের নৌকা প্রতীকের প্রার্থী বদির স্ত্রী শাহীন আক্তারকে জেতাতে ‘ভোট ডাকাতি’তে মরিয়া থাকা খায়রুল আলম চৌধুরীর হেনস্তা ও লাঞ্চনার শিকার হন মামলার বাদী। পরে খায়রুল আলম চৌধুরীর নেতৃত্বে তার অনুসারীরা (অপরাপর আসামিরা) আলমকে জোরপূর্বক পার্শ্ববর্তী থিমছড়ি পাহাড়ে তুলে নিয়ে গিয়ে গাছের সঙ্গে বেঁধে হত্যার উদ্দেশ্যে ব্যাপক মারধর ও শারীরিক নির্যাতন চালায়। সে সময় কোনো রকম প্রাণে বাঁচলেও তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের নেতাদের চাপের মুখে সরকারি চিকিৎসা সনদ না পাওয়ায় আলম নিতে পারেননি এতোদিন যথাযথ আইনি পদক্ষেপ। বাদী পক্ষের আইনজীবী অ্যাডভোকেট মিজানুর রহমান জানিয়েছেন, ‘মামলাটি বিজ্ঞ আদালত আমলে নিয়েছেন, উখিয়া থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তাকে তদন্তের নির্দেশ দেয়া হয়েছে।’ মামলা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে খায়রুল আলম চৌধুরী বিষয়টি মিথ্যা ও বানোয়াট বলে দাবি করে মুঠোফোনের সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দেন।

ভোট ব্যাপারি থেকে রত্নাপালং ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান থাকা অবস্থায় ভালুকিয়া বাজারে ছৈয়দ নুরের স্ত্রী পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে চেয়ারম্যানের কাছে ন্যায় বিচার প্রার্থনা করে অসহায় মেয়েটি। এ ঘটনা চেয়ারম্যান বিষয়টি নিষ্পত্তি না করে কালক্ষেপণ করায় বারবার বিচারের দিন দেওয়ার কারণে স্বামী বিরক্ত হয়ে নিজের স্ত্রীকে খুন করে।

অপরদিকে তার চেয়ারম্যানের দায়িত্বকালে পূর্বরত্না বৌদ্ধ সম্প্রদায়ের ফোর মার্ডারের ঘটনায় রহস্যজনক ভূমিকা ছিল তার। এছাড়াও রাবারড্যাম সংলগ্ন কালাচান বড়ুয়া গং এর ৪ কানি ভূমি দখলসহ বদির ক্ষমতাকে অপব্যবহার করে নিজের গঠিত সন্ত্রাসী গ্রুপের তাণ্ডবে পুরো ভালুকিয়া বাজারে রামরাজত্ব কায়েম করেছে।

তার বিরুদ্ধে যে মুখ খুলেছে তার উপর নেমে এসেছে অসংখ্য হামলা-মামলার ঘটনা। ক্ষমতা অপব্যবহার করে ভালুকিয়া উচ্চ বিদ্যালয়ের সভাপতি পদটিও ছিনিয়ে নেয় বিতর্কিত খাইরুল আলম। পরে প্রায় ১২ লাখ টাকা ঘুষের বিনিময়ে যোগ্য লোক বাদ দিয়ে নতুন প্রধান শিক্ষক নিয়োগ দেয়।

স্থানীয় জনসাধারণের সঙ্গে আলাপ ও সরজমিনে পরিদর্শন করে করে জানা গেছে, উখিয়া টেকনাফের ব্যাপক আলোচিত সমালোচিত সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি গ্রেপ্তার হলেও এখনো অধরা তার সকল অপকর্মের অন্যতম সহযোগী খাইরুল আলম চৌধুরী। তিনি বদির খয়ের খা হিসেবে পরিচিত।

উখিয়া-টেকনাফের মানুষ তাকে সাবেক এমপি বদির সেনাপতি বা ক্যাশিয়ার আবার দালাল হিসেবে জানেন। আলোচিত এই খাইরুল আলম চৌধুরী এমপি বদিকে তেল মেরে মেরে অটেল টাকার মালিক হয়েছেন। সাবেক এমপির অন্যতম এই সহযোগী ও সুবিধাভোগীকে যথাযথ প্রক্রিয়ায় আইনের আওতায় এনে রিমান্ডে নেয়ার দাবি জানিয়েছেন রাজনৈতিক সচেতন মহল।

এই খাইরুল আলম চৌধুরীর কারণে আওয়ামী লীগের ত্যাগী পরীক্ষিত নেতাকর্মীদের বৃহৎ একটি অংশ সাবেক এমপির কাছে বিগত ১৬ বছর ভিড়তে পারেনি বলে অভিযোগ রয়েছে। যারা খাইরুল আলমের মন রক্ষা করে চলতে পেরেছে তারাই কেবল সাবেক এমপির কাছাকাছি যেতে পেরেছে এবং সরকারি-বেসরকারি সুযোগ-সুবিধা পেয়েছেন।

নানান কারণে সাবেক এমপি আবদুর রহমান বদি তার কাছে দুর্বল এবং তার হাতের পুতুল ছিল। এই দুর্বল সাইডগুলো অনুসন্ধান করে দেখা গেছে, তিনি সাবেক এমপির অন্যতম নারী সাপ্লাইয়ার। যে সব নারী বদিকে ঘুম পারাত। বিশেষ করে গ্রামের সহজসরল মেয়ে ও উঠতি নারী নেত্রীদের এমপি বদির সঙ্গে পরিচয় করিয়ে দেয়ার এবং সাহায্য করার গল্প শুনিয়ে তাদের বদির কাছে সাপ্লাই দিতেন বলে জনশ্রুতি রয়েছে। এছাড়াও রোহিঙ্গা ক্যাম্পে কর্মরত বিভিন্ন ঠিকাদার ও এনজিও কর্মকর্তাদের চাপ প্রয়োগ করে তাদের মাধ্যমেও বা তাদের দিয়ে রোহিঙ্গা সুন্দরী মেয়ে সংগ্রহ করে সাবেক এমপি বদিকে সাপ্লাই দিতেন রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কিশোরীদের। রোহিঙ্গা ক্যাম্পের কচি কিশোরীদের সাবেক এমপির খুবই পছন্দ।

তাই খাইরুল আলম চৌধুরী সাবেক এমপি বদির কাছে পছন্দের তালিকার অগ্রভাগে ছিলেন। খাইরু পরে দিনক্ষণ ঠিক করে জলসার আয়োজন করতেন। এরা মেরিন ড্রাইভ রোড বা কলাতলী হোটেল মোটেল জোনের বিভিন্ন অভিজাত হোটেল ও বীচ রিসোর্টে মদের আসর বসিয়ে মাস্তি করতেন। রাতভর আনন্দ-ফূর্তি করে বিনিময়ে খাইরুল আলম চৌধুরী কৌশলে বদি থেকে বিশেষ সুবিধা নিতেন।

সাবেক এমপিকে সাইনবোর্ড হিসেবে ব্যবহার করে তার সমস্ত অবৈধ ব্যবসা নির্বিঘ্নে চালিয়ে নিতেন খাইরুল আলম চৌধুরী দিনের পর দিন।

উল্লেখ্য, খাইরুল আলম চৌধুরী বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন সময়ে সাবেক সংসদ সদস্য ও সাবেক হুইপ শাহজাহান চৌধুরীর বেড রুমে অনুপ্রবেশ করার অনুমতি প্রাপ্ত একমাত্র ঘনিষ্ঠজন বা কাছের মানুষ ছিলেন। ক্ষমতার পালাবদলের সঙ্গে সঙ্গে তার রুপ পরিবর্তন হয়ে যায়, বনে সাবেক সংসদ সদস্য আবদুর রহমান বদি রাজনেতিক উপদেষ্টা বা দেহরক্ষী বা ব্যবসায়ীক পার্টনার। বিশেষ করে খাইরুল আলম চৌধুরীর বিরুদ্ধে ভূমিদস্যুতা, ইয়াবা, অস্ত্র, অপহরণ, বিচারের টাকা আত্মসাত ও মানবপাচার সিন্ডিকেটের সক্রিয় সদস্য হিসাবে জনশ্রুতির রয়েছে এলাকায়। বদির অবৈধ টাকার সিংহভাগ টাকা বর্তমানে রয়েছে এই খাইরুল আলম চৌধুরী কাছে।

কথিত আছে, আওয়ামী লীগের দীর্ঘ ১৬ বছর ক্ষমতাকালীন সময়ে খাইরুল আলম সবচেয়ে বেশি সুবিধাভোগী। অথচ এই খাইরু সরাসরি আওয়ামী রাজনীতির সঙ্গে সম্পৃক্ত নন। তিনি মূলত বিএনপি পরিবারের প্রোডাক্ট। ক্ষমতার পট-পরিবর্তন হলে রাতারাতি পল্টি মারেন খাইরুল আলম। রাতারাতি বনে যান আওয়ামী লীগের নীতিনির্ধারকদের একজন। এজন্য আওয়ামী লীগের তৃণমূলের বঞ্চিত নেতাকর্মীরা তার উপর চরমভাবে ক্ষুব্ধ। একইভাবে বিএনপির নেতাকর্মীর কাছে তিনি খলনায়ক হিসেবেও পরিচিত।

ধুরন্ধর এই খাইরুল আলম শুধু যে এমপি বদির মেয়ে সাপ্লাইয়ার বা ব্যবসায়ীক পার্টনার ছিলেন তা নয়, তিনি এসব অবৈধ কাজে জড়িয়েছিলেন সাবেক এমপি বদির আপন শ্যালক ও উখিয়া উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি, উখিয়ার আরেক মূর্তিমান আতঙ্ক জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীকে।

৫ আগস্ট ২০২৪ সালে ক্ষমতার পট-পরিবর্তনের পর সাবেক এমপি র‌্যাবের হাতে আটক হলেও আত্মগোপনে চলে যায় সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান খাইরুল আলম ও সদ্য ক্ষমতাচ্যুত উখিয়া উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর কবির।

আবার কেউ কেউ বলছেন, খাইরুল আলম চৌধুরী বিএনপির সৃষ্টি হলেও সে এতোদিন ঘাপটি মেরে আওয়ামী লীগের ছদ্মভেসে থেকে সুযোগ-সুবিধা ভোগ করেছে। তাই তার কিছুই হবে না। তবে বিএনপির অনেক নেতাকর্মীর মতে, যারা যারা বিএনপির উপর নির্যাতনের স্টিমরোলার চালিয়েছেন তাদের অন্যতম সহযোগী এই খাইরুল আলম। বিশেষ করে বদি ও জাহাঙ্গীর কবির এর অন্যতম সহযোগী হিসেবে ছিলেন এই খাইরুল আলম। তিনি কাউকেই কেয়ার করতেন না। যেখানে সেখানে সাবেক এমপি বদির, উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি জাহাঙ্গীর কবির চৌধুরীর, জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক মুজিবুব রহমমানের, সেনাবাহিনীর জনৈক এক সদস্যের এবং সাবেক ডিজিএফআইয়ের এক কর্মকর্তার ক্ষমতা দেখাতেন। সরকারি অফিস আদালতে আগের মতো এখনও ক্ষমতার প্রভাব বিস্তার করার চেষ্টা করেন। জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক, এমপি ও উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যানের বিশেষ আশীর্বাদপুষ্ট হিসেবে সবাই তাকে সমীহ করে কথা বলতেন এবং চলতেন।