দিনাজপুর সরকারি মহিলা কলেজে গত দুই বছর বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতা হয়নি; কিন্তু ক্রীড়া অনুষ্ঠানবাবদ কলেজের তহবিল থেকে বিভিন্ন সময়ে চারটি চেকে তোলা হয়েছে ১০ লাখ টাকা। শিক্ষক কিংবা শিক্ষার্থীদের জন্য নেই পরিবহন ব্যবস্থা। অথচ পরিবহনবাবদ উত্তোলন হয়েছে প্রায় তিন লাখ টাকা। ২০২১ সালের পর থেকে শিক্ষার্থীদের মুঠোফোনে খুদে বার্তা পাঠানোর কার্যক্রম বন্ধ থাকলেও এসএমএস ফি বাবদ গত মে মাস পর্যন্ত তোলা হয়েছে সোয়া সাত লাখ টাকা। এভাবে বিভিন্ন ‘গায়েবি খাত’ দেখিয়ে বিপুল পরিমাণ টাকা তুলে আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে কলেজের অধ্যক্ষ ফরিদা পারভীনের বিরুদ্ধে। গত ৫ আগস্ট সরকার পতনের পরে তার বিরুদ্ধে আর্থিক অনিয়মসহ শিক্ষার্থী ও কর্মচারীকে হয়রানির অভিযোগ তুলে আন্দোলন শুরু করেন শিক্ষার্থীরা। এরপর কলেজে আসা বন্ধ করেন ফরিদা পারভীন। ২০ আগস্ট সেনাবাহিনীর সদস্যদের সঙ্গে নিয়ে শহরের ঈদগাহ বস্তি এলাকার বাসা থেকে শিক্ষার্থীরা অধ্যক্ষকে কলেজে ডেকে আনেন। পরে শিক্ষার্থীদের আন্দোলনের মুখে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব বরাবর স্বেচ্ছায় অবসর গ্রহণের আবেদন করেন ফরিদা পারভীন। ফরিদা পারভীন ১৯৯৩ সালে কলেজে রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগে প্রভাষক পদে যোগ দেন। ২০২০ সালে পদোন্নতি পেয়ে অধ্যাপক এবং ২০২২ সালের আগস্টে অধ্যক্ষের দায়িত্ব পান। বর্তমানে কলেজের শিক্ষকরা সর্বসম্মতিক্রমে জ্যেষ্ঠ শিক্ষক আশরাফুল আলমকে সাময়িকভাবে অধ্যক্ষের দায়িত্ব দেন। ১ সেপ্টেম্বর ফরিদা পারভীনের বিষয়ে বিভিন্ন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে শিক্ষকদের নিয়ে তিনটি কমিটি গঠন করা হয়েছে। গত বুধবার পর্যন্ত আর্থিক অনিয়মসংক্রান্ত কমিটি প্রায় ১ কোটি টাকার অনিয়ম ও দুর্নীতির তথ্য পাওয়ার কথা জানিয়েছেন। কমিটিতে থাকা গণিত বিভাগের শিক্ষক একেএম রশিদুল হাসান বলেন, দিনাজপুর শহরের বাহাদুর বাজার শাখায় কলেজের মোট ২৯টি ব্যাংক হিসাব চালু রয়েছে। এ পর্যন্ত তারা মাত্র সাত-আটটি ব্যাংক হিসাবের আর্থিক অনিয়ম যাচাই-বাছাই করেছেন। এরই মধ্যে প্রায় এক কোটি টাকার হিসাব পেয়েছেন, যা অনৈতিকভাবে উত্তোলন করা হয়েছে। এখনো তদন্ত কার্যক্রম চলমান। অভিযোগের বিষয়ে ফরিদা পারভীন বলেন, ‘আমি তো কিছুই জানি না। গত ২০ আগস্ট শিক্ষার্থীরা হঠাৎ বাসা থেকে ডেকে নিয়ে গেল কলেজে। তারপর আমাকে পদত্যাগ করতে বাধ্য করল।’ আর্থিক অনিয়মের বিষয়ে তিনি বলেন, রোববার এসব বিষয়ে কথা বলতে পারবেন। তার আগে নয়। কলেজ সূত্রে জানা গেছে, ফরিদা পারভীনের আর্থিক অনিয়ম-দুর্নীতির বিষয়ে গত বছর নভেম্বরে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবরে লিখিত অভিযোগ করেছিলেন কলেজের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক শাহীনা পারভীন। লিখিত অভিযোগে তিনি উল্লেখ করেন, বিভাগের জন্য বই, আইপিএস, বুকশেলফ, চেয়ার-টেবিল কেনার জন্য ৪ লাখ ৭৫ হাজার ৮৩৫ টাকা উত্তোলন করে মাত্র ৮০ হাজার ৮৩৫ টাকা খরচ করে অবশিষ্ট টাকা আত্মসাৎ করেন ফরিদা পারভীন। বর্তমানে কলেজে প্রায় পাঁচ হাজার শিক্ষার্থী রয়েছেন। এর মধ্যে তিনটি আবাসিক হলে শিক্ষার্থীর সংখ্যা সাড়ে ৪০০। আবাসিক শিক্ষার্থীদের চিকিৎসার জন্য ফরিদা ইয়াসমিন নামের এক চিকিৎসককে মাসিক পাঁচ হাজার টাকায় চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ দেয়া হয়। ২০২০ সালের মার্চের পর তার চুক্তির মেয়াদ শেষ হয়।
তবে চলতি বছরের মে মাস পর্যন্ত চিকিৎসকের ভাতা বাবদ ৩ লাখ ৬০ হাজার টাকা তোলা হয়েছে। তবে চিকিৎসক ফরিদা ইয়াসমিন জানান, ২০২০ সালের মার্চ মাসের পর তিনি কলেজে যাননি, কোনো অর্থও গ্রহণ করেননি। কয়েকজন জ্যেষ্ঠ শিক্ষক বলেন, ২০২০ সালের পরে ছাত্রী সংসদের কোনো কার্যক্রম নেই। অথচ ছাত্রী সংসদের নামে টাকা তুলেছেন ফরিদা পারভীন। ছাত্রীরা তার নামে দুদকে গিয়েও অভিযোগ করেছে। গত বছর ১৫ আগস্টে শোক দিবস পালনের জন্য পৌনে দুই লাখ টাকা উত্তোলন করা হলেও শুধু একটি ব্যানার ও শিক্ষকদের নাশতা খাওয়ানো হয়েছে। এসব বিষয়ে প্রতিবাদ করতে গেলেই স্থানীয় সংসদ সদস্যের কথা বলে বদলি করাসহ নানা ধরনের হুমকি দিতেন তিনি। কলেজে হিসাব শাখার দায়িত্বে আছেন নুরুল আলম। তিনি দুই দিন সময় দেয়ার পরও আর্থিক খরচের সম্পূর্ণ বিল-ভাউচার উপস্থাপন করতে পারেননি তদন্ত কমিটির কাছে। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমরা হুকুমের গোলাম। ম্যাডামের (ফরিদা পারভীন) কাছে আর্থিক বিষয়ে আবেদন জমা পড়লে তিনি আমাদের ফরোয়ার্ড করেছেন। যত টাকার চেক ইস্যু করতে বলেছেন আমরা হুকুম পালন করেছি। সব বিল ভাউচার সমন্বয় হয়েছে কি না না দেখে বলতে পারছি না।’