হাসিনা-বিপুর দোসররা এখনো বহাল তবিয়তে!

পিজিসিবির দুর্নীতিবাজ ও অবৈধ এমডি গাউছ মহিউদ্দিনের খুঁটির জোর কোথায়?

প্রকাশ : ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

পতিত শেখ হাসিনা ও নসরুল হামিদ বিপুর দোসর ও ‘দুর্নীতির হেডকোয়ার্টার খ্যাত’ পাওয়ার গ্রিড কোম্পানি অব বাংলাদেশ (পিজিসিবি) এর এমডি একেএম গাউছ মহিউদ্দিন আহমেদ ছিলেন বঙ্গবন্ধু প্রকৌশলী সমিতির সভাপতি। অভিযোগ রয়েছে, পিজিসিবির এমডি পদে নিয়োগ পরীক্ষায় দ্বিতীয় হয়েও মেধা তালিকার শীর্ষকে ডিঙ্গিয়ে বিদ্যুৎ জ্বালানি ও খনিজসম্পদ প্রতিমন্ত্রীকে মোটা অংকের অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে বিশেষভাবে ম্যানেজ করে পিজিসিবির এমডি পদটি বাগিয়ে নেন। ৫ আগস্ট গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে হাসিনা সরকারের পতন হলেও এখনো হাসিনা-বিপুর দোসর গাউছ মহিউদ্দিন কীভাবে বহাল তবিয়তে রয়েছেন, এটাই এখন সংশ্লিষ্টদের প্রশ্ন।

ওই প্রতিমন্ত্রীর ফাইল নোটও রয়েছে এই গণমাধ্যম প্রতিনিধির হাতে। প্রশ্ন উঠেছে, এত অপকর্ম করে নিয়োগ পাওয়ার এমন ঘোরতর অভিযোগ এবং বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবর ভুক্তভোগীদের লিখিত অভিযোগ দেয়ার পরও পতিত সরকারের এই দোসর কোনো খুঁটির জোরে এখনও ক্ষমতার মসনদে আসীন রয়েছেন?

পিজিসিবি’র এমডি একেএম গাউছ মহিউদ্দিন আহমেদকে অপসারণের দাবিতে গত ২০ আগস্ট বিদ্যুৎ, জালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা বরাবর দরখাস্ত দেন পিজিসিবির সাধারণ কর্মকর্তা ও কর্মচারীবৃন্দ, যার অনুলিপি বিদ্যুৎ বিভাগের সিনিয়র সচিবকেও দেয়া হয়। ২০ আগস্ট অভিযোগ করে আবেদন দেয়ার পর আজ ১১ সেপ্টেম্বর, ২০ দিন অতিবাহিত হলো। প্রশ্ন ওঠেছে, তিনি তাহলে কাকে ম্যানেজ করে স্বপদে এখনও বহাল রয়েছেন? অভিযোগের প্রেক্ষিতে কোন অগ্রগতি আছে কি না জানতে চাইলে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব রফিকুল ইসলাম বলেন, আমরা শিগগিরই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছি। তিনি বলেন, এধরনের আরো অভিযোগ আছে। আমরা এবিষয়ে আলোচনা করেছি এবং দ্রুত পদক্ষেপ নিচ্ছি।

আবেদনে ভুক্তভোগীরা উল্লেখ করেন, গত ১৫ বছর স্বৈরাচারী সরকারের কালো থাবা হতে স্বনামধন্য উক্ত সংস্থাটিও (পিজিসিবি পিএলসি) রেহাই পায়নি।...পাওয়ার গ্রিডের বর্তমান ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম গাউছ মহিউদ্দিন সর্বশেষ ব্যবস্থাপনা পরিচালকের নিয়োগ পরীক্ষায় মেধা তালিকায় পিছিয়ে ছিলেন। পাওয়ার গ্রিডের পরিচালনা পর্ষদ কর্তৃক গৃহীত নিয়োগ পরীক্ষার ফলাফলের ভিত্তিতে সর্বোচ্চ নম্বর পেয়ে মেধাতালিকায় প্রথম স্থান অধিকারী প্রার্থীকে (আবদুর রশিদ খান) সংস্থাটির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের জন্য পরিচালনা পর্ষদ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা সত্ত্বেও সাবেক দুর্নীতিবাজ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপু, পিজিসিবি পর্ষদের সিদ্ধান্ত এবং উপরোক্ত মেধাক্রম অনুসরণ না করে শুধুমাত্র স্বৈরাচারী সরকারের দলীয় প্রার্থী হিসেবে পিজিসিবি শাখার বঙ্গবন্ধু প্রকৌশল পরিষদের সভাপতি বিবেচনায় প্রভাব খাটিয়ে বিপুল অর্থ লেনদেনের মাধ্যমে মেধাক্রম তালিকার পিছনে থাকা সত্ত্বেও একেএম গাউছ মহিউদ্দিন আহমেদকে পিজিসিবির ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে চুক্তিভিত্তিক নিয়োগের সুপারিশ করেন, যা ছিল সম্পর্ণ বেআইনি এবং কোম্পানীর এমওইউর পরিপন্থি।

যদিও পাওয়ার গ্রিডের এমওইউর ধারা ১, ২ (এ), ধারা ৩৩(২), ধারা ৩৪ (৩) অনুযায়ী এ জাতীয় নিয়োগে শুধুমাত্র পাওয়ার গ্রিডের পরিচালনা পর্ষদ ক্ষমতাবান।

তারা উল্লেখ করেন, অবৈধভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত হওয়ার পরে পিজিসিবি’র এমডি একেএম গাউছ মহীউদ্দিন ও তার চিহ্নিত কিছু দালাল মিলে অবৈধ সরকারের সাবেক দুর্নীতিবাজ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর কেরানীগঞ্জের হাউজিংয়ের উপর হতে বিদ্যুতের সঞ্চালন লাইন অপসারণ করে আন্ডারগ্রাউন্ড করার লক্ষ্যে পাওয়ার গ্রিডের সংশ্লিষ্ট কারিগরী টিমের যৌক্তিক বাধাকে উপেক্ষা করে অবৈধ প্রভাব খাটিয়ে প্রায় ১৩০০ কোটি টাকা ব্যয়ে পরিকল্পনা কমিশন হতে প্রকল্পের পিডিপিপি নীতিগতভাবে অনুমোদন করিয়ে নেন। তারা দ্রুত এআ প্রকল্প বন্ধ করে ১৩০০ কোটি টাকা অপচয় রোধ, সৈরাচারী হাসিনার অন্যতম দোসর অবৈধ ব্যবস্থাপনা পরিচালক একেএম গাউছ মহিউদ্দিন মুক্ত পিজিসিবি পুনর্গঠনে উপদেষ্টার নির্দেশনা চান।

এদিকে অনিয়ম-দুর্নীতির প্রতিবাদে ও এমডি একেএম গাউছ মহিউদ্দিনের অপসারণের দাবিতে গত ১২ আগস্ট পিজিসিবিএলের কর্মকর্তা-কর্মচারীরা সমাবেশ করেছে। পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ পিএলসির প্রধান কার্যালয়ের সামনে শতাধিক কর্মকর্তা-কর্মচারীর অংশগ্রহণে এ সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। গাউছ মহিউদ্দিনের দুর্নীতির ফিরিস্তি তুলে ধরেন তারা। সমাবেশে পাওয়ার গ্রিড বাংলাদেশ পিএলসির সাবেক জেনারেল ম্যানেজার মোহাম্মদ সেলিম বলেন, পাওয়ার গ্রিডের সব সঞ্চালন লাইনে কনভেনশনাল কন্ডাক্টর ব্যবহারের পরিবর্তে প্রায় দ্বিগুণ মূল্যের অ্যালুমিনিয়াম কন্ডাক্টর কম্পোজিট কোর ব্যবহার করার মাধ্যমে গত আট বছরে দেশের প্রায় ১০ হাজার কোটি টাকা নষ্ট করা হয়েছে। এমনকি কোনো রকম কারিগরি গবেষণা ব্যতিরেকে বোর্ডসভায় বিবিধ আলোচনায় উত্থাপন করে এ প্রজেক্ট বাস্তবায়ন করা হয়েছে। আর ওই অর্থ শেখ হাসিনা সরকারের মদদপুষ্ট চিহ্নিত দালালরা পাচার করে নিয়ে গেছে। আমরা এই দালালদের খুঁজে বের করে বিচারের আওতায় আনার অনুরোধ জানাচ্ছি।

তিনি বলেন, বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল কালাম আজাদ এবং তৎকালীন নির্বাহী পরিচালক (এইচআরএম) মোহাম্মদ শফিকুল্লাহর সময়কালে সার্ভিস রুলকে চরমভাবে অমান্য করে ছাত্রলীগের কর্মীদের ভুয়া অভিজ্ঞতার সার্টিফিকেট তৈরি করে তাদের চাটুকার কর্মকর্তা হিসেবে নিয়োগ দেয়া এবং দলীয় কর্মী বিবেচনায় পদোন্নতি প্রদান করা হয়েছে। এসব বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্তপূর্বক যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানাচ্ছি। দেশবিরোধী সব সিদ্ধান্তের প্রতিবাদ করায় এর আগে অনৈতিক এবং আইনবহির্ভূতভাবে অনেক কর্মকর্তা-কর্মচারীকে কোম্পানির চাকরি হতে ছাঁটাই করা হয়। আমরা তাদের পুনর্বহাল দাবি করছি। কোম্পানির পরিচালক পর্ষদে মন্ত্রণালয় প্রতিনিধি (সচিব, অতিরিক্ত সচিব, যুগ্ম সচিব) অংশগ্রহণ রহিত করতে হবে। কোম্পানি আইন অনুযায়ী কোম্পানি পরিচালনা করতে হবে।

পিজিসিবিতে অনুসন্ধান চালিয়ে বেশকিছু প্রামাণিক তথ্য পাওয়া গেছে। যার মধ্যে সাবেক প্রতিমন্ত্রীর বেআইনি ফাইলনোট অন্যতম। জানা গেছে, ২৮ মে ২০২৩ তারিখের ৫২ নম্বর ফাইলনোটে ওই প্রতিমন্ত্রী সবুজ কলম দিয়ে নিজ হাতে লিখেছিলেন, ২ নং ক্রমিকের একেএম গাউছ মহীউদ্দিন আহম্মেদকে নিয়োগ প্রদান করা যেতে পারে। (পরিপত্র জারি নং ৩৮৭)। অথচ ৫০ নম্বর ফাইলনোটে পরিষ্কার ভাষায় লেখা ছিল, এমতাবস্থায় পিজিসিবি লি. নিয়োগ কমিটির (‘কোম্পানীর আর্টিকেল নম্বর ৩৩(২) এবং ৩৪(৩)ধারা অনুযায়ী পরিচালক পর্ষদ ব্যবস্থাপনা পরিচালক বাছাই কমিটির দায়িত্ব পালন করে’) ১৫/০৪/২০২৩ তারিখ অনুষ্ঠিত সভার সুপারিশের আলোকে ব্যবস্থাপনা পরিচালক পদে মেধা তালিকার শীর্ষে অবস্থানকারী আবদুর রশিদ খানকে প্রাথমিকভাবে নিয়োগের তারিখ থেকে ০১ (এক) বছরের জন্য চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ প্রদান করা যেতে পারে। পরবর্তীতে তার কর্মমূল্যায়ণ ও বোর্ডের সুপারিশের আলোকে চুক্তিভিত্তিক চাকরির মেয়াদ বৃদ্ধি করা যেতে পারে।

জানা গেছে, গত মাসে তিনি সাত দিনের ছুটিতে যান। বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ মন্ত্রণালয়ের এক দায়িত্বশীল সূত্র এ তথ্য জানিয়েছে। গাউছ মহিউদ্দিন দ্বিতীয় হয়েও নিয়োগ পেলেন কীভাবে এমন প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করা হলে এ বিষয়ে বিদ্যুৎ সচিব মো. হাবিবুর রহমান গণমাধ্যমকে জানান, তিনি পিজিসিবির চেয়াম্যান হিসেবে এমডি নিয়োগ কমিটির সভাপতি ছিলেন। নিয়ম অনুযায়ী তিনজনের নাম প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ বিপুর কাছে পাঠানো হয়েছিল। সুপারিশ করা হয়েছিল মেধা তালিকায় প্রথম হওয়া আবদুর রশিদ খানকে এমডি নিয়োগ দেয়ার জন্য। কিন্তু প্রতিমন্ত্রী যিনি দ্বিতীয় হয়েছিলেন তাকেই এমডি হিসেবে নিয়োগ দিয়েছিলেন। এখানে আমার কোনো এখতিয়ার ছিল না বলে তিনি উল্লেখ করেন।