ঘুরে আসুন রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী শ্যামনগর
প্রকাশ : ১৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
আলমগীর সিদ্দিকী, শ্যামনগর (সাতক্ষীরা)
রাজা বিক্রমাদিত্য প্রতিষ্ঠিত যশোর রাজ্য আজ আর নেই। তার পুত্র রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজত্বের সেই চিহ্নও নেই। তবে তাদের স্মৃতিবিজড়িত কিছু চিহ্ন আজও রয়েছে। প্রতাপাদিত্যের রাজধানী ধূমঘাটের এখন কোনো অস্তিত্ব চোখে পড়ে না। রাজা প্রতাপের সেই রাজধানী ধূমঘাট এখন সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুরের কাছাকাছি একটি গ্রাম। রাজা প্রতাপাদিত্যের সেনাদুর্গও ছিল এখানে। বিভিন্ন ইতিহাসবিদের লেখা তথ্য থেকে জানা যায়, যশোর রাজ্যের বিস্তৃতি ছিল পূর্বে মধুমতী নদী, পশ্চিমে ভাগীরথী, উত্তরে বর্তমান যশোর জেলা এবং দক্ষিণে সুন্দরবন ও বঙ্গোপসাগর। কোনো কোনো ঐতিহাসিকরা বলেছেন, এর বিস্তৃতি ছিল বর্তমান কালীগঞ্জের বসন্তপুর থেকে ধূমঘাট পর্যন্ত। একে বলা হতো পঞ্চক্রোসী। সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর উপজেলার ঈশ্বরীপুর ইউনিয়নের সাত গ্রামের একটি ধূমঘাট।
যমুনা ও ইছামতী নদী এ ইউনিয়নের বংশীপুরে এসে পৃথক হয়ে গেছে। এ এলাকাকেই প্রাচীন যশোর রাজ্যের রাজধানী হিসাবে গ্রহণ করা হয়। এখানে রয়েছে যশোরেশ্বরী কালীমন্দির, হাম্মামখানা (স্নানাগার), বংশীপুরের টেঙ্গা মসজিদ ও গির্জা। রয়েছে দুটি দিঘি। এছাড়া বারোদুয়ারি নামের প্রাচীন স্থাপনার ভগ্নাবশেষ। জানা যায়, বংশীপুরের মসজিদের কাছে অনেক কবর রয়েছে। এখানে শায়িত রয়েছেন রাজা প্রতাপাদিত্যের সেনাবাহিনীর নিহত সেনা সদস্যরা। তার সেনাবাহিনীর মুসলমান সদস্যরা নামাজ আদায় করতেন বংশীপুর শাহী মসজিদে, হিন্দু সদস্যরা পূজা দিতেন যশোরেশ্বরী কালীমন্দিরে এবং খ্রিষ্টান সদস্যরা উপাসনা করতেন গির্জায়। ইতিহাসের তথ্যানুযায়ী, শ্রীহরি নামের এক ব্যক্তির ওপর ছিল দাউদ কররানির সম্পত্তি রক্ষণাবেক্ষণের দায়িত্ব। মোগলদের বাংলা আক্রমণকালে দাউদ কররানি পরাজিত ও নিহত হন। এ সময় শ্রীহরি রাজকোষের সমুদয় ধনরত্ন নিয়ে সুন্দরবনের জঙ্গলে পালিয়ে যান। সেখানে তিনি নিজের নাম বিক্রমাদিত্য রায় ঘোষণা করে দুর্গ, রাজবাড়ি ও মন্দির স্থাপন করে নিজেকে স্বাধীন রাজা হিসাবে ঘোষণা দেন। ১৫৮৩ সালে রাজা বিক্রমাদিত্যের মৃত্যু হয় এবং ১৫৮৪ সালে তার পুত্র রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজ্যাভিষেক ঘটে। ১৫৮৭ সালে ধূমঘাটে দুর্গ স্থাপিত হয় এবং যশোরেশ্বরীর আবির্ভাব ঘটে। ১৫৯১ সালে রাজা প্রতাপাদিত্য স্বাধীনতা ঘোষণা করেন। কিছুকাল পর মানসিংহ কালিন্দী নদী পার হয়ে বসন্তপুরে সেনাছাউনি স্থাপন করেন। তার লক্ষ্য ছিল প্রতাপাদিত্যের রাজ্য আক্রমণ করা। এ খবর পেয়ে যশোর রাজ্যের প্রজারা মৃত্যুভয়ে পালিয়ে ধূমঘাটের দুর্গে আশ্রয় গ্রহণ করে। এ সময় দুপক্ষে যুদ্ধ বেধে যায়। মানসিংহ ২০ হাজার সৈন্য নিয়ে অগ্রসর হন। তার সঙ্গে ছিল বিশাল অশ্ববাহিনী। অপরদিকে রাজা প্রতাপাদিত্যের তুর্কি সেনাসহ অন্যান্য সেনা মিলে ৫২ হাজার সেনা ছিল। এর মধ্যে ছিল বিপুলসংখ্যক ধানুকি, ১৩০০ হস্তি ও ১০ হাজার অশ্বারোহী সৈন্যও ছিল। একই সঙ্গে তার ছিল সড়কিধারী বিপুলসংখ্যক অনিয়মিত সৈন্য। বেশ কয়েকদিনের যুদ্ধে রাজা প্রতাপাদিত্য মানসিংহের কাছে পরাজিত হন। অথচ যুদ্ধে জয়লাভ করেও মর্যাদা রক্ষার স্বার্থে মানসিংহ তার সঙ্গে সন্ধি করেন। সতীশ চন্দ্র মিত্রের ‘যশোহর খুলনার ইতিহাস’, আবদুল জলিলের ‘সুন্দরবনের ইতিহাস’সহ বিভিন্ন ইতিহাসে এসব বিষয় উল্লেখ করা হয়েছে। জানা যায়, ১৫৬০ থেকে ১৫৮০ সাল পর্যন্ত রাজা লক্ষণ সেনের রাজত্বকালে তিনি স্বপ্নে আদিষ্ট হন ঈশ্বরীপুর এলাকায় একটি মন্দির নির্মাণ করার। মন্দিরটি নির্মাণের পর সেটি বন্ধ রাখারও নির্দেশ দেয়া হয়। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার কারণে মন্দিরটি জঙ্গলাকীর্ণ হয়ে ওঠে। সেসময় শ্যামনগরের ধূমঘাট ছিল বাংলার বারো ভুঁইয়ার এক ভুঁইয়া রাজা প্রতাপাদিত্যের রাজধানী। রাজা প্রতাপাদিত্য ও তার সেনাপতি খাজা কামালউদ্দিন এ সময় দেখতে পান ওই জঙ্গল থেকে এক ধরনের ধোঁয়া ও আলোকরশ্মি বেরিয়ে আসছে। তিনি তখন মন্দিরটি খোলার নির্দেশ দেন। এরই মধ্যে মন্দিরটি খুললে সেখানে দেখা মেলে ঘনকৃষ্ণবর্ণ শিলামূর্তির। তখন থেকে সেখানে পূজা-অর্চনা শুরু হয়ে যায়। তিনি মন্দিরটি সংস্কার করে তার সৌন্দর্য বৃদ্ধি করেন। অপরাপর ইতিহাসবিদ বলেন, আনারি নামের একজন ব্রাহ্মণ এ মন্দিরটি প্রতিষ্ঠা করেন। এর ১০০টি দরজা ছিল। এখান থেকেই আলোর রেখা জঙ্গল ফুঁড়ে বেরিয়ে আসত। মানুষের হাতের তালুর আকারের এ আলোকরেখা রাজা প্রতাপাদিত্য দেখতে পান। ইতিহাস ও পৌরাণিক তথ্য অনুযায়ী আরো জানা যায়, দক্ষ রাজার কনিষ্ঠ কন্যার নাম ছিল সতীবালা। তিনি মহাদেবের পূজারিনি ছিলেন। একপর্যায়ে তিনি স্বেচ্ছায় মহাদেবকে বিয়ে করেন। এতে দক্ষ রাজার ঘোর আপত্তি ছিল। তার জামাতা জঙ্গলে ঘুরে বেড়াবে, মাথায় জটা থাকবে, গলায় সাপ থাকবে, হাতে ত্রিশূল থাকবে এবং তিনি পশুর চামড়া পরিধান করবেন- এমনটি হতে পারে না।