পর্যায়ক্রমে পুরো ঢাকা শহরকে হর্নমুক্ত করতে এরইমধ্যে কাজ শুরু করেছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। প্রথমে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে, পরে পুরো ঢাকা শহর এবং ধীরে ধীরে বিভাগীয় শহরগুলোতেও শব্দদূষণ বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হবে। ইউএনবিকে দেয়া বিশেষ সাক্ষাৎকারে এ পরিকল্পনা জানালেন পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান। হর্ন বাজানোর নিয়ন্ত্রণের বিধিতেও পরিবর্তন নিয়ে আসা হবে জানিয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, আগামী ডিসেম্বর থেকে পরের বছরের শুরুতে পুরো ঢাকা শহরকে নীরব এলাকা করতে কর্মসূচি নেয়া হবে। প্রথমে গুরুত্বপূর্ণ এলাকাগুলোতে, পরে পুরো ঢাকা শহর এবং ধীরে ধীরে বিভাগীয় শহরগুলোতেও শব্দদূষণ বন্ধের উদ্যোগ নেয়া হবে। এ লক্ষ্যে এরই মধ্যে কাজ শুরু হয়েছে বলে জানান তিনি। রিজওয়ানা বলেন, হর্ন বাজানোর দীর্ঘদিনের অভ্যাস পরিবর্তন করতে প্রথমে মানুষকে সচেতন করা প্রয়োজন। এরপর আইনের প্রয়োগ। হর্ন বাজানো নিয়ন্ত্রণ করতে ডিসেম্বর থেকে জরিমানা কার্যকর করা হবে। প্রথমবার আইন ভঙ্গ করলে ৫০০ টাকা জরিমানা করা হবে। দ্বিতীয়বার করলে আরো বেশি টাকা জরিমানা করা হবে। উপদেষ্টা বলেন, জরিমানা কার্যকর করার আগে সব ধরনের গাড়িচালক ও সাধারণ জনগণকে সচেতন করা হবে। হর্ন বাজানো দীর্ঘদিনের অভ্যাস তাই এটি পরিবর্তন করতে চাইলে প্রথমে মানুষকে সচেতন করতে হবে।
পরিবেশ উপদেষ্টা আরো বলেন, যানবাহনে অহেতুক হর্ন, যত্রতত্র সাউন্ড বক্স, মাইকের মাধ্যমে উচ্চ শব্দ সৃষ্টি ক্রমাগত বেড়েই চলেছে। এসব মানুষের স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত করে। তিনি বলেন, আমাদের আর্থ-সামাজিক উন্নয়নকে টেকসই করতে হলে অন্যান্য দূষণের পাশাপাশি শব্দদূষণের বিরুদ্ধে প্রতিরোধ গড়ার এখনই সময়। ক্ষতিকর দিকগুলো বিবেচনা করে শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে বিদ্যমান আইন ও বিধি বাস্তবায়ন ও অতিরিক্ত শব্দ করা থেকে বিরত থাকার সংস্কৃতি সৃষ্টি করতে হবে। রিজওয়ানা মনে করেন, হর্ন বাজানো ও শব্দদূষণ বন্ধ করতে সবচেয়ে জরুরি হলো সবার মধ্যে সচেতনতা সৃষ্টি করা। তিনি আরও বলেন, আমরা যদি নিজেকে সচেতন করি, প্রতিটি চালক তার এই পুরোনো অভ্যাস বন্ধে প্রতিজ্ঞা করে তাহলে দ্রুত হর্ন বাজানো ও শব্দদূষণ বন্ধ করা যাবে। সেজন্য জরিমানা করার আগে আগামী কয়েকদিন ব্যাপক আকারে সচেতনতার জন্য বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হবে। তিনি জানান, লাইসেন্স নবায়নের শর্ত হিসেবে হর্ন বাজানোর ওপর নিষেধাজ্ঞা থাকবে। এছাড়াও উপদেষ্টা বলেন, ঢাকায় যানবাহনের হর্নের কারণে মানুষের শ্রবণশক্তি কমছে। শব্দদূষণ জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় হুমকি। এটি হৃদরোগ, উচ্চ রক্তচাপ ও স্নায়ুরোগ সৃষ্টি করতে পারে।
শব্দদূষণের বিষয়ে পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, জনগণকে ব্যাপকভাবে বধির হওয়া থেকে রক্ষা করতে শব্দদূষণ বন্ধ করতেই হবে। শব্দদূষণ নিয়ন্ত্রণে সমন্বিত ও অংশীদারিত্বমূলক প্রকল্পকে আরো কার্যকরী ভূমিকা রাখতে নির্দশনা দেয়া হয়েছে। এই প্রকল্পের মাধ্যমে শব্দদূষণের বিষয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করা হবে।
তিনি আরো বলেন, ঢাকা শহরে হর্ন ছাড়াও মাইকিং, বিজ্ঞাপন, কন্সট্রাকশনসহ বিভিন্নভাবে শব্দদূষণ হচ্ছে। হর্ন বন্ধ ছাড়াও সব শব্দ বা সাউন্ড বন্ধ করা করতে হবে। নিরাপদ ভবিষ্যৎ গড়তে হলে আমাদের ‘কম শব্দযুক্ত’ দেশে থাকতে হবে। রিজওয়ানা হাসান আরো বলেন, অনেক ড্রাইভার হর্ন বাজিয়ে পাশের মানুষকে বিরক্ত করেন। আমরা যদি বাস, ট্রাক বা গাড়িতে অপ্রয়োজনীয় হর্ন না বাজাই, তাহলে অনেক মানুষের স্বাস্থ্যহানি রোধ করা সম্ভব।
পরিবেশ উপদেষ্টা বলেন, রেড লাইট থেকে গ্রিন লাইটে আসলেই সব গাড়ি হর্ন বাজানো শুরু করে। এটা উচিত নয়। হর্ন বাজানোর আগে ভাবতে হবে, এটি জরুরি কি না। সব ড্রাইভারকে হর্ন না বাজানোর জন্য সচেতন করতে হবে। বিশেষ করে, বাচ্চাদের স্কুলে নেয়ার সময় রিকশায় যে শব্দ হয়, তাতে অনেক সময় কানের সমস্যা হতে পারে। তিনি আরো বলেন, ইসলাম ধর্মে উচ্চস্বরে নয়, নিচু করে কথা বলার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। এমনভাবে কথা বলতে হবে যাতে মানুষের বিরক্তির কারণ না হয়। আমরা মনে করি যে যত জোরে কথা বলতে পারি, সে তত শক্তিশালী। কিন্তু আসলে যুক্তিপূর্ণ কথা বলাই আসল ক্ষমতা। আমাদের ব্যক্তিগত পর্যায়ে পরিবর্তন আনলেই সমাজে ও রাষ্ট্রে পরিবর্তন আনা সম্ভব। এদিকে ১ অক্টোবর থেকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও আশপাশের তিন কিলোমিটার এলাকাকে ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণা করা হয়েছে। ওই এলাকায় হর্ন বাজানো নিষিদ্ধ করা হয়েছে এবং হর্ন বাজালে কারাদণ্ড বা জরিমানা হতে পারে।
এ বিষয়ে বাংলাদেশ বেসামরিক বিমান চলাচল কর্তৃপক্ষের (বেবিচক) চেয়ারম্যান এয়ার ভাইস মার্শাল মো. মঞ্জুর কবীর ভূঁইয়া ইউএনবিকে জানান, হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও এর সম্মুখস্থ ৩ কিলোমিটার মহাসড়ক হর্নমুক্ত ‘নীরব এলাকা’ হিসেবে ঘোষণা করা হয়েছে। সে অনুযায়ী বিমানবন্দরের উত্তরে স্কলাস্টিকা পয়েন্ট থেকে দক্ষিণে লা মেরিডিয়ান পয়েন্ট পর্যন্ত নীরব এলাকা। এর আগে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ও আশপাশের এলাকায় শব্দদূষণ রোধে ‘নীরব এলাকা’ ঘোষণা কার্যক্রমকে সফলভাবে বাস্তবায়নের নানা কার্যক্রম চালায় বেবিচক ও হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর কর্তৃপক্ষ।