রাশিয়ার ভিভিইআর ১২০০ প্রযুক্তিতে দুই ইউনিটের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ হচ্ছে বাংলাদেশে। পাবনার রূপপুরে নির্মিতব্য এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের নির্মাণব্যয় এশিয়া মহাদেশের অন্য দেশগুলোর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণব্যয়ের তুলনায় বেশি। এই বিদ্যুৎকেন্দ্রের বিভিন্ন পর্যায়ের চুক্তি (জেনারেল কন্ট্রাক্টসহ) পর্যালোচনা করে এমন তথ্যই জানা গেছে। তথ্য বলছে, প্রতিবেশী দেশ ভারতের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের মতো একই প্রযুক্তি ব্যবহার করে হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র। এই প্রকল্প নির্মাণে এখন পর্যন্ত ব্যয় দেখানো হয়েছে ১৩ দশমিক ২০ বিলিয়ন মার্কিন ডলার, যা বাংলাদেশি মুদ্রায় ১ লাখ ৫৫ হাজার কোটি টাকার কিছু বেশি। অর্থাৎ প্রতি ইউনিটে কেন্দ্র নির্মাণ ব্যয় দাঁড়াচ্ছে ৬ লাখ ৮৯ হাজার ১৩০ কোটি টাকা। মূল প্রকল্পের বাইরে, অবকাঠামো তৈরিতে ব্যয় আরো সাড়ে ২৪ হাজার কোটি টাকা। এই হিসেবে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রকল্প নির্মাণব্যয় ১ লাখ ৭৯ হাজার কোটি টাকা। এদিকে ভারতের কুদামকুলামে রাশিয়ার ভিভিইআর ১০০০ প্রযুক্তিতে দুটি পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র সচল রয়েছে। সেখানে একই প্রযুক্তির আরো দুটি ইউনিট স্থাপনের কাজ শুরু হয়েছে। প্রতিটি ইউনিটের উৎপাদন ক্ষমতা ১ হাজার মেগাওয়াট। এখানকার প্রথম দুই ইউনিটের নির্মাণব্যয় ১৭ হাজার ২৭০ কোটি রুপি (বাংলাদেশি মুদ্রায় ২৪ হাজার ৫৬০ কোটি ৪১ লাখ টাকার কিছু বেশি)। তিন ও চার নম্বর ইউনিটের কাজ ২০১৮ সালে শুরু হয়েছে। এই দুই ইউনিটের নির্মাণব্যয় হবে ৩৯ হাজার ৭৪৭ কোটি রুপি (৫৬ হাজার ৫২৫ কোটি ৯১ লাখ টাকার কিছু বেশি)। ভারতের কুদামকুলামে পঞ্চম ও ষষ্ঠ ইউনিটের নির্মাণকাজ শিগগিরই শুরু হবে। এ দুই ইউনিটের নির্মাণ খরচ হবে ৫ হাজার কোটি রুপি (৭ হাজার ১১০ কোটি ৭৮ লাখ টাকার কিছু বেশি)। অর্থাৎ ছয় ইউনিট নির্মাণে মোট ব্যয় হবে বাংলাদেশি টাকায় প্রায় ৮৯ হাজার কোটি টাকা।
সে হিসেবে, একই প্রযুক্তি ব্যবহার করেও ভারতে নির্মিত পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের তুলনায় দ্বিগুণের বেশি খরচ হচ্ছে রূপপুরে। শুধু তাই নয়; এ নির্মাণ-ব্যয়ে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, বেলজিয়াম, জাপান, ফিনল্যান্ড, স্লোভাকিয়া রিপাবলিক, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ভারত, এমনকি রাশিয়াকেও পেছনে ফেলেছে বাংলাদেশ। প্রতি ইউনিটে নির্মাণ ব্যয়ের হিসাব করলে বাংলাদেশের চেয়ে বেশি খরচ হয় কেবল যুক্তরাজ্যে। এশিয়ার সব দেশ তো বটে-ই; এমনকি ফ্রান্স ও রাশিয়ার চেয়ে বাংলাদেশের নির্মাণ ব্যয় অনেক বেশি। যে কারণে রূপপুরের এই ব্যয় পর্যালোচনার তাগিদ দিয়ে তা সংশোধনের পরামর্শ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে সিপিডি’র গবেষণা পরিচালক গোলাম মোয়াজ্জেম বলেছেন, ভারতের যেসব পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রগুলোর উদাহরণ দেয়া হয়, সেগুলোর থেকে অনেক বেশি ব্যয়বহুলভাবে বাংলাদেশে তৈরি করা হচ্ছে। যেটা কোনো বিচারেই তুলনীয় নয়। কী কারণে আসলে এমন চুক্তিটি হয়েছে কিংবা আমাদের কী পরিমাণ অপচয় হচ্ছে, সেটা হয়ত খতিয়ে দেখা যেতে পারে।
আমাদের দেশের পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের ব্যয় অস্বাভাবিক রকমের বেশি বলে অভিযোগ বুয়েটের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক হাসিব চৌধুরীরও।
তিনি জানান, বিদ্যুৎখাতের যে কমিশনটি এগুলো তদন্ত করবে, সেই কমিশনটিকে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্রের প্রোজেক্টটি-ও দেখতে হবে। সেই সঙ্গে তদন্ত করতে হবে, কেন এত ব্যয়বহুল এই কেন্দ্র। প্রকল্প ব্যয়ের অর্থ তছরুপের কোনো সুযোগ নেই বলে জানিয়েছেন কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশনের জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম।
তিনি বলেন, এখন-তো সবকিছুর একটা আদর্শ অনুশীলন রয়েছে। স্ট্যান্ডার্ডের থেকে বেশি দিলে, কেউ খেয়ে হজম করতে পারবে না। শুধু, রাষ্ট্র সেটিকে চিহ্নিত করে ঘোষণা দিতে হবে। আর সেই ডিক্লারেশন যদি থাকে, তাহলে আদালত থেকে সেটি আদায় করে নেয়া সম্ভব। ভোক্তার স্বার্থ খর্ব করছে, এমন কোনো শক্তি এখন এই যুগে নেই। প্রসঙ্গত, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের জন্য পাবনার রূপপুরে এক হাজার বাষট্টি একর জমির ওপর প্রকল্পটি বাস্তবায়নে রাশিয়ার রাষ্ট্রীয় সংস্থা রোসাটমের সঙ্গে চুক্তি হয়েছিল ২০১৬ সালে। এর পরের বছর থেকে নির্মাণ কাজ শুরু হয়। বিদ্যুৎকেন্দ্রটি পূর্ণ উৎপাদনে এলে এখান থেকে ২ হাজার ৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ মিলবে। বিশাল এই প্রকল্পের ৯০ শতাংশই রাশান ঋণ। সেই ঋণ সুদসহ পরিশোধ করতে হবে বাংলাদেশকে।