পশ্চিমে তেঁতুলিয়া দক্ষিণে মেঘনা উত্তরে ইলিশা নদী ও দক্ষিণে বঙ্গোপসাগর এর মাঝে নদী বেষ্টিত দ্বীপ জেলা ভোলা। প্রতি বছর দেশের ৫০ শতাংশ ইলিশ রপ্তানি হয় এই জেলা থেকে।
গত প্রজননের মৌসুমে ইলিশ বেশি ডিম ছেড়েছে। নদী সাগরে জাটকার সংখ্যাও বেশি। কিন্তু জাটকা সংরক্ষণের যথাযথ উদ্যোগ না থাকায় ইলিশ প্রজননের লক্ষ্যমাত্রা পূরণ হবে না বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। পোনাকে একটি বড় ইলিশে পরিণত করতে সরকারের নানা উদ্যোগ থাকলেও মৎস্য বিভাগের উদাসীনতা ও লোকবল ও অর্থসংকটের কারণে তা ভেস্তে যাচ্ছে। এ কারণে ভোলার নদ-নদী ও সাগর মোহনা থেকে জেলেরা অবাধে জাটকা নিধন করছেন।
ভোলার কয়েকজন জেলে নেতা বলেন, জাটকা সংরক্ষণের জন্য আট মাস (জুন-নভেম্বর) মৎস্য বিভাগের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের কঠোর নজরদারির নির্দেশনা থাকলেও বাস্তবে নদীতে অভিযান নেই বললেই চলে। ভোলায় অবৈধ জাল দিয়ে প্রতিদিন কমপক্ষে ৪০০ মেট্রিক টন জাটকা ধরা পড়ছে। তবে প্রতিদিন জাটকা ধরার পরিমাণ ৪০০ মেট্রিক টন নয় বলে দাবি করেছে মৎস্য বিভাগ। তারা বলছে, প্রতিদিন ২০০ মেট্রিক টন জাটকা ধরা পড়ছে।
জাটকা নিধন বন্ধে যথাযথ উদ্যোগ না নিতে পারার কথা স্বীকার করে মৎস্য বিভাগ বলছে, প্রতিদিন একবার অভিযান চালাতে গেলে ভোলার সাত উপজেলায় কমপক্ষে এক লাখ টাকা দরকার। সেখানে আট মাসেও এক লাখ টাকা বরাদ্দ পাওয়া যায়নি। এ ছাড়া লোকবল সংকটের কারণেও সব সময় অভিযান চালানো সম্ভব হয় না।
ভোলা মৎস্য অফিস সূত্র জানায়, ভোলায় এই অর্থবছরে (২০২৩-২৪) ইলিশ আহরণের লক্ষ্যমাত্রা ১ লাখ ৯১ হাজার মেট্রিক টন। আর দেশে ৬ লাখ মেট্রিক টন। সারা দেশে গত অর্থবছরে (২০২২-২৩) উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল ৫ লাখ ৬৬ হাজার মেট্রিক টন। আর ভোলায় গত অর্থবছরে উৎপাদন হয়েছে ১ লাখ ৯১ হাজার ৬৮৩ মেট্রিক টন। ভোলায় গত আড়াই মাসে প্রতিদিন গড়ে ৫০০ মেট্রিক টন ইলিশ মাছ আহরণ হয়েছে।
ভোলার ২৫টি মাছঘাটের জেলে, আড়তদার ও জেলে নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ভোলায় যদি প্রতিদিন ৫০০ মেট্রিক টন ইলিশ ধরা হয়, তাহলে তার মধ্যে জাটকার পরিমাণ ৪০০ মেট্রিক টনের (৮০ শতাংশ) বেশি। তবে জেলা মৎস্য বিভাগ এই তথ্য মানতে নারাজ। তবে তারা প্রতিদিন মোট আহরণের ৪০ শতাংশ (২০০ মেট্রিক টন) জাটকা হতে পারে!
ভোলা খালের মাথা মাছঘাটে গিয়ে দেখা যায়, সেখানে জাটকার মেলা বসেছে। পাইকার মাছ কিনে বরফ দিয়ে বাকসে ঢোকাচ্ছে। এক পাইকারের বাকসে দেখা যায়, নানা প্রজাতির মাছের পোনা ও জাটকা। মাছগুলো এত ছোট যে এক কেজিতে শতাধিক মাছ হবে। এক কেজি মাছের খুচরা দাম ২০০ টাকা। ঘাটে প্রবেশ পথের ডানপাশে আরেকটি বাকসের ওপর বসানো টিনের থালায় আরও ছোট ছোট মাছের পোনা, ইলিশের জাটকা দেখা যায়। এ জাটকা সাধারণত অবৈধ পাই ও বেহুন্দি জাল দিয়ে ধরা হচ্ছে। এ মাছ বড় হলে ৫০ হাজার টাকা বিক্রি হতো। কিন্তু আমরা দাদন দিয়ে ঠেকেছি। তাই জেলেরা যা ধরে আনেন, তা-ই ডাক ওঠাই।
এ ঘাটের জেলে মো. জসিম উদ্দিন মাঝি ১৭ হালি (চারটিতে এক হালি) জাটকা, সাড়ে সাত হালি টোল্লা (জাটকা থেকে একটু বড়) আর এক হালি মাঝারি আকারের ইলিশ পেয়েছেন। জাটকার হালি ১৮০ টাকা, টোল্লার হালি ৫৬০ টাকা ও মাঝারির হালি ২ হাজার ৪৫০ টাকা দাম উঠেছে। সব মিলিয়ে দাম উঠেছে ৮ হাজার ৭৬০ টাকা। আড়তদার মো. কবির হোসেন আক্ষেপ করে বলেন, ‘এ মাছ বড় হলে কমপক্ষে ৫০ হাজার টাকা বিক্রি হতো। কিন্তু আমরা দাদন দিয়ে ঠেকেছি। তাই জেলেরা যা ধরে আনেন, তাই ডাক ওঠাই।’
নাম প্রকাশ না করার শর্তে জেলা মৎস্য কার্যালয়ের কয়েকজন কর্মকর্তা জানান, ভোলায় বিশাল জলরাশির জাটকা সংরক্ষণে যে লোকবল দরকার, তা মৎস্য বিভাগের নেই। জেলা-উপজেলা কার্যালয়ে ৬০টি পদ থাকলেও ১৮ জনকে দিয়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে কার্যক্রম। এখানে কয়েক উপজেলার কর্মকর্তা-কর্মচারীদের নিয়ে একটি অভিযান দল গঠন করা দরকার। কর্মকর্তারা আরও বলেন, প্রতিটি উপজেলায় একটি স্পিডবোট ও একটি দ্রুতগামী ট্রলার দরকার। কিন্তু পুরো জেলায় আছে দুটি স্প্রিডবোট। তাও তেলের সংকট। জেলে-আড়তদারের নিকট ট্রলার ধার নিয়ে অভিযান চালাতে গেলে শতভাগ সফল হওয়া যায় না। টানা আট মাস অভিযান চালাতে বললেও বরাদ্দ নেই বললেই চলে।
জেলা মৎস্য কার্যালয় সূত্র জানায়, সাত উপজেলায় প্রতিদিন একবার অভিযান চালাতে গেলে কমপক্ষে ১ লাখ টাকা দরকার, সেখানে গত কয়েক মাস চলে গেলেও কোনো বরাদ্দ আসেনি।
ভোলা জেলা ক্ষুদ্র জেলে ও মৎস্যজীবী সমিতির সভাপতি নুরুল ইসলাম বলেন, দরিদ্র জেলেদের জাল, মাছ জব্দ করে জাটকা ধরা বন্ধ করা যাবে না। নদীতে নেমে ভয় দেখালে জেলেরা জাটকা শিকারে নামবেন না।
ভোলা জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব লোকবল ও নৌযান সংকটের কথা উল্লেখ করে বলেন, জাটকা ধরা পড়ছে, তবে সব জাটকা নয়। তবে জাটকা নিধন না করার জন্য জেলেদের সচেতনতা করা হচ্ছে। জাটকা সংরক্ষণে সবার এগিয়ে আসা উচিত।