মধ্যপ্রাচ্যে চলমান উত্তেজনার মধ্যে ইরান ও রাশিয়ার ক্রমবর্ধমান জোট পশ্চিমাদের জন্য বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বিশেষ করে ইউক্রেন যুদ্ধের সময় রাশিয়াকে ইরান সহযোগিতা করার পর থেকে এই জোটের প্রভাব আরও বৃদ্ধি পাচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্যে উত্তেজনার প্রেক্ষাপটে ইরান-রাশিয়ার ঘনিষ্ঠতা পশ্চিমা বিশ্বকে নতুনভাবে শঙ্কিত করছে। ফরাসি বার্তা সংস্থা এএফপির এক প্রতিবেদনে এসব কথা উঠে এসেছে। ইরান ও রাশিয়া একসময় আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ছিল। কিন্তু গত কয়েখ বছরে তারা সেই পুরোনো বৈরিতা ভুলে এক যোগে পশ্চিমাদের মোকাবিলায় মনোযোগ দিচ্ছে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লালাদিমির পুতিন ও ইরানের প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ানের মধ্যে আসন্ন বৈঠক দুই দেশের সম্পর্কের এক নতুন প্রতীক হিসেবে উঠে এসেছে। তারা তুর্কমেনিস্তানে প্রথম মুখোমুখি সাক্ষাৎ করবেন। পাশাপাশি ইরানি প্রেসিডেন্ট শিগগিরই রাশিয়া সফর করবেন। পশ্চিমা দেশগুলো ইরানকে অভিযুক্ত করেছে যে তারা রাশিয়াকে প্রাণঘাতী ড্রোন ও ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করছে। যা ইউক্রেনে রাশিয়ার যুদ্ধযন্ত্রের অন্যতম চালিকা শক্তি হিসেবে কাজ করছে। কম দামে সহজলভ্য অস্ত্র হওয়ার কারণে তা ইউক্রেনে রুশ আক্রমণকে সহজতর করছে। ইরান-ইসরায়েলের পাল্টাপাল্টি হামলার উত্তেজনায় এই জোট আরও মজবুত হয়ে উঠতে পারে। কারণ উভয় দেশ আন্তর্জাতিকভাবে একঘরে হয়ে পড়ার পর থেকে একে অপরের সহযোগিতার ওপর নির্ভরশীল। ক্যার্নেগি এনডাউমেন্ট ফর ইন্টারন্যাশনাল পিসের ফেলো নিকোল গ্রাজেভস্কি বলেন, ‘ইরান থেকে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহের বিষয়টি ইঙ্গিত দেয় যে দুই দেশের প্রতিরক্ষা অংশীদারিত্ব ক্রমশ গভীর হচ্ছে। এটি ড্রোন ছাড়াও আরও উন্নত অস্ত্র সরবরাহে বিস্তৃত হচ্ছে।’ পশ্চিমা দেশগুলো অভিযোগ করছে যে ইরান রাশিয়াকে ফাত-৩৬০ ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র সরবরাহ করছে। এগুলোর পাল্লা প্রায় ১২০ কিলোমিটার। যুক্তরাষ্ট্রের শঙ্কা, এগুলো রাশিয়াকে আরও উন্নত দূরপাল্লার ক্ষেপণাস্ত্রের মজুত অটুট রাখতে সাহায্য করবে। ইউক্রেন যুদ্ধের ক্ষেত্রে রুশ বাহিনীর গুরুত্বপূর্ণ কৌশল হিসেবে এটি কাজ করছে। পশ্চিমা কর্মকর্তারা এখনও পুরোপুরি নিশ্চিত নন যে, মধ্যপ্রাচ্যের উত্তেজনা ইরান-রাশিয়ার অস্ত্র সরবরাহের গতিবৃদ্ধিতে কেমন প্রভাব ফেলবে। একজন উচ্চপদস্থ পশ্চিমা কর্মকর্তা বলেন, ‘আমরা এখনও নিশ্চিত নই যে, বর্তমান পরিস্থিতি ইরানের অস্ত্র সরবরাহে কেমন ভূমিকা রাখবে।’
ইরানের প্রথম পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ করেছিল রাশিয়া। ২০১৫ সালের ইরান পারমাণবিক চুক্তিতে অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছিল মস্কো। তবে সাবেক মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্রকে ওই চুক্তি থেকে সরিয়ে আনার পর থেকে পরিস্থিতি বদলে যায়। এখন রাশিয়া ইরানকে পারমাণবিক শক্তি থেকে বিরত রাখতে আগ্রহী নয়। বরং মস্কো তেহরানকে এই পথে এগিয়ে যেতে উৎসাহিত করতে পারে বলে মনে করা হচ্ছে। অ্যাটলান্টিক কাউন্সিলের একটি রিপোর্টে বলা হয়েছে, ‘ইউক্রেন যুদ্ধের সময় রাশিয়াকে ড্রোন ও অন্যান্য সহায়তা দিয়েছে ইরান। ফলে মস্কো ইরানকে পারমাণবিক অস্ত্র থেকে বিরত রাখার চেষ্টা করবে, এমন আশা যুক্তরাষ্ট্র করতে পারে না। বরং, পুতিন সরকার পারমাণবিক শক্তি সম্পন্ন ইরানকে স্বাগত জানাতে পারে। কারণ এটি পশ্চিমাদের মনোযোগ ইউক্রেন যুদ্ধ থেকে সরিয়ে দিতে পারে।’ দুই দেশের সম্পর্ক বহুমুখী ফোরামে সম্প্রসারিত হয়েছে। ইরান প্রেসিডেন্ট মাসুদ পেজেশকিয়ান অক্টোবর মাসে কাজান শহরে রাশিয়া-চীন নেতৃত্বাধীন ব্রিকস গোষ্ঠীর শীর্ষ সম্মেলনে অংশ নিতে যাচ্ছেন। ব্রিকস গোষ্ঠীতে এই বছর ইরানকে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। রাশিয়া-ইরান সম্পর্কের গভীরতা সম্পর্কে গ্রাজেভস্কি বলেন, ‘রাশিয়া ও ইরান এখন ক্রমশ একে অপরের ওপর নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। এটি শুধু একটি লেনদেনের সম্পর্ক নয়, বরং উভয় দেশই একে অপরকে তাদের শাসন ক্ষমতার স্থায়িত্বের জন্য অপরিহার্য মনে করছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘এটি স্পষ্ট যে সম্পর্কের মধ্যে কিছু উত্তেজনা রয়েছে। তবে তারা সম্পর্কের বিভিন্ন দিকগুলোকে আলাদা করে ম্যানেজ করতে পারছে।’
ঐতিহাসিকভাবে ইরান-রাশিয়ার মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দীর্ঘকাল ধরে চলে আসছে। ১৯ শতকের ‘গ্রেট গেম’-এর সময় কাসপিয়ান অঞ্চল, ককেশাস ও মধ্য এশিয়ায় এই দুই দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতা ছিল অন্যতম উল্লেখযোগ্য। এর মধ্যে ১৮২৯ সালে রুশ নাট্যকার আলেক্সান্ডার গ্রিবয়েদভের হত্যাকাণ্ড রয়েছে। তিনি তেহরানে রাশিয়ার রাষ্ট্রদূত ছিলেন। দুই দেশের প্রতিদ্বন্দ্বিতার অন্যতম প্রতীকী ঘটনা হিসেবে এটিকে বিবেচনা করা হয়। তবে ইরান ও রাশিয়া বর্তমান পরিস্থিতির আলোকে তাদের মধ্যে থাকা উত্তেজনাগুলোকে কমিয়ে আনতে আগ্রহী। রাশিয়ার জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদের প্রধান সের্গেই শোইগু ও ইরানের প্রতিরক্ষা প্রধান আলী আহমাদিয়ান বিভিন্ন সময় কূটনৈতিক সফর চালিয়ে যাচ্ছেন।