রাষ্ট্রের শুধু পোশাক পরিবর্তন হয়েছে, রাষ্ট্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন প্রাবন্ধিক ও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইমেরিটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। গতকাল রোববার রোববার জাতীয় প্রেসক্লাবের তোফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া হলে কমরেড আ ফ ন মাহবুবুল হকের সপ্তম মৃত্যুবার্ষিকীতে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে বামপন্থিদের ভূমিকা এবং করণীয় শীর্ষক আলোচনা সভায় প্রধান আলোচকের বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন। সভার আয়োজন করে আ ফ ন মাহবুবুল হক স্মৃতি সংসদ। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, আইয়ুব বিরোধী ’৬৯-এর যে অভ্যুত্থান, সেই অভ্যুত্থানের চালিকাশক্তি ছিল বামপন্থিরা।
এর সূত্রপাত মওলানা আবদুল হামিদ খান ভাসানী করেছিলেন। তিনিই ছিলেন এর পরিচালক। বামপন্থিদেরই এখানে বড় ভূমিকা ছিল। কিন্তু আমরা ’৭০ এর নির্বাচনে কী দেখলাম, ক্ষমতা চলে গেল বুর্জোয়াদের হাতে। রাষ্ট্র ভাঙল না, রাষ্ট্র বদলাল না। তিনি বলেন, রাষ্ট্র ’৪৭-এ বদলায়নি, রাষ্ট্র ’৭১-এ বদলায়নি। রাষ্ট্র যা ছিল, তা-ই রয়ে গিয়েছে। যে ঔপনিবেশিকতা ছিল ব্রিটিশ আমলে, পাকিস্তানিরা এসে সেরকমই একটি নতুন অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ তৈরি করার চেষ্টা করেছিল। সেই উপনিবেশের বিরুদ্ধেই লড়াই হচ্ছিল। সেই লড়াইয়ে প্রধান ভূমিকায় ছিল বামপন্থিরা। তিনি আরো বলেন, কিন্তু তারা রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করতে পারেনি। এর একটি বড় কারণ ছিল বিভাজন। চীনপন্থি ও রুশপন্থিদের বিভাজন। এতে কত বড় ক্ষতি হয়েছে, তা আমরা পরিমাপ করতে পারব না। রাষ্ট্রক্ষমতা বুর্জোয়াদের হাতে চলে গেল এবং সেই বুর্জোয়ারাই তারপর থেকে শাসন করতে থাকলো। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এখন রাষ্ট্র তো বদল হয়নি, রাষ্ট্র তো একই রাষ্ট্র রয়েছে। তার আইন-কানুনে মিল আছে। শুধু নামে বদলেছে, আয়তনে ছোট হয়েছে। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তে একটি অভ্যন্তরীণ উপনিবেশ ছিল, জমিদারদের উপনিবেশ। আজ বাংলাদেশে আমরা উপনিবেশই দেখছি; আরেক ধরনের উপনিবেশ, ধনীদের উপনিবেশ। তিনি বলেন, ঔপনিবেশিক শাসকেরা যেমন এ দেশের সম্পদ বিদেশে পাচার করত, দেশকে তারা নিজেদের দেশ মনে করতো না, আজ বাংলাদেশের ধনীরা সেই কাজই করে। তারাই তো আমাদের সম্পদ পাচার করে, ব্যাংক লুট করে, লুণ্ঠন চালায়। আর যতভাবে পারে অর্থ সঞ্চয় করে।
এই অধ্যাপক আরো বলেন, কাজেই রাষ্ট্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি চরিত্রগতভাবে। বানর যদি মানুষের পোশাক পরে, তাহলে কি সে মানুষ হয়ে যায় ? ওই পোশাক পরলেই কি বানর মানুষ হয়ে যাবে? রাষ্ট্র তো ওই বানরই রয়ে গেছে। তার পোশাক বদল হয়েছে, রাষ্ট্রের কোনো পরিবর্তন হয়নি। সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেন, এখন যে অভ্যুত্থান ঘটল, সেই অভ্যুত্থানে কোনো বিপ্লব ঘটেনি। এক চরম ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন ঘটেছে। এই পতন নির্বাচনের মধ্য দিয়ে ঘটতো, ঘটতে পারতো। তাহলে আজ যারা পলাতক, তাদের পালাতে হতো না, তারা বেঁচে যেত। কিন্তু তারা তা চায়নি বলেই এ অভ্যুত্থান হয়েছে। একটি ফ্যাসিস্ট সরকারের পতন হয়েছে। আজ পৃথিবীজুড়েই পুঁজিবাদ ফ্যাসিবাদের রূপ নিয়েছে। তিনি বলেন, এ সময়ে প্রতিটি গ্রাম-ইউনিয়নে যুক্তফ্রন্ট গঠন করতে হবে। তাহলে এখন যে ছাত্ররা বিভ্রান্ত হয়ে ঘুরছে, পথের সন্ধান পাচ্ছে না, তারা পথের সন্ধান পাবে। আর এ নির্বাচনের পরে যে নির্বাচন হবে, তখন দেখা যাবে বামপন্থিরাই এর প্রধান শক্তি হয়ে দাঁড়িয়েছে। কাজেই করণীয় হিসেবে আমরা আমাদের যে আন্দোলন, তা এগিয়ে নিয়ে যাব। সমাজ পরিবর্তনের আন্দোলন এগিয়ে নিয়ে যাব। সমাজকে বিপ্লবের দিকে এগিয়ে যাব। তিনি আরো বলেন, আমাদের যুক্তফ্রন্ট গঠনের দিকে এগিয়ে যেতে হবে। এ সুযোগ যদি আমরা হারাই, তাহলে যে শুধু আমাদের জন্য ক্ষতিকর হবে তা নয়, বরং সারা দেশের জন্য ক্ষতিকর হবে।
ফ্যাসিবাদ আরো নৃশংস হবে, আরো নোংরা হবে। তাই আমার ধারণা একটি যুক্তফ্রন্ট গঠন করুন এবং সেই যুক্তফ্রন্ট গঠন করেই আমরা প্রথম পদক্ষেপটা নিতে পারি। তাই এখন সময় নষ্ট করার সময় নয়। দ্রুত গতিতে এ কাজটি করতে হবে। আলোচনা সভায় অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, যে বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ, এডিবির অর্থায়নের কারণে বাংলাদেশে বৈষম্য বেড়েছে এবং শিক্ষা-চিকিৎসার বাণিজ্যিকীকরণ হয়েছে। পাশাপাশি আমাদের এখানে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত ভয়ংকর রকম শঙ্কার মধ্যে পড়েছে। সেই বিশ্ব ব্যাংক ও আইএমএফ যদি এখনো দাপট নিয়ে চলে এবং এ সরকার যদি তাদের ওপর ভরসা করে এখনো অর্থনীতিকে পুনর্গঠনের চিন্তা করে, তাহলে পরিবর্তনটা কোথায় হচ্ছে? পরিবর্তনের যে আকাঙ্ক্ষা ও শক্তি প্রয়োজন ছিল, তার একটি অংশ জনগণের মধ্যে আছে। দেয়ালে দেয়ালে আঁকা গ্রাফিতিগুলোর মধ্যে যে আকাঙ্ক্ষা আছে, তা সরকার বাস্তবায়ন করতে পারেনি উল্লেখ করে তিনি বলেন, গ্রাফিতিগুলোর মধ্যে যে ভাব, ভাষা ও তাগিদ আছে, তার কোনো প্রতিফলন আমরা সরকারের মধ্যে দেখছি না। দেয়ালের গ্রাফিতি ও আন্দোলনে যে আকাঙ্ক্ষাগুলো তৈরি হয়েছিল, তার সঙ্গে সরকারের ভূমিকা ও তৎপরতার বড় অসঙ্গতি দেখা যাচ্ছে।
অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ বলেন, আমি মনে করি দেয়ালের গ্রাফিতিই হলো সমাজের সেই শক্তির প্রকাশ, যে শক্তি একটি বড় ধরনের মৌলিক পরিবর্তন চায়। আর সেই মৌলিক পরিবর্তনের ভাষা যদি আমরা বুঝতে পারি এবং সেই ভাষা বুঝে যদি একটি সাংগঠনিক প্রস্তুতির মাধ্যমে নিজেদের পুনর্গঠন করে অতীতের ভুল থেকে শিক্ষা নিতে পারি, তাহলে নিশ্চয়ই একটি বড় পরিবর্তনের দিকে আমরা যেতে পারব।