ভোটের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরানো হবে নতুন কমিশনের মূল কাজ

প্রকাশ : ২৪ নভেম্বর ২০২৪, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

অন্তর্বর্তী সরকারের সদ্য গঠিত নির্বাচন কমিশনকে (ইসি)-এরই মধ্যে স্বাগত জনিয়েছে রাজনৈতিক দলগুলো। এ কমিশন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ নির্বাচন উপহার দেবে বলেও প্রত্যাশা দলগুলোর নেতাদের।

নিয়োগ পেয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) এএমএম নাসির উদ্দীনও একটি সুন্দর নির্বাচনের প্রতিশ্রুতি দিয়েছেন। তিনি বলেছেন, এত মানুষের রক্তের সঙ্গে বেইমানি করা কোনোভাবেই সম্ভব নয়। নতুন এই কমিশন শপথ নিতে যাচ্ছে আজ রোববার। দুপুরে সুপ্রিমকোর্ট লাউঞ্জে প্রধান বিচারপতি সৈয়দ রেফাত আহমেদ নবনিযুক্ত পাঁচ কমিশনারের শপথ পড়াবেন বলে প্রধান বিচারপতির দপ্তর জানিয়েছে। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করছেন, নির্বাচন কমিশন গঠনের মধ্য দিয়ে অন্তর্বর্তী সরকারের নির্বাচনী কার্যক্রম শুরু হয়েছে।

এদিকে নতুন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর তাদের চ্যালেঞ্জ এবং অগ্রাধিকার কী হতে পারে, তা নিয়ে নানা আলোচনা রয়েছে। নির্বাচন বিশ্লেষকরা বলছেন, ভোটের নামে বিগত তিনটি নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সঙ্গে চরম তামাশা করা হয়েছে। ভোটের কথা বলা হলেও এসব নির্বাচনে জনগণ ছিল ভোটাধিকার বঞ্চিত।

ইসি এবং ভোটের প্রতি রাজনৈতিক দল এবং সাধারণ মানুষের আস্থা উঠে গেছে। সেজন্য ভোটের প্রতি মানুষের আস্থা ফেরানোই নতুন কমিশনের মূল কাজ হবে। মানুষকে ভোটে আনাই হবে মূল চ্যালেঞ্জ। সেটি অর্জনে ইসির কেন্দ্র থেকে মাঠ পর্যন্ত কোনো স্তরে কর্তৃত্ববাদী কেউ থাকলে তাদের সরিয়ে প্রশাসন ঢেলে সাজাতে হবে কমিশনকে।

নির্বাচন কমিশন সূত্রগুলো জানায়, দায়িত্ব নিয়ে শুরুতেই ভোটার তালিকায় হাত দিতে হবে নতুন কমিশনকে। জাতীয় নির্বাচনের আগেই করতে হতে পারে স্থানীয় সরকারের সব নির্বাচন। এ ছাড়া কমিশনের রুটিন অনেক কাজ থমকে আছে। দায়িত্ব নিয়ে সেগুলোও শেষ করতে হবে নতুন কমিশনকে।

সাবেক সচিব এ এম এম নাসির উদ্দীনকে সিইসি পদে নিয়োগ দিয়ে গত বৃহস্পতিবার প্রজ্ঞাপন জারি করেছে সরকার। একই সঙ্গে কমিশনার হিসেবে চারজনকে নিয়োগ দেওয়া হয়। তারা হলেন সাবেক অতিরিক্ত সচিব মো. আনোয়ারুল ইসলাম সরকার, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ আবদুর রহমানেল মাছউদ, সাবেক যুগ্ম সচিব তহমিদা আহমদ এবং ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) আবুল ফজল মো. সানাউল্লাহ। নির্বাচন কমিশন গঠনে যোগ্য ব্যক্তি খুঁজে পেতে সরকার গঠিত সার্চ কমিটির সুপারিশের আলোকে রাষ্ট্রপতি এ নিয়োগ দেন। আজ রোববার শপথের মধ্য দিয়ে আনুষ্ঠানিকভাবে দায়িত্ব নেবে নতুন কমিশন। তাদের বরণে এরই মধ্যে সব ধরনের প্রস্তুতি সেরে রেখেছে ইসি সচিবালয়। সিইসি ও নির্বাচন কমিশনারদের জন্য বরাদ্দকৃত কক্ষগুলো ধুয়েমুছে এবং রং করে নতুনভাবে সাজানো হয়েছে। প্রস্তুত রয়েছে সরকারি গাড়িগুলোও।

রেওয়াজ অনুযায়ী, আগামী পাঁচ বছরের জন্য দায়িত্ব পাওয়া এই কমিশনের অধীনেই পরবর্তী জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। পাশাপাশি অন্তর্র্বতী সরকারের ভেঙে দেওয়া সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ, পৌরসভাসহ বিভিন্ন স্থানীয় সরকার নির্বাচনগুলোও এ কমিশনের অধীনে অনুষ্ঠিত হবে।

সরকারের একাধিক সূত্র জানায়, রাজনৈতিক দলগুলোর নানামুখী চাপ সত্ত্বেও ২০২৬ সালে জাতীয় নির্বাচনের সম্ভাব্য টার্গেট করে এগোচ্ছে শান্তিতে নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস নেতৃত্বাধীন অন্তর্র্বতী সরকার। বৃহস্পতিবার সরকারের একজন উপদেষ্টা বলেছেন, প্রয়োজনীয় সংস্কার শেষে ছাব্বিশের মাঝামাঝি সময়ে এ নির্বাচন হতে পারে। তবে তার আগে স্থানীয় সরকারের নির্বাচনগুলো সেরে নেওয়া হতে পারে বলে সরকারের সূত্রগুলো বলছে।

সূত্রগুলো জানায়, আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে নির্বাচন হওয়া সিটি করপোরেশন, জেলা পরিষদ, উপজেলা পরিষদ ও পৌরসভাগুলো থেকে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের সরিয়ে এসব জায়গায় প্রশাসক নিয়োগ দিয়েছে অন্তর্র্বতী সরকার। ফলে স্থানীয় সরকারের নানান ধরনের সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে দেশের জনগণ। ফলে জাতীয় নির্বাচনের আগে এসব নির্বাচন সেরে নিতে চায় সরকার। এরপরই জাতীয় নির্বাচনের দিকে যাবে। তবে এসব নির্বাচনের মাঝেও জাতীয় নির্বাচনকেন্দ্রিক কিছু কাজ এগিয়ে রাখবে কমিশন।

ইসি সূত্র বলছে, নতুন কমিশনকে দায়িত্ব নিয়ে শুরুতেই ভোটার তালিকায় হাত দিতে হবে। বিগত সরকারের ভোটার তালিকা নিয়ে সরকারের উপদেষ্টারাও নানা সমালোচনামূলক বক্তব্য দিয়েছেন। এ ছাড়া নীতিমালা ও রেওয়াজ অনুযায়ী, প্রতি বছর জানুয়ারি মাসের ২ তারিখ থেকে মার্চ মাসের ২ তারিখের মধ্যে খসড়া তালিকা প্রণয়ন করতে হয়। সে বিষয়টি সামনে রেখে জানুয়ারির আগেই নতুন কমিশন সাজানো হয়েছে। এ কমিশন দায়িত্ব নিয়ে শুরুতেই ভোটার তালিকা নিয়ে কাজ শুরু করবে। যদিও এবার বাড়ি বাড়ি গিয়ে ভোটার তালিকা হালনাগাদ সম্ভব হবে না বলে ইসি থেকে আগেই জানিয়ে দেওয়া হয়েছিল। আর ২০২৬ সালে নির্বাচন হলে এবারের তালিকা থেকে নির্বাচন হওয়ার কোনো সম্ভাবনাই নেই। ওই বছরের হালনাগাদ তালিকা থেকেই জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।

সূত্র আরও জানায়, নির্বাচন কমিশনের অভাবে নিয়মিত কিছু পদোন্নতি থমকে আছে। এসব পদোন্নতি সচিব একা দিতে পারেন না। সেজন্য এ কমিশন দায়িত্ব নেওয়ার পর পদোন্নতির এসব জট কেটে যাবে। পাশাপাশি কমিশনের অভাবে থমকে থাকা অন্য কাজগুলো সেরে নিতে হবে।

নির্বাচন বিশেষজ্ঞরা বলছেন, রাজনৈতিক দলগুলো নতুন কমিশনকে স্বাগত জানালেও দলগুলোর আস্থা অর্জনে তাদের সঙ্গে আনুষ্ঠানিকভাবে বসতে হবে নাসির উদ্দীন কমিশনকে। দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ বা মতবিনিময়ের মধ্য দিয়ে বিভিন্ন বিষয়ে দলগুলোর সুপারিশ এবং আস্থা তৈরি হবে। আর সর্বোপরি নির্বাচনের তপশিলের পর পুরো প্রশাসন ঢেলে সাজাতে হবে। এতে ভোট এবং নির্বাচনকালীন মাঠ প্রশাসনের ওপর জনগণের আস্থা তৈরি হবে।

তাদরে মতে, শেষ তিনটি জাতীয় নির্বাচনসহ স্থানীয় সরকারের ভোটে ব্যাপক অনিয়ম ও জালিয়াতির ঘটনায় নির্বাচন ব্যবস্থা পুরোপুরি ধ্বংস হয়ে গেছে। ভোট থেকে সাধারণ মানুষ মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। ভোটারের মনে আস্থা ফিরিয়ে আনাই হবে নতুন কমিশনের জন্য বড় চ্যালেঞ্জ। সেক্ষেত্রে নতুন কমিশনকে দক্ষতা, দূরদর্শিতা, যোগ্যতা ও প্রজ্ঞার পরিচয় দিতে হবে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, নির্বাচন কমিশনের একটি বড় দায়িত্ব ছিল নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কারের কিছু কাজ করা। তবে এ বিষয়ে একটি কমিশন আগে থেকেই কাজ করছে। ফলে নতুন কমিশনকে সেদিকে আর যেতে হচ্ছে না। নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের সঙ্গে মিলিয়ে সংস্কারের কাজ এগিয়ে নিতে হবে।

নতুন কমিশনের অগ্রাধিকারগুলো কী হওয়া উচিত বিষয়ে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী মোহাম্মদ মাহবুবুর রহমান বলেন, নতুন কমিশনের প্রথম কাজই হবে নির্বাচন কমিশন ও ভোটের প্রতি জনগণের আস্থা ফেরানো। সেজন্য শুরুতেই সারা দেশে নির্বাচন কমিশনের মাঠ প্রশাসন ঢেলে সাজাতে হবে। নির্বাচন কমিশনের কোনো স্তরে কর্তৃত্ববাদী কেউ বসে আছে কি না এবং তাদের নিয়োগ প্রক্রিয়াও খতিয়ে দেখতে হবে। প্রয়োজনে বিষয়টি দেখতে একটি কমিটিও গঠন করা যায়। না হলে কমিশনের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও কর্তৃত্ববাদীরা কমিশনকে সফল হতে দেবে না। এরপর ভোটার তালিকায় হাত দিতে হবে কমিশনকে। বিগত সরকারের ভোটার তালিকা নিয়ে নানা প্রশ্ন রয়েছে, সেগুলো খতিয়ে দেখতে হবে। এ ছাড়া ভোটার তালিকায় রোহিঙ্গাসহ অন্য কেউ থাকলে সেগুলো বের করে একটি নির্ভুল ভোটার তালিকা প্রণয়ন করতে হবে। নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিকল্পনা নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে বসতে হবে। সর্বোপরি জনগণকে সেই নির্বাচন সম্পর্কে সচেতন করে তুলতে হবে। সবার সর্বাত্মক প্রচেষ্টায় এ কমিশন একটি অবাধ, সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ ভোট উপহার দেবে বলেও আশাবাদ ব্যক্ত করেন তিনি।