তামাকের ভয়াবহতা ও আর্থিক ক্ষতির নানাদিক তুলে ধরে তামাকবিরোধী শোভাযাত্রা করেছে বিভিন্ন স্কুল, কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা। এ সময় তারা তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী দ্রুত পাসের দাবি জানান।
গতকাল বৃহস্পতিবার রাজধানীর কেন্দ্রীয় শহীদ মিনার থেকে শাহবাগ জাতীয় জাদুঘর পর্যন্ত এই তামাকবিরোধী শোভাযাত্রা অনুষ্ঠিত হয়। স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের আয়োজনে এতে বিভিন্ন স্কুল কলেজ এবং বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা অংশ নেন।
শোভাযাত্রার অংশ নিয়ে শিক্ষার্থীরা তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন ও বাস্তবায়নের বেশ কিছু দাবি তুলে ধরেন। এর মধ্যে রয়েছে- সকল পাবলিক প্লেস ও গণপরিবহনে ‘ধূমপানের জন্য নির্ধারিত স্থান’ নিষিদ্ধ করা, তামাকজাত দ্রব্যের বিক্রয়স্থলে তামাকজাত পণ্য প্রদর্শন নিষিদ্ধ করা, তামাক কোম্পানির যেকোনো ধরনের সামাজিক দায়বদ্ধতা (সিএসআর) কর্মসূচি পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা, তামাকজাত দ্রব্যের প্যাকেট/কৌটায় সচিত্র স্বাস্থ্য সতর্কবার্তার আকার ৫০ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ৯০ শতাংশ করা, বিড়ি-সিগারেটের খুচরা শলাকা, মোড়কবিহীন এবং খোলা ধোঁয়াবিহীন তামাকজাত দ্রব্য বিক্রি নিষিদ্ধ করা এবং ই-সিগারেটসহ সব ইমার্জিং টোব্যাকো প্রোডাক্টস পুরোপুরি নিষিদ্ধ করা।
কর্মসূচিতে অংশ নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় অ্যান্টি টোব্যাকো ক্লাবের ভাইস প্রেসিডেন্ট মো. হৃদয় বলেন, টোব্যাকো এটলাস ২০১৮-এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে তামাক ব্যবহারজনিত রোগে দেশে প্রতিবছর প্রায় ১ লাখ ৬১ হাজার মানুষ অকাল মৃত্যুবরণ করেন। সে হিসেবে প্রতিদিন ৪৪২টি প্রাণ অকালে ঝরে যাচ্ছে। তামাকের কারণে বিভিন্ন রোগ যেমন- হৃদরোগ, ফুসফুস, ডায়াবেটিস, দীর্ঘমেয়াদি শ্বাসরোগ, ক্যান্সার, কিডনি রোগ এবং আঘাতজনিত রোগ ক্রমেই বাড়ছে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার তথ্য মতে, তামাকের কারণে সৃষ্ট রোগের কারণে তরুণ প্রজন্মের ছেলে-ময়েরা অকালেই মৃত্যুর কোলে ঢলে পড়ছে। এই অকাল মৃত্যুরোধ হ্রাসে তামাক নিয়ন্ত্রণ আইনের সংশোধনী এখনই পাস করতে হবে।
স্বাস্থ্য সুরক্ষা ফাউন্ডেশনের পরিচালক অধ্যাপক ড. মো. রফিকুল ইসলাম বলেন, জনস্বাস্থ্য রক্ষায় যেখানে এই সংশোধিত তামাক নিয়ন্ত্রণের ছয়টি আইন দ্রুত পাস করা জরুরি সেখানে তামাক কোম্পানিগুলোর নানা রকম মিথ্যাচার এটিকে বাধাগ্রস্ত করার চেষ্টা করছে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী হলে সরকারের রাজস্ব কমে যাবে বলে তামাক কোম্পানি প্রচারণা চালাচ্ছে, যা মোটেও যুক্তিসংগত নয়। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী মৌমিতা বালা বলেন, জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের (এনবিআর) রাজস্ব তথ্য মতে, বাংলাদেশে ২০০৫ সালে যখন তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন পাস হয়, সে বছর তামাক থেকে রাজস্ব আয় ছিল দুই হাজার ৮৮৮ কোটি টাকা। পরবর্তী অর্থবছর ২০০৫-০৬ এ রাজস্ব আদায় হয় তিন হাজার ৩৫১ কোটি টাকা। ২০১৩ সালে যখন আইনটি সংশোধন করা হয়, সেই বছর তামাক থেকে সরকারের রাজস্ব আয় ছিল ১০ হাজার ১৭০ কোটি টাকা। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে তা বেড়ে দাঁড়ায় ১২ হাজার ৫৫৬ কোটি টাকা। ২০২২-২৩ অর্থবছরে তামাক খাত থেকে রাজস্ব আদায় হয়েছে ৩২ হাজার ৮২৩ কোটি টাকা। ফলে তরুণ প্রজন্ম রক্ষায় তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন শক্তিশালী করলে রাজস্ব আয় বৃদ্ধির পাশাপাশি তামাকের ব্যবহার কমবে। এমন বাস্তবতাকে এড়িয়ে তামাক কোম্পানিগুলো শুধু মুনাফা অর্জনের জন্য আইন সংশোধনের ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করছে। শোভাযাত্রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্বাস্থ্য অর্থনীতি বিভাগের ছাত্র মো. সিফাত রহমান বলেন, তামাক কোম্পানিগুলো নানা রকম গুজব ছড়াচ্ছে। কোম্পানির দাবি তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন সংশোধন হলে ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা বিপর্যয়ের মুখে পড়বে, এটি বাস্তবতার নিরিখে অযৌক্তিক। কারণ ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা শুধু সিগারেট বিক্রি করা ছাড়াও নানা রকম পণ্য বিক্রি করেন। তাই একটি পণ্যের বিক্রি বন্ধ হলে তাদের কোনো ক্ষতি হবে না। বরং দেশে ক্ষতিকর এই পণ্যের ব্যবহারের হার কমবে। তামাক নিয়ন্ত্রণ আইন হলে দেশে কর্মসংস্থান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। অথচ জাতীয় রাজস্ব বোর্ডের তথ্য অনুসারে দেশে বিড়ি কোম্পানিতে শ্রমিক নিয়োজিত আছে মাত্র ৪৬ হাজার। আর দেশের প্রায় ৯০ শতাংশ বাজার দখলে রেখেছে দুই বহুজাতিক সিগারেট কোম্পানি বিএটিবি ও জেটিআই। তামাক কোম্পানির প্রতিবেদন অনুসারে তাদের কর্মচারীর সংখ্যা মাত্র ১ হাজার ৭৬৯ জন (বিএটিবির ১ হাজার ৬৬৯ জন এবং জেটিআইয়ের প্রায় ১০০ জন)। অতএব সিগারেট কোম্পানিগুলো ৭০ লাখ লোক কাজ হারাবে বলে অপপ্রচার চালাচ্ছে। রামপুরা একরামুন্নেছা বালিকা উচ্চ বিদ্যালয় স্বাস্থ্য সুরক্ষা ক্লাবের নেতৃত্বদানকারী সাদিয়া নেয়ামত বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন টোব্যাকো কন্ট্রোল স্বাক্ষরকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ সরকার তামাক কোম্পানিগুলোকে এখনো আইনের আওতায় না এনে সুবিধা দিয়ে যাচ্ছে।