যুক্তরাষ্ট্রের ৪৭তম প্রেসিডেন্টের দায়িত্বভার নিয়ে ডোনাল্ড ট্রাম্প প্রথম যে পদক্ষেপগুলো নিয়েছেন, তার একটি হচ্ছে- জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব সুবিধা বাতিলের লক্ষ্যে নির্বাহী আদেশে স্বাক্ষর। এই ‘জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের’ অর্থ হচ্ছে, যে-ই দেশটিতে জন্মাবে, সে স্বয়ংক্রিয়ভাবেই যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হয়ে যাবে। এই নীতি বদলাবেন বলে অনেক দিন ধরেই ট্রাম্প প্রতিশ্রুতি দিয়ে আসছিলেন, ক্ষমতায় বসে সে লক্ষ্যে পদক্ষেপও নিলেন, কিন্তু এটিকে বাস্তবায়ন করা তার পক্ষে মোটেই সহজ হবে না, বলছে বিবিসি। যুক্তরাষ্ট্রে অবৈধভাবে কিংবা ক্ষণস্থায়ী ভিসায় থাকা অভিবাসীদের কোনো সন্তান জন্ম নিলে তারা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিকত্ব পাবে, এই নীতির পরিবর্তন চাওয়া হয়েছে ট্রাম্পের সোমবারের আদেশে।
তবে এটি ট্রাম্পের স্বাক্ষরের আগের সময় থেকে কার্যকর হবে, এমন কোনো ইঙ্গিত নথিতে মেলেনি। তিনি কীভাবে জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের এই সুবিধা প্রত্যাহার করে নেবেন তাও স্পষ্ট নয়। কেননা, নাগরিকত্বের এই অধিকার যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে লিপিবদ্ধ, আর তা বদলাতে কংগ্রেসের দুই কক্ষেই দুই-তৃতীয়াংশ আইনপ্রণেতারে সমর্থন লাগবে। ট্রাম্পের এই আদেশকে তুমুল আইনি প্রতিরোধও মোকাবিলা করতে হবে।
ডেমোক্র্যাট নেতৃত্বাধীন ২২টি অঙ্গরাজ্য এবং সান ফ্রান্সিসকো শহর ও ডিস্ট্রিক্ট অব কলাম্বিয়া এরই মধ্যে এ আদেশের বিরুদ্ধে চ্যালেঞ্জ ছুঁড়ে কেন্দ্রীয় সরকারের বিরুদ্ধে মামলা করে দিয়েছে বলে জানিয়েছে বার্তা সংস্থা রয়টার্স। যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের চতুর্দশ সংশোধনীর প্রথম বাক্যে ‘জন্মসূত্রে নাগরিকত্বের অধিকার’ নীতিটি বলবৎ হয়েছে। সেখানে বলা হয়েছে, ‘যুক্তরাষ্ট্র এবং এর আওতাধীন এলাকায় জন্ম নেওয়া বা আত্মীকৃত সব মানুষ যুক্তরাষ্ট্র এবং তারা যেই রাজ্যে বাস করে সেখানকার নাগরিক।’ এই নীতি অবৈধ অভিবাসীদের জন্য ‘বড় চুম্বক’ এবং এটি নথিপত্রহীন গর্ভবতী নারীদের সীমান্ত অতিক্রম করে যুক্তরাষ্ট্রে এসে সন্তান জন্মদানে উৎসাহিত করে বলে ভাষ্য কট্টর অভিবাসনবিরোধীদের। তারা টিটকারি করে একে ‘বার্থ ট্যুরিজম’ বা ‘অ্যাংকর বেবি’ নেয়ার প্রক্রিয়া হিসেবেও অ্যাখ্যা দেয়।
যেভাবে এল এ অধিকার : যুক্তরাষ্ট্রে গৃহযুদ্ধ শেষে ১৮৬৮ সালে সংবিধানে এই চতুর্দশ সংশোধনীটি গৃহীত হয়। এর আগে ১৮৬৫ সালে ত্রয়োদশ সংশোধনীতে দাসপ্রথা বিলুপ্তি হয়; এরপর এই মুক্ত, যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেয়া প্রাক্তন দাসদের নাগরিকত্বের ফয়সালা করতে দিয়ে আসে চতুর্দশ সংশোধনী। এর আগের কিছু মামলায় যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত ছিল আফ্রিকান-আমেরিকানরা যুক্তরাষ্ট্রের নাগরিক হতে পারবে না। চতুর্দশ সংশোধনী সেইসব রায় রহিত করে। পরে এক চীনা তরুণের মামলায় ১৮৯৮ সালে মার্কিন সুপ্রিমকোর্ট অভিবাসীদের সন্তানরাও যে জন্মসূত্রে নাগরিকত্ব পাবে তা নিশ্চিত করে। ওই চীনা তরুণ, ২৪ বছর বয়সী ওং কিম আর্ক যুক্তরাষ্ট্রেই জন্মান, কিন্তু একবার চীন থেকে ঘুরে আসার পর তাকে যুক্তরাষ্ট্রে প্রবেশে বাধা দেয়া হয়। এরপরই ওং আদালতের দ্বারস্থ হন। তার যুক্তি ছিল, তিনি যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেয়ায় তার বাবা-মায়ের অভিবাসন সংক্রান্ত অবস্থা চতুর্দশ সংশোধনীর প্রয়োগকে প্রভাবিত করতে পারে না। শেষ পর্যন্ত জয়ও হয় তার। ‘ওং কিম আর্ক ভার্সেস ইউনাইটেড স্টেটস মামলা স্বীকৃতি দেয় যে কারো বাবা-মায়ের গায়ের রং বা অভিবাসন বিষয়ক স্ট্যাটাস যাই হোক না কেন, যুক্তরাষ্ট্রে জন্ম নেওয়া সবাই নাগরিক হিসেবে প্রাপ্ত সকল সুবিধা পাওয়ার অধিকার রাখে। এর পর আদালত আর কখনো এই বিষয়টি পুনরায় যাচাই করে দেখেনি,’ বলেছেন মিনেসোটা ইউনিভার্সিটির ইমিগ্রেশন হিস্টোরি রিসার্চ সেন্টারের পরিচালক এরিকা লি। ট্রাম্প এই নীতি রদ করতে পারবেন? পারবেন না, মত বেশিরভাগ আইন বিশেষজ্ঞের। ‘তিনি এমন কিছু করতে যাচ্ছেন, যা অসংখ্য মানুষের মন ভেঙে দেবে। যদিও শেষ পর্যন্ত এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে আদালত। তিনি নিজে সিদ্ধান্ত নিয়ে করে ফেলতে পারবেন না, এটা এমন একটা বিষয়,’ বলেছেন মার্কিন সংবিধান বিশেষজ্ঞ ও ভার্জিনিয়া ইউনিভার্সিটির ল’ স্কুলের অধ্যাপক সাইকৃষ্ণ প্রকাশ।