লালন সাঁইয়ের স্মরণোৎসবে ফরহাদ মজহার
এদেশের সংস্কৃতিকে নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে
প্রকাশ : ১৪ মার্চ ২০২৫, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
কুষ্টিয়া প্রতিনিধি
বিশিষ্ট কবি ও চিন্তক ফরহাদ মজহার বলেছেন, নতুন স্বাধীন বাংলাদেশকে এবং এদেশের শিল্প, সংস্কৃতি ও সাহিত্য নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র হচ্ছে। দেশকে অস্থিতিশিল করতে নানান ভাবে ভারতীয় মিডিয়া ব্যস্ত হয়ে উঠেছে। ভারতীয় মিডিয়ায় দেশের শান্ত পরিবেশের সার্বিক অবস্থা এবং সেনাপ্রধানসহ নানা মিথ্যা প্রপাকান্ডা প্রচার চালাচ্ছে। আজকের এই ছেঁউড়িয়ার লালন ফকির ধামের বৃহৎ দোলপূর্ণিমার স্মরণোৎসবকে একটি খোড়া অজুহাত দেখিয়ে ৩ দিনের পরিবর্তে কাটছাঁট করে আগত ফকির গুরু, শিষ্য ও ভক্তদের সেবা না দিয়ে একদিনের অনুষ্ঠান করাই প্রমাণ করে যে, এদেশের শিল্প, সংস্কৃতি ও সাহিত্য নিয়ে গভীর ষড়যন্ত্র চলছে।
ভারতীয়রা সব সময় চেয়ে এসেছে যাতে আমরা আমাদের ভাবধারাকে নিজের মত করে প্রকাশ এবং প্রচার করতে না পারি। বৃহস্পতিবার বিকেলে বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের ছেঁউড়িয়ার আখড়া বাড়ির অডিটোরিয়ামে লালন একাডেমির আয়োজনে দোলপূর্ণিমা বা স্মরণোৎসব অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ও মুখ্য আলোচকের বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন।
উল্লেখ্য, প্রতি বছর ৩ দিনব্যাপী অনুষ্ঠান ও লালন মেলার আয়োজন করা হলেও এবারই প্রথম পবিত্র মাহে রজমানের কারণে মুক্তমঞ্চের বাইরে একাডেমি অডিটোরিয়মে ৩ দিনের পরিবর্তে কাটছাঁট করে একদিন অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। এতে বিভিন্ন জনের ভিন্নমত প্রকাশ হলেও দেশের সামাজিক পরিস্থিতি ভালো রাখতেই এই উদ্দ্যোগ নিয়েছে কুষ্টিয়া জেলা প্রশাসন এবং লালন একাডেমি।
প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি আরো বলেন, মরমি সাধক ফকির লালন সাঁইকে যুগে যুগে বাউল সম্রাট উল্লেখ করে তার মানবতার কল্যাণের ফকিরিবাদ মতামতকে ক্ষতি করে আসছে। বাউল শব্দটিকে কোন অর্থবহ করে না। বরং ফকিরদের সাথে যুক্ত করে ফকিরিবাদ খাটো করেছে। ফকির লালন সাঁই মানব সেবার ব্রত নিয়ে অসংখ্য গান লিখে গেছেন। তাঁর এই অমর সৃষ্টি সঙ্গীতে কখনই বাউল শব্দ ছিল না। তার গান কোন ধর্মের মধ্যেই সীমাবদ্ধ ছিল না। এদিকে যেমন তার সৃষ্টি ছড়িয়েছে বিশ্বে তেমনি তাকে নিয়ে হচ্ছে উন্নতর গবেষনা। মূলত নদীয়ার পাঁচটি ঘরের ধারাকেই লালন ফকিরিবাদের মূলধারা হিসেবে প্রচলন রেখে গেছেন। সমাজের হানাহানি দূর করে মানুষকে শান্তির পথ দেখিয়েছে লালন সাঁইয়ের মানবতাবাদ।
তিনি বলেন, ফকির লালনের ভাবধারা যুগে যুগে মেয়ে সঙ্গী এবং নেশায় দ্রব্য দিয়ে বিচ্যুৎ করা হয়েছে। যার আমি তীব্র প্রতিবাদ জানায়। ভাব সাধকের এই পবিত্র জায়গায় এধরনের প্রচলন চলতে দেয়া যাবে না। যেমনভাবে নতুন স্বাধীন বাংলাদেশ গড়তে আগষ্টের বৈষম্য বিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ফ্যাসিস্ট সরকারকে বিদায় করা হয়েছে, ঠিক তেমনিভাবে আজকের প্রজন্ম সাধনার জায়গায় বদজাতিকে মেনে নিবেন না। তাদেরও বিদায় করবে। মানুষের ধারণা এসব মাজারে নেশা জাতিয় দ্রব্য খাওয়া হয়। তাই আজকে স্বৈরাচারী ফ্যাসিস্ট সরকারের পতনের পর মাজার ভাঙা হচ্ছে। মাজার ভাঙা ফৌজদারী অপরাধ। প্রশাসনকে বলব এদের বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নিন। লালনের ফকিরি ভাবের সত্য প্রকাশ না হওয়া দেশের বিভিন্ন জায়গায় মাজার ভাঙার দায় লালন একাডেমিকে নিতে হবে।
তিনি বলেন, লালনের মূল জায়গায় শুধুই ভাবনগর। লালনের ভক্তরা শুধু মানুষের ভজন করে, নেশার নয়। আমাদের ভুল ধারণা থেকে মুক্ত হতে হবে। এখানে নেশাদ্রব্য নিষিদ্ধ। লালনের চর্চা সঠিকভাবে করতে নেশা হবে ভাবের, নেশা প্রজ্ঞার, নেশা হবে মানবতা। যা দিয়ে আমরা নিজেদের জয় করতে পারি। লালন সাঁইয়ের ফকিরি মতবাদেও প্রচার ও প্রসার ঘটাতে এ অঞ্চলের মানুষের প্রাণর প্রতিষ্ঠান ‘নবপ্রাণ’ এবং লালন একাডেমি হতে হাত রেখে এক সাথে চলবে। তিনি সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের প্রতি আহবান রেখে বলেন লালন একাডেমি ফকিরদের প্রতিষ্ঠান ফকিরদেও হাতেই ছেড়ে দিন।
তিনি বলেন, নদীয়ার প্রথম ফকির হল চৈতন্য। লালন সাঁই চৈতন্যের ভাবধারায় নিজেকে ফকির হিসেবে গড়ে তোলেন। লালনের এই প্রসার কোন ভাবেই ভারত মেনে নেয়নি। যুগে যুগে ভারত পরিকল্পিতভাবে এদেশের সাহিত্য সংস্কৃতির বিকাশ ঘটতে দেয়নি বর্তমানেও দিচ্ছেনা। দিল্লি ক্রমাগত ভাবে আমাদের নতুন স্বাধীন বাংলাদেশের বিরুদ্ধে অপপ্রচার চালাচ্ছে। এই মহাজ্ঞানী মহাত্মা লালনের সৃষ্টির কৃর্তি আজ আর কুষ্টিয়ার কুমারখালির ছেঁউড়িয়ার আখড়াবাড়ীর মধ্যে আবদ্ধ নেই। লালন সাঁই জাত-ধর্মের সিমাবদ্ধতার বাইরে মানুষকে সবার উপর তুলে ধরেছেন। বাংলার ভাবজগৎ বর্তমান বিশ্বে অনেকটাই সমৃদ্ধ।
তিনি আজকের প্রজন্মের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, আজকের প্রজন্মকেই নতুন স্বাধীন রাষ্ট্র হিসেবে যেমন এদেশকে গড়ে তুলতে হবে, তেমনি বেশি বেশি লালনচর্চা করে কুষ্টিয়াকে ভাবনগর হিসেবে দেশ-বিদেশের পর্যটকদের সামনে তুলে ধরার দায়িত্ব নিতে হবে। তিনি আরো বলেন, তার কর্মসাধনা দেশের গণ্ডি পেরিয়ে বহির্বিশ্বে ছড়িয়ে পড়েছে। সাধুরা এই আখড়াবাড়ীতে এসে সত্য পথে চলার মন্ত্রে দিক্ষা নিয়ে নিজেদের আলোকিত করছেন। কুষ্টিয়ার জেলা প্রশাসক তৌফিকুর রহমানের সভাপতিত্বে বাউল সম্রাট ফকির লালন সাঁইয়ের স্মরণোৎসবের অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথির বক্তব্য রাখেন কুষ্টিয়ার পুলিশ সুপার মিজানুর রহমান, ছাত্রনেতা হাসিবুর রহমান। লালন মাজারের খাদেম মোহাম্মদ আলী প্রমুখ। স্বাগত বক্তব্য রাখেন কুমারখালি উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা এস এম মিকাইল ইসলাম। অনুষ্ঠানের শুরুতেই আগত অতিথি ও বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে ছাত্র-জনতার প্রতিনিধিদের কুষ্টিয়া লালন একাডেমির পক্ষ থেকে ফুলের তোড়া, ক্রেস্ট ও আত্মসুদ্ধির প্রতীক একতারা উপহার দিয়ে বরণ করে নেন।