ঢাকা মঙ্গলবার, ২৯ এপ্রিল ২০২৫, ১৬ বৈশাখ ১৪৩২ | বেটা ভার্সন

কক্সবাজারের বাঁকখালী নদী দখল চলছে, উঠছে দালান

আগামীকাল পরিদর্শনে আসছেন দুই উপদেষ্টা
কক্সবাজারের বাঁকখালী নদী দখল চলছে, উঠছে দালান

কক্সবাজারের বাঁকখালী নদীর তীর দখলে যেন মহোৎসব চলছে। দখলদাররা শহরের মাঝিরঘাট থেকে নুনিয়ারছড়া পর্যন্ত নদীর জোয়ার-ভাটা অঞ্চলের জায়গা দখল করে পাকা স্থাপনা নির্মাণের প্রতিযোগিতায় নেমেছে। প্রশাসনের নাকের ডগায় রাত-দিন চলছে দখল, সেখানে উঠছে পাকা দালান। তবে দখলবাজি চললেও বাধা দেওয়ার কেউ নেই। এরইমধ্যে নদীচরে সৃষ্ট প্যারাবনের কয়েক হাজার গাছও সাবাড় করেছে ভূমিদস্যুরা।

সরেজমিন ও বিভিন্ন সূত্রের তথ্য বলছে, বছর দুয়েক আগে বাঁকখালী নদীর কস্তুরাঘাট এলাকায় প্রভাবশালীরা ৪০০ একর প্যারাবন কেটে অন্তত ৫০০টি পাকাণ্ডআধাপাকা স্থাপনা তৈরি করে। এই এলাকায় খুরুশকুলের সঙ্গে শহরের সংযোগ স্থাপনে স্থানীয় সরকার অধিদপ্তর ৫৭০ মিটার একটি দৃষ্টিনন্দন সেতু ও দুই পাশে প্রশ্বস্ত সড়কও নির্মাণ করা হয়েছে। কিন্তু এই সেতু নির্মাণের সঙ্গে সঙ্গেই স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা ও প্রভাবশালীরা নদীর জমি দখল করে বিক্রির প্রতিযোগিতায় নেমেছেন। দখলবাজি নিয়ে বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের বিরোধিতার মুখে দুই বছর আগে জেলা প্রশাসন কস্তুরাঘাট এলাকায় তিন দিন উচ্ছেদ অভিযান চালিয়ে নদী তীরের জমি দখলমুক্ত করে। কিন্তু দীর্ঘদিন জমিগুলো পরিত্যক্ত অবস্থায় পড়ে থাকার পর সম্প্রতি রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আবারও সক্রিয় হয়ে ওঠে দখলদার চক্র। এরই মধ্যে দখলদাররা নুনিয়ারছড়া থেকে মাঝিরঘাট পর্যন্ত নদীর তীরে হাজারো স্থাপনা গড়ে তুলেছেন।

কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের সূত্র বলছে, সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশে বাঁকখালী নদীর দখল হওয়া পুরো জমি উদ্ধারে জরিপ এবং প্রয়োজনীয় কাজ চলছে। অপরদিকে পরিবেশবাদী সংগঠনের নেতাদের অভিযোগ, দখলকৃত জমি উদ্ধারে দৃশ্যমান কোনো পদক্ষেপ নেই। তাদের মতে, শহরের প্রাণ-প্রকৃতির জন্য জনগুরুত্বপূর্ণ নদীর বিভিন্ন অংশ দখল হয়ে পড়ায় পরিবেশ-প্রতিবেশ হুমকির মুখে। সরেজমিন দেখা গেছে, ড্রেজার মেশিন বসিয়ে বালু উত্তোলন করে নদীর প্রবাহমান এলাকার জমি বালু ফেলে ভরাট করে দখল করা হচ্ছে। ইতিপূর্বে কস্তুরাঘাট থেকে গোদারপাড়া পর্যন্ত বিস্তীর্ণ অংশ দখল করে সেখানে উঠেছে কয়েকশ’ দালান। একদিকে দালান উঠছে, অন্যদিকে নতুন নতুন জমি ভরাট করা হচ্ছে। দখলদাররা নদীর জমিতে মসজিদ মাদ্রাসা, স্কুলসহ বিভিন্ন শিক্ষা ও ধর্মীয় প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলছেন। যাতে দখল পাকাপোক্ত করা যায়। এতে প্রবাহমান নদীর জমিতে এখন রূপ নিচ্ছে পাড়া-মহল্লায়। প্রতিটি গলির মাথায় উচ্চ আদালতসহ বিভিন্ন আদালতের মামলার নাম্বার দিয়ে সাইনবোর্ড টানিয়ে দেওয়া হয়েছে। অন্যদিকে দুই বছর আগে উচ্ছেদ করা কস্তুরাঘাট এলাকার বিস্তীর্ণ স্থানে আবারও পুরোপুরি পাকা দালানসহ বিভিন্ন স্থাপনা নির্মাণ করেছে দখলদাররা।

স্থানীয়রা জানিয়েছে, নামে-বেনামে বিভিন্ন খতিয়ানের জমি দেখিয়ে বহু সিন্ডিকেট বাঁকখালী নদীর জমি বিক্রি করছে। প্রশাসনকে ঠেকাতে এতে একাধিক মামলাও করে রেখেছে সিন্ডিকেটগুলো। মূলত; বিভিন্ন ভুয়া খতিয়ান দেখিয়ে প্রতারক চক্রগুলো মানুষকে বোকা বানিয়ে সরকারি নদীর জমি বিক্রি করছে। এভাবে কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিচ্ছে সিন্ডিকেটগুলো। স্থানীয় বড়বাজার এলাকার জসিম উদ্দিন, টেকপাড়ার আবুল কালাম, ৬নং এলাকার ফরিদুল আলমসহ অনেকে বলেন, ‘কক্সবাজার শহরের ব্যবসা বাণিজ্যসহ প্রাণ প্রবাহের অন্যতম উপাদান হচ্ছে বাঁকখালী নদী। বহু আগে দখলদারদের তালিকা প্রকাশ হলেও কোনো আইনগত ব্যবস্থা নিতে দেখা যায়নি। এতে বেপরোয়া হয়ে আরও জোরেশোরে নদীর জমি দখল চলছে।’

স্থানীয় বাসিন্দা আইনজীবী মোহাম্মদ আবদুল্লাহ বলেন, ‘আওয়ামী লীগ আমলে নেতাদের প্রভাব খাটিয়ে বিস্তীর্ণ প্যারাবন কেটে নদী দখল করা হয়েছে। এসব নদী দখলকারীদের অন্যতম হাতিয়ার আদালতের নিষেধাজ্ঞা। প্রশ্ন হচ্ছে- যদি জমির মালিকানা সঠিক থাকে তাহলে কেন আদালতের নিষেধাজ্ঞা নিতে হবে। এতে বুঝা যায় কাগজপত্রগুলো সবই ভুয়া।’

নুনিয়ারছড়া হতে টেকপাড়া পর্যন্ত বাঁকখালী নদী দখলে জড়িত ১৩০ জনের একটি নাম প্রকাশ করেছিল পরিবেশ অধিদপ্তর। কস্তুরাঘাট এলাকায় বিস্তীর্ণ প্যারাবন কেটে সাবাড় করার ঘটনায় একাধিক মামলাও হয়েছে। কিন্তু এই পর্যন্ত কোনো আইনগত ব্যবস্থা নেয়নি পরিবেশ অধিদপ্তর। মামলাগুলো আছে লালফিতায় বন্দি। দিন-দুপুরে প্যারাবন কেটে নদীর চর দখল চললেও নিশ্চুপ রয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর, বন বিভাগ ও জেলা প্রশাসন।

জানতে চাইলে কক্সবাজার পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক জিল্লুর রহমান বলেন, ‘কারা দখল করছে সেটা আমাদের দেখার বিষয় নয়। আমাদের দেখার এখতিয়ার রয়েছে পরিবেশ-প্রতিবেশ ক্ষতি হচ্ছে কিনা। এছাড়া ব্যক্তিমালিকাধীন জমি হলে আমাদের করার কিছু থাকে না।’

এদিকে সম্প্রতি সদর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ও সহকারী কমিশনার (ভূমি) ঘটনাস্থল পরিদর্শন করেন। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নীলুফা ইয়াছমিন চৌধুরী নদীর জমি দখল ও দালান তৈরির সত্যতা স্বীকার করে বলেন, ‘কাউকেই নদীর জমি দখল করতে দেওয়া হবে না। শিগগিরই দখল উচ্ছেদ ও আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।’

এ ব্যাপারে জানতে চাইলে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (রাজস্ব) মো. নিজাম উদ্দীন আহমেদ বলেন, ‘সরকারের উচ্চ পর্যায়ের নির্দেশনা মতে নদীর জমি উদ্ধারে একটি জরিপ প্রক্রিয়া চলছে।

এদিকে আগামীকাল বৃহস্পতিবার নৌপরিবহন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ব্রিগেডিয়ার জেনারেল (অব.) ড. এম সাখাওয়াত হোসেন এবং বন, পরিবেশ ও জলবায়ু পরিবর্তন এবং পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা রিজওয়ানা হাসান বাঁকখালী নদীর দখল-দুষণ পর্যবেক্ষণে আসছেন। নৌপরিবহন, শ্রম ও কর্মসংস্থান মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টার একান্ত সচিব মো. জাহিদুল ইসলাম স্বাক্ষরিত সফরসূচিতে এ তথ্য জানানো হয়েছে।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত