ঢাকা ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

সুসংবাদ প্রতিদিন

পাহাড়ের নারীরা কোমর তাঁতে স্বাবলম্বী

পাহাড়ের নারীরা কোমর তাঁতে স্বাবলম্বী

অন্যদের তুলনায় একটু বেশিই পরিশ্রম করেন পাহাড়ি নারীরা। তাদের জীবনযুদ্ধে যেন কেউ হার মানাতে পারেন না। প্রতিনিয়ত কাজ করেন পাহাড়ে পাহাড়ে। ব্যস্ত সময় পার করেন জুম চাষের মাধ্যমে।

জুম চাষ ছাড়াও পাহাড়ি নারীরা পরিবারের বাড়তি উপার্জনের জন্য বানিয়ে থাকেন কোমর তাঁত। এতে তারা বাড়তি যে অর্থ পায় সেটি দিয়ে চলে ছেলে-মেয়েদের পড়ালেখার খরচ।

খাগড়াছড়ির বেশিরভাগ পাহাড়ি পল্লিতেই চলে কোমর তাঁতের সাহায্যে কাপড় বুননের কাজ। গৃহস্থালির কাজ আর জুম চাষের ফাঁকে কোমর তাঁতে পিনন ও থামি তৈরি করে স্থানীয় বাজারের বিভিন্ন দোকানে সরবরাহ করে থাকেন তারা। কাপড় বুনে প্রতি মাসে একজন নারী পাঁচ থেকে সাত হাজার টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকেন বলে জানা গেছে।

আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী না হওয়ায় নিজেরা টাকা দিয়ে সুতা কিনতে পারেন না। অন্যের কাছ থেকে সুতা এনে কাপড় বানিয়ে নির্দিষ্ট একটি পারিশ্রমিক পান মাত্র। এতে করে তাদের কষ্টের তুলনায় পাওয়া অর্থটি অনেক কম হয়ে যায়। তাদের জন্য নেই কোনো ব্যাংক লোনও।

এমন কষ্ট করে মানুষের কাছ থেকে সুতা এনে কাপড় বানানো ৭০ জনকে বদলে দিয়েছে ফেরদৌসী পারভীন নামে এক নারী। তিনি ঢাকা থেকে এই পাহাড়ে ঘুরতে এসে এমন লোকদের সন্ধান পায়। পরে স্থানীয় পরিচিতজনদের মাধ্যমে পাহাড়ি নারীদের প্রতি সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দেন। এখন বর্তমানে ৭০টি পরিবার স্বাবলম্বী হয়ে গেছে। সহায়তা পাওয়া ৭০ জন নারী এখন সুতা দিয়ে কাপড় বানিয়ে সেই কাপড় বিক্রি করে প্রাপ্ত অর্থ দিয়ে আরও বেশি সুতা কিনে সম্প্রসারিত করেছেন। এতে বর্তমানে ৭০টি পরিবার সফল হয়েছেন। তাদের এখন আর আগের মতো মানুষের কাছ থেকে সুতা এনে কাপড় বুনতে হয় না।

শুধুমাত্র ৭০ জন নারীই নয়, এর আগেও তিনি তার ঢাকার কিছু সুহৃদের সহযোগিতায় বিভিন্ন সম্প্রদায়ের ২০ জন প্রশিক্ষিত নারীকে সেলাই মেশিন দিয়েছেন। খাগড়াছড়ির মধুপুর এলাকার এক নারীকে দোকান প্রতিষ্ঠা করে দিয়েছেন। যার মাধ্যমে সে নারীও আজ স্বাবলম্বী।

তিনি ব্যক্তিগত উদ্যোগে দুই দফায় চেলাছড়া, গাছবান ও খাগড়াপুরের ৭০ পাহাড়ি নারীকে পাঁচ কেজি করে সুতা দিয়েছেন। তার সহযোগিতায় বদলে গেছে ৭০ জন পাহাড়ি নারীর অর্থনীতির চাকা। প্রফেসর ফেরদৌসী পারভীনের সহযোগিতায় এসব পাহাড়ি নারীরা এখন ঘুরে দাঁড়িয়েছেন। তার দেয়া পাঁচ কেজি সুতায় থামি-ওড়না বুনেও আর্থিক সচ্ছলতা পেয়েছেন এসব নারীরা। এক সময় অভাব-অনটনের সঙ্গে লড়াই করা ৭০ পাহাড়ি নারী হয়ে উঠেছেন ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা।

জানা গেছে, গত বছর ৪০ জনকে এবং এই বছর ৩০ জন নারীকে থামি-পিনন ও ওড়না বোনার জন্য সুতা দিয়েছেন। তা দিয়ে প্রতিজন ৮-৯ সেট থামি-ওড়না বানাতে পারে। যার প্রতি সেটের পাইকারী মূল্য ৩-৪ হাজার টাকা। এই টাকা দিয়ে আবার সুতা কিনে থামি-ওড়না তৈরির পাশাপাশি সংসারের চাহিদা মিটানোর পাশাপাশি ছেলে-মেয়েদের লেখাপড়ার খরচেরও যোগান দিচ্ছেন।

এক সময় সুতা দাদন নিয়ে থামি, পিনন ও ওড়না তৈরি করা চেলাছড়ার বাসিন্দা সুজিতা ত্রিপুরা বলেন, বছরের পর বছর ধরে কোমর তাঁতের মাধ্যমে থামি, পিনন ও ওড়না তৈরি করলেও পরিবার নিয়ে অতি কষ্টে দিন কাটত আমাদের। আমাদের দুঃখ দুর্দশার কথা শুনে পারভীন আপা আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছেন। তার সহযোগিতায় থামি বিক্রির টাকায় আবারও সুতা কিনেছি। এখন আমার পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে।

আরেক সংগ্রামী নারী রমিতা ত্রিপুরা বলেন, প্রফেসর ফেরদৌসী পারভীনের সহযোগিতায় আমি নিজেই থামি বাজারে বিক্রি করে থাকি। থামি তৈরি করে যে টাকা আয় হয় তা দিয়ে সংসার চালাই।

রূপসী ত্রিপুরা বলেন, পারভীন আপার কাছ থেকে সুতা পাওয়ার পর আমাদের দিন বদলে গেছে। আমরা এখন নিজেরই কাপড় বোনার পর ভালো দামে বিক্রি করতে পারি। আমার এখন আর দাদনে সুতা নিতে হয় না।

অঞ্জু ত্রিপুরার কলেজপড়ুয়া মেয়ে মিমি ত্রিপুরা বলেন, পারভীন আপার দেয়া সুতা দিয়ে আমার মা থামি তৈরি করে বাজারে বিক্রি করেন। থামি বিক্রির টাকা দিয়েই আমাদের সংসার ও লেখাপড়ার খরচ চলে। আমরা আগের তুলনায় অনেক ভালো আছি।

পাহাড়ের নারী উদ্যোক্তা বীনা ত্রিপুরা বলেন, পাহাড়ি নারীদের আর্থিক সংকটে প্রফেসর ফেরদৌসী পারভীন আপা পাহাড়ে কোমর তাঁতের সঙ্গে জড়িত ৭০ জন নারীকে পাঁচ কেজি করে সুতা দিয়ে তাদের স্বাবলম্বী হওয়ার সুযোগ করে দিয়েছেন। তার সহযোগিতায় পিছিয়েপড়া ৭০টি পরিবারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরেছে।

শিক্ষকতা জীবনে ছাত্রছাত্রীদের প্রতি সামর্থ্য অনুযায়ী সাহায্যের হাত বাড়ানোর কথা জানিয়ে প্রফেসর ফেরদৌসী পারভীন বলেন, অবসর গ্রহণের পর সমাজের অবহেলিত নারীদের জন্য কিছু করার ইচ্ছা জাগে। আমি পাহাড় পছন্দ করি বলেই খাগড়াছড়ি ঘুরতে যাই। সেখানেই আমার পূর্ব পরিচিতদের মাধ্যমে ক্ষুদ্র নৃ-গোষ্ঠীর এসব নারীদের সঙ্গে আমার পরিচয় ঘটে। জানতে পারি পুঁজির অভাবে তারা তাদের ঐতিহ্যবাহী কোমর তাঁতে কাপড় বুনতে পারে না। তখনই তাদের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করেছি।

প্রফেসর পারভীন বলেন, মানুষের জন্য কিছু করতে পারার মধ্যে সুখ আছে। আত্মতৃপ্তি আছে। কিছু পাওয়ার জন্য নয় পিছিয়েপড়া এসব নারীদের স্বাবলম্বী হওয়ার পথকে সুগম করতেই তাদের পাশে দাঁড়িয়েছি। পাঁচ কেজি সুতায় একটি পরিবারে আর্থিক সচ্ছলতা এসেছে, তারা ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা হয়ে উঠেছে এটাই আমার বড় প্রাপ্তি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত