প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দৃঢ়তার সঙ্গে বলেছেন, ২০৪১ সালের বাংলাদেশ হবে একটি স্মার্ট বাংলাদেশ যেখানে প্রতিটি মানুষের প্রযুক্তিগত জ্ঞান থাকবে এবং দেশ বিশ্ব পরিমণ্ডলে পিছিয়ে থাকবে না। তিনি বলেন, ‘আমাদের শিক্ষা এবং লার্নিং যেমন ই-শিক্ষা, ই-স্বাস্থ্য, ই-ব্যবসা, ই-ইকোনমি, ই-গভর্নেন্স হবে প্রযুক্তিগত জ্ঞানভিত্তিক।’
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের হাতে ২০২৩ শিক্ষাবর্ষের বই তুলে দিয়ে বিনামূল্যে পাঠ্যপুস্তক বিতরণ কার্যক্রমের উদ্বোধনকালে প্রধানমন্ত্রী এ কথা বলেন। তিনি বলেন, সমস্ত গ্রামসহ সারা দেশের প্রযুক্তিগত জ্ঞান থাকবে এবং সরকার এজন্য ব্যবস্থা নিচ্ছে। শেখ হাসিনা বলেন, ২০৪১ সালের বাংলাদেশ হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। মানে প্রতিটি নাগরিক হবে প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন। প্রতিটি ছেলে-মেয়ে কম্পিউটার টেকনোলজি এখন থেকে শিখছে এবং আরো এগিয়ে যাবে। আমাদের পুরো জনগোষ্ঠীই হবে প্রযুক্তি জ্ঞানে স্মার্ট। বিশ্ব থেকে কোনো কিছুতেই পিছিয়ে থাকবে না। নিশ্চয়ই আমরা পারব।
তিনি বলেন, আমাদের লেখাপড়া, শিক্ষা, এ্যাডুকেশন, ই-বিজনেস, ই-ইকোনমি, ই-গভার্নেন্স সবকিছুই প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন হবে। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করা হয়েছে এরপর হবে স্যাটেলাইট-২। সেটাও আমরা করব। সাবমেরিন ক্যাবলের মাধ্যমে এসব সময় দ্বীপাঞ্চল থেকে শুরু করে সমস্ত জায়গাতেই আমরা ব্রডব্যান্ড অনলাইনে কাজ করার প্রযুক্তি নিয়ে যাব। একবারে গ্রাম পর্যায় পর্যন্ত প্রযুক্তি জ্ঞানসম্পন্ন হবে। সে ব্যবস্থাটাও আমরা করে দিচ্ছি। তার সরকার ২০২০ সালে জাতির পিতার জন্মশতবার্ষিকী এবং ২০২১ সালে স্বাধীনতার সুবর্ণ জয়ন্তী উদযাপনের সময় উন্নয়নশীল দেশের মর্যাদা পেয়েছে কাজেই বাংলাদেশকে এখন আর কেউ অবহেলার চোখে দেখতে পারে না। বাংলাদেশ বিশ্বে তার একটা স্থান করে নিয়েছে। আর ২০৪১ এর বাংলাদেশ হবে উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ, যেটা হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। প্রধানমন্ত্রী বলেন, করোনাভাইরাস এবং ইউক্রেন-রাশিয়া যুদ্ধের কারণে সরকার জনগণের অর্থ সাশ্রয়ের জন্য অনেক দিক থেকে কঠোরতা আরোপ করলেও শিশুদের জন্য পাঠ্যপুস্তকের বই ছাপানোর ক্ষেত্রে কোনো আপস করেনি।
সরকার প্রধান বলেন, এই করোনা, নানা ঝামেলা, ইউক্রেন-রাশিয়ার যুদ্ধ- এখন তো সব জিনিসের দাম বেড়ে গেছে। সারা বিশ্বব্যাপী কষ্ট, তার মধ্যেও কিন্তু আমরা শিশুদের কথা ভুলিনি। তাদের বই ছাপানোর খরচাটা- অন্য দিক থেকে আমরা সাশ্রয় করছি, বই ছাপানোর দিকে আমরা বিশেষ দৃষ্টি দিয়েছি। পাশাপাশি কম্পিউটার শিক্ষা অর্থাৎ প্রযুক্তি শিক্ষার প্রতি গুরুত্ব দিচ্ছি। বিশ্ব এগিয়ে যাচ্ছে, আমাদের ছেলে-মেয়েরা কেন পিছিয়ে পড়ে থাকবে।
করোনাকালীন সময়ে শিক্ষার্থীদের পড়াশোনা অব্যাহত রাখতে সরকারের নানা উদ্যোগের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, করোনার সময় থেকে এ পর্যন্ত আমার ঘরে আমার স্কুল, অর্থাৎ এখন ডিজিটাল বাংলাদেশ কাজেই ঘরে বসে পড়াশোনা। কেউ যাতে পড়াশোনায় ফাঁকি দিতে না পারে সেই ব্যবস্থাই নেয়া হয়েছে। সংসদ টিভির মাধ্যমে সারা বাংলাদেশে শিক্ষা কার্যাক্রম চালানো হয়েছে। আবার বিটিভির মাধ্যমেও চালানো হয়েছে। আমি মনে করি, সংসদ টিভি শিক্ষা মন্ত্রণালয় সব সময় ব্যবহার করতে পারে। শিক্ষার জন্য আলাদা টিভি চ্যানেল চালুর উদ্যোগ নেয়ার পরিকল্পনার কথা জানান প্রধানমন্ত্রী।
তিনি উল্লেখ করেন, দেশের শিশুদের আন্তরিকতার সঙ্গে গড়ে তুলতে পারলে বিশ্বের কোনো শক্তি দেশের উন্নয়ন ও অগ্রগতি ঠেকাতে পারবে না। আওয়ামী লীগ সরকারের বিভিন্ন উন্নয়ন কাজের কথা তুলে ঢালাও সমালোচকদের চোখ থাকতেও দেশের উন্নয়ন তারা দেখতে পান না বলে উল্লেখ করেন তিনি।
শেখ হাসিনা বলেন, ‘যদিও এত কাজ করার পরেও কিছু লোকের মন ভরে না। তাতেও তারা বলবে আমরা নাকি কিছুই করিনি। কিছুই করিনি (যারা বলে) শ্রেণিটা চোখ থাকতেও দেখে না। দৃষ্টি থাকতেও তারা অন্ধ। তারা দেখবেই না।’
তিনি বলেন, তাদের মাথার ভেতরে ‘নাই’ শব্দটা ঢুকে গেছে। আমরা ‘নাই’তে থাকতে চাই না। আমরা পারি, বাংলাদেশের মানুষ পারে। আমরা সেটাই প্রমাণ করতে চাই। ‘নাই’ ‘নাই’ শুনব না। আমরা করতে পারব, এটা করতে হবে।
শিক্ষামন্ত্রী ডা. দীপু মনির সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে স্বাগত বক্তব্য রাখেন শিক্ষা উপমন্ত্রী মহিবুল হাসান চৌধুরী। বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন প্রাথমিক ও গণশিক্ষা প্রতিমন্ত্রী মো. জাকির হোসেন।
প্রধানমন্ত্রী বলেন, ’৭৫-এর পরে যারা ক্ষমতায় এসেছে তারা যে এ দেশের মানুষকে নিরক্ষরতামুক্ত করবে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেয়নি। এটা জাতির জন্য দুঃখজনক । ’৯৬ সালে আমরা আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করি। তখন আমরা উদ্যোগ নেই, আমরা আবার নতুন করে শিক্ষা কমিশন গঠন করি। স্বাক্ষরতার হার বাড়ানোর জন্য একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করি। বয়স্কদের শিক্ষার ব্যবস্থাও সেখানে সংযুক্ত ছিল।
তিনি বলেন, জনগণকে যদি দারিদ্র্যমুক্ত করতে হয় তাহলে শিক্ষা হচ্ছে সবচেয়ে বড় হাতিয়ার। কাজেই সমগ্র জাতিকে আমরা শিক্ষিত করে গড়ে তুলব সেই পদক্ষেপ নেই। আমরা নতুন শিক্ষা কমিশন গঠন করি। কিন্তু পরবর্তীতে আমরা সেটা বাস্তবায়ন করতে পারিনি। কারণ আমাদের ৫ বছরের সময়সীমা শেষ হয়ে গিয়েছিল। ২০০১-এ বিএনপি-জামায়াত ক্ষমতায় আসার পর তারা দেশকে আবার অন্ধকারের দিকেই ঠেলে দেয়। এটা হলো বাস্তবতা। শেখ হাসিনা বলেন, ২০০৮-এর নির্বাচনে নৌকা মার্কায় মানুষ ভোট দেয়, আমরা আবার সরকার গঠন করি। তখন থেকে আমাদের আবার লক্ষ্য হয়, কীভাবে আমরা এ দেশের মানুষকে নিরক্ষরতামুক্ত করব এবং ২০১০ সাল থেকে আমরা বিনামূল্যে বই বিতরণ শুরু করি।
শিক্ষা সম্প্রসারণে আওয়ামী লীগ সরকারের নানাবিধ পদক্ষেপের উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২০০৯ সাল থেকে এ পর্যন্ত ২৩টি পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় এবং ৫৪টি প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, কৃষি, ভেটেরিনারি অ্যান্ড এনিম্যাল সাইন্সেস, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি, চিকিৎসা, ডিজিটাল, ইসলামি-আরবি, টেক্সটাইল, মেরিটাইম, এভিয়েশন ও এরোস্পেস, বেসরকারি ফ্যাশন ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয় তার সরকার করে দিয়েছে। তার সরকার চায় আকাশ গবেষণাটা করতেই হবে। তার সরকার চায় আমরা যেমন চাঁদে যেতে পারি তেমনি যুদ্ধ জাহাজ এবং এরোপ্লেনও প্রস্তুত করবে দেশে। আর সেগুলো আমাদের ছেলে-মেয়েরা যাতে করতে পারে সেজন্য এই শিক্ষার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে। তিনি বলেন, প্রতিটি উপজেলায় কারিগরি প্রশিক্ষণ কেন্দ্র স্থাপন করেছি, তাছাড়া হাই-টেক সিটি, হাই-টেক পার্ক এবং সফটওয়্যার প্রযুক্তি পার্ক স্থাপন করেছি। তাছাড়া মাদ্রাসা শিক্ষাকেও তার সরকার গুরুত্ব দিচ্ছে এবং এরইমধ্যে দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্স ডিগ্রি সমমর্যাদা প্রদান করা হয়েছে।
মাদ্রাসা শিক্ষার পাশাপাশি ভোকেশনাল শিক্ষা, কম্পিউটার এবং কারিগরি শিক্ষা যেন শিক্ষার্থীরা পেতে পারে সেজন্য সরকার পদক্ষেপ নিয়েছে উল্লেখ করে সরকার প্রধান বলেন, সাধারণ শিক্ষা ধারার ৬৪০টি প্রতিষ্ঠানে ২০২০ শিক্ষাবর্ষ থেকে ভোকেশনাল কোর্স চালু করেছি, বর্তমানে ৬৪টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজের আধুনিকায়নের পাশাপাশি ১০০টি উপজেলায় ১০০টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ প্রতিষ্ঠা করছি, ৭০টিতে শিক্ষা কার্যক্রম চলছে। তিনি বলেন, ৩২৯টি উপজেলায় ৩২৯টি টেকনিক্যাল স্কুল ও কলেজ, চারটি ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজ, ২৩টি পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট, চারটি মহিলা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্থাপন চলমান, দুটি সার্ভে ইনস্টিটিউট নির্মাণাধীন রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ২ হাজার ১৩৮টি বেসরকারি কারিগরি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান এবং ২০ হাজার ৬৪০ জন শিক্ষক/কর্মচারীকে এমপিওভুক্ত করেছি, কারিগরি ও বৃত্তিমূলক শিক্ষা এবং প্রশিক্ষণের মাধ্যমে প্রযুক্তিজ্ঞান সম্পন্ন মানবসম্পদ সৃষ্টিই হচ্ছে আমাদের মূল লক্ষ্য। পাশাপাশি ৩০০ এলাকায় ৬টি করে মোট ১ হাজার ৮০০টি মাদ্রাসার ভবন নির্মাণ ও আসবাবপত্র ক্রয় চলমান, ৬৫৩টি মাদ্রাসার মাল্টিমিডিয়া ক্লাসরুম স্থাপন করছি, মাদ্রাসা শিক্ষকদের প্রশিক্ষণ দিচ্ছি, ৮ হাজার ১৫৪টি বেসরকারি মাদ্রাসা এবং ১ লাখ ৬৩ হাজার ৬২ জন শিক্ষক/কর্মচারীকে এমপিওভুক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, সামাজিক নিরাপত্তা বেষ্টনী কর্মসূচির অংশ হিসেবে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিক্ষার মানোন্নয়ন এবং শিক্ষার্থী ঝরেপড়া রোধকল্পে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে জিটুপি পদ্ধতিতে উপবৃত্তি প্রদান করা হচ্ছে। মায়ের নামে মায়ের মোবাইল ফোনে টাকাটা পাঠানো হচ্ছে। শেখ হাসিনা বলেন, ৪র্থ প্রাথমিক শিক্ষা উন্নয়ন কর্মসূচি, দারিদ্র্যপীড়িত এলাকায় স্কুল ফিডিং কর্মসূচিসহ নানা উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করা হয়েছে।