কাজী হাবিবুল আউয়ালের নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন দায়িত্ব নেয়ার পর গত এক বছরে সব রাজনৈতিক দলকে আস্থায় আনতে পারেননি। তবে ২০২২ সালে গাইবান্ধা উপনির্বাচন বন্ধের মাধ্যমে রেকর্ড গড়ে প্রশংসায় ভেসেছে বর্তমান কমিশন। আসছে নতুন বছর চমক দেখাতে চায় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এ বছরটিকে নির্বাচনের বছর বলা হচ্ছে। কারণ ২০২৩ বিভিন্ন স্থানীয় পরিষদের নির্বাচনের সঙ্গে জাতীয় সংসদ নির্বাচনও রয়েছে।
সূত্র জানায়, রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় আনতে প্রতিনিয়ত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হচ্ছে বর্তমান কমিশনকে। দলগুলোর কাছে আস্থার কমিশনে পরিণত করতে সাংবিধানিকভাবে দেয়া সব ক্ষমতা প্রয়োগ করছে কাজী হাবিবুল আউয়াল নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন। নিজেদের নিরপেক্ষ প্রমাণ করতে অনিয়মের অভিযোগ এনে সম্প্রতি একটি সংসদীয় আসনের উপনির্বাচন বন্ধ করে রিটার্নিং কর্মকর্তা, এডিসি, পুলিশের কর্মকর্তা ও প্রিসাইডিং কর্মকর্তাসহ মোট ১৩৩ জনকে শাস্তির আওতায় আনতে সুপারিশ করেছে সাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানটির কর্তারা।
বর্তমান কমিশনের ইতিবাচক কার্যক্রম : রাজনৈতিক দল নিবন্ধনে পৃথক আইন, গণপ্রতিনিধিত্ব আদেশ বাংলায় রূপান্তর, মুক্তিযোদ্ধাদের বিশেষ এনআইডি সরবরাহ, প্রবীণ ও অক্ষমদের ঘরে বসে ভোট দেয়ার সুযোগ সৃষ্টি। নেতিবাচক কার্যক্রমগুলো হলো- পুরোনো ভোটারদের স্মার্টকার্ড দিতে না পারা, এনআইডি অনুবিভাগ নিজেদের কাছে রাখতে জোরাল ভূমিকা না রাখা, ইভিএম সংরক্ষণে যথাযথ ব্যবস্থা গ্রহণ করতে না পারা এবং ইউপি ভোটের সহিংসতায় ব্যাপক প্রাণনাশের ঘটনা রুখতে না পারা। আউয়াল কমিশনের নিয়োগ : ২০২২ সালের ২৬ ফেব্রুয়ারি সাবেক সিনিয়র সচিব কাজী হাবিবুল আউয়ালকে বাংলাদেশ নির্বাচন কমিশনের প্রধান করে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে গেজেট প্রকাশ করা হয়। ওই গেজেটে নির্বাচন কমিশনার হিসেবে নিয়োগ পান অবসরপ্রাপ্ত ব্রিগেডিয়ার জেনারেল আহসান হাবীব খান, সাবেক জেলা ও দায়রা জজ বেগম রাশিদা সুলতানা, সাবেক সিনিয়র সচিব মো. আলমগীর ও সাবেক সিনিয়র সচিব আনিছুর রহমান।
সংলাপে সাড়া দেয়নি বিএনপিসহ ৯টি দল : আউয়াল কমিশন দায়িত্ব নিয়েই রাজনীতিক, বিশেষজ্ঞ, শিক্ষাবিদদের সঙ্গে সংলাপের আয়োজন করে। এর ধারাবাহিকতায় ১৭ থেকে ৩১ জুলাই রাজনৈতিক দলগুলোকে আমন্ত্রণ জানায় সংস্থাটি। এতে বিএনপিসহ ৯টি দল ইসির ডাকে সাড়া দেয়নি।
যেসব দল সংলাপে অংশ নিয়েছে তাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন আয়োজনের দাবি করে। অনেকেই আপত্তি তোলে ইভিএম নিয়ে। কোনো কোনো দল সংখ্যানুপাতের ভিত্তিতে নির্বাচনের যুক্তি তুলে ধরে।
তবে নির্বাচন কমিশন সংবিধানের মধ্যে থেকেও যে সুষ্ঠু নির্বাচন করা যায়, সেই যুক্তি তুলে ধরে। সাংবিধানিক বিষয়গুলো মীমাংসার দায়িত্ব তাদের নয় বলে জানায়। একইসঙ্গে সিদ্ধান্ত নেয় ইভিএমের ব্যবহার বাড়ানোর। বিষয়টিকে অনেকেই লোক দেখানো সংলাপ বলেও মন্তব্য করেন।
সংসদ নির্বাচনের রোডম্যাপ : আউয়াল কমিশন কেবল সংলাপই করেননি। তার ভিত্তিতে সংসদ নির্বাচনের একটি রোডম্যাপও প্রায় দেড় বছর আগে তৈরি করেছে। এতে সুষ্ঠু নির্বাচন করতে তাদের সব উদ্যোগ, পরিকল্পনা তুলে ধরা হয়েছে। এতে কখন কোন কাজ কমিশন করবে, তা জানাতে সাধারণের জন্য রোডম্যাপ প্রকাশও করেছে।
তলোয়ার-রাইফেল বিতর্ক : ববি হাজ্জাজের দল এনডিএমের সঙ্গে সংলাপে বসে প্রধান নির্বাচন কমিশনার কাজী হাবিবুল আউয়াল মন্তব্য করেন, আপনাদের সমন্বিত প্রয়াস থাকবে, কেউ যদি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়ায়, আপনাকে রাইফেল বা আরেকটি তলোয়ার নিয়ে দাঁড়াতে হবে। আপনি যদি দৌড় দেন, তাহলে আমি কী করব?’ এই বক্তব্য গণমাধ্যমে আসার পর ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’তে পরিণত হয়। ব্যাপক সমালোচনার মুখে পরবর্তীতে অবশ্য সিইসি দেশবাসীর কাছে ক্ষমা চান।
কুসিক ভোটে ফল গণনায় গ-গোল : ১৫ জুন অনুষ্ঠিত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন (কুসিক) নির্বাচন সুষ্ঠু পরিবেশের মধ্যে শান্তিপূর্ণ একটি ভোট আয়োজনের পর সাফল্যের ফসল ঘরে তুলতে পারেনি নির্বাচন কমিশন। সন্ধ্যার পর ভোট গণনার সময় ১০১টি কেন্দ্রের ফলাফল ঘোষণার পর ‘অহেতুক’ ফল ঘোষণা বন্ধ রাখা হলে সন্দেহের দানা বাঁধে। এ নিয়ে হট্টগোলের সৃষ্টি হলে পুলিশ এসে নিয়ন্ত্রণ করে পরিস্থিতি।
নির্বাচনে মাত্র ৩৪৩ ভোটে দুই বারের মেয়র মনিরুল হক সাক্কুকে (বিএনপি নেতা) হারিয়ে বিজয়ী হন আওয়ামী লীগের আরফানুল হক রিফাত। নির্বাচনে ফলাফল বর্জন করেন সাক্কু, যদিও এ নিয়ে তিনি আদালতের দ্বারস্থ হননি। এই ঘটনা নির্বাচনকে প্রশ্নবিদ্ধ করে দেয়।
বাহাউদ্দিনের ‘বুড়ো আঙুল’ : কুমিল্লা-৬ আসনের সংসদ সদস্য আ ক ম বাহাউদ্দিনকে কুসিক নির্বাচনি এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দিলে তিনি ‘বুড়ো আঙুল’ দেখান নির্বাচন কমিশনকে। একইসঙ্গে ওই নির্দেশকে চ্যালেঞ্জ করে আদালতের শরণাপন্ন হন বাহাউদ্দিন। একজন এমপিকে নিয়ন্ত্রণে আনতে ব্যর্থ ইসি কী করে ৩০০ এমপিকে সংসদ নির্বাচনের সময় নিয়ন্ত্রণ করবেন, এই প্রশ্ন যখন সামনে আসে, ঠিক তখনই পুরো ইউটার্ন নেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) হাবিবুল আউয়াল।
তিনি বলেন, বাহাউদ্দিনকে এলাকা ছাড়ার নির্দেশ দেননি, তাকে অনুরোধ করেছেন। ভোটের এলাকায় কারও বাড়ি হলে বাড়িতে থাকতে বাধা নেই।
সিসি ক্যামেরায় ভালো সাড়া : কুসিক নির্বাচনের মধ্য দিয়েই প্রতিটি ভোটকক্ষ পর্যবেক্ষণের আওতায় আনে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। এতে ভোটকেন্দ্রের বাইরে কোনো হট্টগোলের পরিস্থিতি হয়নি। ভোটগ্রহণ হয় সুশৃঙ্খলভাবে। কমিশনের এই উদ্যোগকে অনেকেই সাধুবাদ জানান।
গাইবান্ধায় রেকর্ড : ১২ অক্টোবর অনুষ্ঠিত গাইবান্ধা-৫ আসনের নির্বাচনে অতীতের সব ইতিহাস ছাপিয়ে নজির স্থাপন করে আউয়াল কমিশন। সিসি ক্যামেরায় ভোট পর্যবেক্ষণ করে ৫০টি কেন্দ্রে অনিয়মের চিত্র দেখতে পেয়ে ভোটগ্রহণ বন্ধ করে দেয়া হয়।
এদিকে রিটার্নিং কর্মকর্তাও একটি কেন্দ্রের ভোট বন্ধ করে দেন। পরবর্তীতে নির্বাচনের কোনো যৌক্তিকতা না থাকায় পুরো নির্বাচনের ভোটগ্রহণ বাতিল করে দেয় ইসি। একই সঙ্গে অনিয়মে জড়িতদের শাস্তির আওতায় আনতে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত কমিটি গঠন করে দেয়া হয়।
৫১ কেন্দ্রের অনিয়ম তদন্তে ওই কমিটি ৬৮৫ জনের শুনানি করে এবং অন্যান্য কেন্দ্রের সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে বিভিন্ন ধরনের সুপারিশ করে। যার ভিত্তিতে একজন অতিরিক্ত জেলা প্রশাসকসহ ১৩৩ কর্মকর্তা বিরুদ্ধে বিভিন্ন ধরনের শাস্তির সিদ্ধান্ত দেয় ইসি।
দেশের ইতিহাসে কোনো আসনের ভোট অনিয়মের কারণে বন্ধ করে দেয়া এটি একটি নজির। এছাড়া এত কর্মকর্তাকে শাস্তির আওতায় আনার সিদ্ধান্তও রেকর্ড।
নৌকার প্রতীকের প্রার্থীর প্রার্থিতা বাতিল : গত ২ জুন ঝিনাইদহ পৌরসভা নির্বাচনে নির্বাচনি অপরাধে জড়িত থাকায় নৌকা প্রতীকের মেয়র প্রার্থী মো. আব্দুল খালেকের প্রার্থিতা বাতিল করে নির্বাচন কমিশন (ইসি)। বিষয়টি সবার মাঝে আউয়াল কমিশনের ভাবমূর্তিকে উজ্জ্বল করে তোলে। তবে আদালত থেকে রায় নিয়ে পরবর্তীতে প্রার্থিতা ফিরে পান আব্দুল খালেক।
ইলেকট্রনিক ভোটিং মেশিন : সংলাপে অংশ নেয়া দলগুলোর মতামত এবং বিএনপিসহ অন্যান্য দলের বিরোধিতা সত্ত্বেও আট হাজার ৭১১ কোটি ৪৪ লাখ টাকার নতুন ইভিএম প্রকল্প হাতে নেয় নির্বাচন কমিশন (ইসি)। প্রকল্প প্রস্তাবটি সরকারের তরফ থেকে অনুমোদন হওয়ার অপেক্ষায় রয়েছে। ইসির পরিকল্পনা হচ্ছে এই প্রকল্পের মাধ্যমে নতুন করে আরও দুই লাখ ইভিএম ক্রয় করে ১৫০ আসনে এই ভোটযন্ত্রের মাধ্যমে ভোটগ্রহণ করার।
দেশের সেরা প্রযুক্তিবিদরা এই মেশিনকে নির্ভরযোগ্য বললেও সুশীল সমাজের প্রতিনিধিরা বলছেন, এর মাধ্যমে ভোট কারচুপি করা সম্ভব। এখন যুক্তি হিসেবে তারা গাইবান্ধার নির্বাচনকে সামনে আনছেন। বলা হচ্ছে, কেন্দ্রের বাইরে কোনো হইচই না থাকলেও গোপন কক্ষে দুর্বৃত্তরা অন্যজনের ভোট নিয়ে নিচ্ছেন। যদিও নির্বাচন কমিশন বলছে, এই দুর্বৃত্ত ঠেকানো একটি চ্যালেঞ্জ। আর এই চ্যালেঞ্জ তারা একা মোকাবিলা করতে পারবে না।
রংপুর সিটি ভোট : সর্বশেষ রংপুর সিটি করপোরেশন ভোট সুষ্ঠুভাবে শেষ হলেও ইভিএমের ধীর গতির কারণে কিছুটা বিতর্কের সূষ্টি হয়। এদিন ভোট গ্রহণের নির্দিষ্ট সময়ের পর আরো তিন ঘন্টা ভোট গ্রহণ করতে হয়। ভোটে জাতীয় প্রার্টির প্রার্থী জয়লাভ করেন। ভোট নিয়ে প্রধান নির্বাচন কমিশনার (সিইসি) কাজী হাবিবুল আউয়াল বলেছেন, ইভিএমের গতি অবশ্যই ব্যালটের চেয়ে ধীর হবে। এ কারণে ভোট শেষ হতে সময় বেশি লেগেছে। অনেক জায়গায় ইভিএম হ্যাং করছে বিষয়টি নজরে আনলে সিইসি বলেন, অভিযোগটি অসত্য নয়। আমরা বলেছি যে, ইভিএমের গতি অবশ্যই ব্যালটের চেয়ে ধীর হবে। এমনও হতে পারে এটা ইভিএমের সেকেন্ড বা থার্ড জেনারেশন। আর নৌকার গতি রকেটের গতি সমান নয়। ইভিএমে ফিঙ্গারপ্রিন্ট ম্যাচিং করিয়ে, বায়োমেট্রিক দিয়ে নিশ্চিত করা হয়। সেটা ব্যালটে হয়ে থাকে না। এখানে একটা পজিটিভ সাইট হচ্ছে, ইভিএমে কোনো রকম কারচুপি, একজনের ভোট আরেকজন দেয়া এই জিনিসটা হচ্ছে না। এটা হচ্ছে ভালো দিক। ২০২২ সাল বর্তমান কমিশনের কেমন গিয়েছে প্রশ্ন করা হলে সিইসি বলেন, আমরা ভালো একটা বছর পার করেছি। সর্বোপরি ভালো বলা যায়। ভোটে তেমন সহিংসতা হয়নি। একটি নির্বাচনে ভোট গ্রহণকালে একটি শিশু মারা গেছে। তবে সেটি ভোটের সময় নয়, পরে মারা গেছে। আগামী বছর ভালো নির্বাচন হবে বলে জানান সিইসি।