আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে শেষ হচ্ছে চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীর তলদেশে নির্মাণাধীন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের পুরো কাজ। এরইমধ্যে টানেলের পূর্তকাজ শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে। এখন চলছে নিরাপত্তা বলয় তৈরি, বৈদ্যুতিক সংযোগসহ খুঁটিনাটি কাজ। সবকিছু ঠিক থাকলে ফেব্রুয়ারি থেকেই টানেল দিয়ে যানবাহন চলাচল করবে বলে আশা করছেন প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা। বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ প্রকল্পের পরিচালক মো. হারুনুর রশীদ।
টানেলের দুটি টিউব (পূর্তকাজ) তথা সিভিল ওয়ার্ক শতভাগ সম্পন্ন হয়েছে জানিয়ে হারুনুর রশীদ বলেন, ‘এখন শেষ মুহূর্তের কাজ চলছে। সামগ্রিক কাজের অগ্রগতি ৯৫ শতাংশ। আগামী ফেব্রুয়ারি মাসে পুরো কাজ শেষ হবে। এখন নিরাপত্তা বলয় তৈরি, বৈদ্যুতিক সংযোগসহ খুঁটিনাটি কাজ চলছে। পাশাপাশি শেষ হওয়া কাজের কোথাও কোনো ধরনের সমস্যা আছে কি না তা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছি আমরা।’ স্বপ্নের মেট্রোরেল চালুর পর এটা প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সরকারের আরেকটি মেগা প্রকল্প যা কেবল ওই অঞ্চলই নয়, বদলে দেবে সারা দেশের আর্থ-সামাজিক অবস্থা। বদলে যাবে জাতির ভাগ্য। মেট্রোরেলের পর এ যেন আরেকটি স্বপ্নের দ্বার উন্মোচিত হবে। এই টানেল দিয়ে কোন ধরনের গাড়ি চলবে তা নির্ধারণ করবে মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট কমিটি উল্লেখ করে প্রকল্প পরিচালক বলেন, ‘আমি শুধু বলতে পারি, পায়ে হেঁটে কোনো মানুষ টানেল পার হতে পারবে না। কেননা টানেলে দাঁড়ানো যাবে না। গ্যাস সিলিন্ডারসহ বিপজ্জনক দাহ্য পদার্থ বহনকারী কোনো গাড়ি এই টানেল দিয়ে চলতে দেয়া হবে না।’
এদিকে, টানেল দিয়ে কোন ধরনের গাড়ি চলবে এবং টোল কত হবে, তার একটি প্রস্তাবিত তালিকা করেছে বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ। সেতু কর্তৃপক্ষের প্রস্তাবিত টোল হার গত ২০ ডিসেম্বর অনুমোদন দিয়েছেন সড়ক পরিবহণ ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের। এখন তা অর্থ মন্ত্রণালয়ের অনুমোদনের অপেক্ষায় আছে।
প্রস্তাবিত টোল অনুযায়ী, টানেল দিয়ে চলতে প্রাইভেট কার, জিপগাড়ি ও পিক-আপকে ২০০ টাকা করে দিতে হবে। মাইক্রোবাসকে ২৫০, ৩১ কিংবা এর চেয়ে কম আসনের বাসকে ৩০০, ৩২ কিংবা তার চেয়ে বেশি আসনের বাসকে ৪০০ টাকা টোল দিতে হবে। পাশাপাশি পাঁচ টনের ট্রাককে ৪০০, পাঁচ থেকে আট টনের ট্রাককে ৫০০, আট থেকে ১১ টনের ট্রাককে ৬০০ টাকা টোল দিতে হবে। প্রকল্প সংশ্লিষ্ট একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, টানেলের ভেতর দিয়ে মোটরসাইকেলসহ তিন চাকার গাড়ি চলাচল করতে পারবে না। টানেলের নিরাপত্তা তথা দুর্ঘটনা এড়াতে এসব ছোট যানবাহন চলাচল করতে দেয়া হবে না। তবে টানেল দিয়ে পণ্যবাহী যানবাহন চলাচলে উৎসাহিত করা হবে।
গত ২৬ নভেম্বর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান টানেলের দক্ষিণ প্রান্তের একটি টিউবের পূর্তকাজের সমাপ্তি উদযাপন করা হয়েছে। এই উদযাপন অনুষ্ঠানে গণভবন থেকে ভার্চুয়লি যুক্ত হন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মাণাধীন দেশের প্রথম এই টানেল নির্মিত হচ্ছে চীনের আর্থিক ও কারিগরি সহযোগিতায়। নদীর তলদেশে হওয়ায় যে কোনো সময় পানি জমতে পারে আশঙ্কায় টানেলের মধ্যে বসানো হচ্ছে ৫২টি সেচ পাম্প। বাংলাদেশ সেতু কর্তৃপক্ষ এই প্রকল্প বাস্তবায়ন করছে। টানেলে দুই প্রান্তে নির্মাণ করা হয়েছে প্রায় ৫ দশমিক ৩৫ কিলোমিটার অ্যাপ্রোচ সড়ক ও ৭৭২ মিটার দীর্ঘ ফ্লাইওভার।
প্রকল্প সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, টানেল চালু হলে চীনের সাংহাই শহরের আদলে ওয়ান সিটি টু টাউন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন এক ধাপ এগিয়ে যাবে। টানেলকে ঘিরে রাজধানীর সঙ্গে চট্টগ্রাম নগরীর এবং পর্যটন নগরী কক্সবাজারের সড়ক যোগাযোগে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আসবে। এরইমধ্যে আনোয়ারা উপজেলা প্রান্তে সংযোগ সড়কের দুই পাশে গড়ে উঠছে ছোট-বড় অসংখ্য শিল্প-কারখানা। টানেল ঘিরে পর্যটন ও শিল্পায়নসহ অর্থনীতিতে যোগ হচ্ছে নতুন মাত্রা। টানেল চালু হলে কর্ণফুলী নদী পাড়ি দিতে সময় লাগবে মাত্র আড়াই মিনিট। সময় বেঁচে যাওয়ায় অর্থনীতিতে গতি আসবে।
টানেল নির্মাণের আগে ২০১৩ সালে করা সমীক্ষা প্রতিবেদনে বলা হয়, টানেল চালুর পর এর ভেতর দিয়ে বছরে ৬৩ লাখ গাড়ি চলাচল করতে পারবে। সেই হিসাবে দিনে চলতে পারবে ১৭ হাজার ২৬০টি গাড়ি। ২০২৫ সাল নাগাদ টানেল দিয়ে গড়ে প্রতিদিন ২৮ হাজার ৩০৫টি যানবাহন চলাচল করবে, যার মধ্যে অর্ধেক থাকবে পণ্যবাহী যানবাহন। ২০৩০ সাল নাগাদ প্রতিদিন গড়ে ৩৭ হাজার ৯৪৬টি এবং ২০৬৭ সাল নাগাদ ১ লাখ ৬২ হাজার যানবাহন চলাচলের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা আছে।
টানেল নির্মাণে মোট ব্যয় ধরা হয়েছিল ১০ হাজার ৩৭৪ কোটি টাকা। এর মধ্যে বাংলাদেশ সরকার দিচ্ছে ৪ হাজার ৪৬১ কোটি টাকা। বাকি পাঁচ হাজার ৯১৩ কোটি টাকা দিচ্ছে চীন সরকার। চীনের এক্সিম ব্যাংক দুই শতাংশ হারে ২০ বছর মেয়াদি এই ঋণ দিয়েছে। চীনের কমিউনিকেশন ও কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেড (সিসিসিসি) টানেল নির্মাণের ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান হিসেবে প্রকল্পটি বাস্তবায়ন করছে। তবে ডলারের দাম বৃদ্ধিসহ নানা কারণে প্রকল্পের ব্যয় আরও বাড়বে বলে প্রকল্প সূত্রে জানা গেছে।
মূল টানেলের দৈর্ঘ্য ৩ দশমিক ৩২ কিলোমিটার। তবে সংযোগ সড়কসহ টানেলের সর্বমোট দৈর্ঘ্য ৯ দশমিক ৩৯ কিলোমিটার। নদীর নিচে সুড়ঙ্গের মাধ্যমে তৈরি করা হয়েছে ১০ দশমিক ৮০ মিটার ব্যাসের দুটি টিউব। এর প্রতিটির দৈর্ঘ্য ২ দশমিক ৪৫ কিলোমিটার। টানেলে টিউব দুটি থাকলেও সংযোগ পথ আছে তিনটি। এর মধ্যে একটি বিকল্প পথ হিসেবে প্রথম দুটির সঙ্গে যুক্ত থাকবে। দুই সুড়ঙ্গের মধ্যে প্রথম সংযোগ পথের দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ১৪ মিটার। দ্বিতীয় বা মধ্যবর্তী সংযোগ পথের দৈর্ঘ্য ১২ দশমিক ৩৪ মিটার। শেষটির দৈর্ঘ্য ১০ দশমিক ৭৪ মিটার। প্রতিটির ব্যাস গড়ে সাড়ে চার মিটার।
কর্ণফুলী নদীর তলদেশ দিয়ে ১৮ থেকে ৩৬ মিটার গভীরতায় সুড়ঙ্গ তৈরি করা হয়েছে। নদীর মাঝ পয়েন্টে এই গভীরতা প্রায় ১৫০ ফুট। প্রতিটি ৩৫ ফুট প্রশস্ত ও ১৬ ফুট উচ্চতার। চট্টগ্রামে পতেঙ্গার নেভাল একাডেমি প্রান্ত থেকে শুরু হয়ে টানেলটি নদীর তলদেশ হয়ে চলে গেছে আনোয়ারার চিটাগাং ইউরিয়া ফার্টিলাইজার লিমিটেড এবং কর্ণফুলী ফার্টিলাইজার লিমিটেড কারখানার মাঝামাঝি স্থানে। ২০১৬ সালের ১৪ অক্টোবর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ও চীনের প্রেসিডেন্ট শি জিনপিং প্রকল্পের ভিত্তিপ্রস্তর স্থাপন করেন। ২০১৯ সালের ২৪ ফেব্রুয়ারিতে টানেলের নির্মাণকাজ আনুষ্ঠানিকভাবে উদ্বোধন করেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
টানেল প্রকল্পে রক্ষণাবেক্ষণ ও টোল আদায় করবে চীনা কোম্পানি। গত বছর ১৮ মে অর্থনৈতিক বিষয় সংক্রান্ত মন্ত্রিসভা কমিটির সভায় এই কাজের জন্য চায়না কমিউনিকেশন্স কনস্ট্রাকশন কোম্পানি লিমিটেডকে নিয়োগের প্রস্তাব নীতিগতভাবে অনুমোদন দেয়া হয়।