ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার গবেষণা

মানুষের বিপদ ডেকে আনতে পারে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার

মানুষের বিপদ ডেকে আনতে পারে অ্যান্টিবায়োটিকের যথেচ্ছ ব্যবহার

বিশ্বব্যাপী স্বাস্থ্যখাতে নতুন এক অশনি সংকেত হলো অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স। অ্যান্টিবায়োটিক বা অ্যান্টিমাইক্রোবায়াল ড্রাগ এমন এক ধরনের ওষুধ যা ব্যাকটেরিয়ার সংক্রমণজনিত রোগের বিরুদ্ধে লড়াই করে। এই ওষুধ মানুষ বা পশুর দেহে প্রয়োগ করলে এটি শরীরের ব্যাকটেরিয়া মেরে ফেলে বা এর বংশবিস্তার রোধের মাধ্যমে রোগ নিরাময় করে। তাই ব্যাকটেরিয়ার আক্রমণ থেকে রক্ষা পেতে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োজন। কিন্তু সেই অ্যান্টিবায়োটিক সঠিক উপায়ে প্রয়োগ না করলে হিতে বিপরীত হতে পারে। অ্যান্টিবায়োটিক বিভিন্ন ধরনের হয়ে থাকে। কোনো অসুখ হলে কী ধরনের অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করতে হবে, কতদিন ধরে সেই ওষুধ গ্রহণ করতে হবে, সেটাও নির্ভর করছে চিকিৎসকের ওপর। যদি কারও শরীরে ব্যাকেটিয়ার সংক্রমণজনিত রোগ হয় এবং সেই রোগ নিরাময়ে কেউ যদি চিকিৎসকের পরামর্শ মতো সঠিক পরিমাণে এবং পর্যাপ্ত সময় ধরে অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ না করেন তাহলে ব্যাকেটিয়ারগুলো পুরোপুরি ধ্বংস না হয়ে উল্টো আরও শক্তিশালী হয়ে উঠতে পারে। তখন এই ব্যাকটেরিয়ার বিরুদ্ধে ওই অ্যান্টিবায়োটিক পরে আর কাজ করে না। অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের পরেও ব্যাকেটেরিয়ার এই টিকে থাকার ক্ষমতা অর্জনকে অ্যান্টিবায়োটিক রেসিসট্যান্স বলা হয়।

অ্যান্টিবায়োটিক জাতীয় ওষুধ সম্পর্কে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সবশেষ গবেষণায় উঠে আসে যে অ্যান্টিবায়োটিকের ভুল এবং অসচেতন ব্যবহারের কারণে এই জাতীয় ওষুধ কার্যকারিতা হারাচ্ছে আশঙ্কাজনক হারে। ফলে চিকিৎসা প্রক্রিয়াও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।

ডাক্তারের পরামর্শ ছাড়া অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়া, অ্যান্টিবায়োটিকের কোর্স পুরো না করা বা ছোটখাটো শারীরিক সমস্যার জন্য অ্যান্টিবায়োটিক খাওয়ার প্রবণতা বাংলাদেশের মানুষের মধ্যে প্রবল।

বাংলাদেশের বিভিন্ন হাসপাতালে সাধারণ রোগ নিয়ে চিকিৎসা নেয়া অনেক মানুষের মধ্যে এই অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স দেখা দিয়েছে বলে জানাচ্ছেন চিকিৎসকরা। এর ফলে রোগীর আগে যে অ্যান্টিবায়োটিকে রোগ সারতো এখন আর সেটি কাজ করছে না। আর সে কারণে অনেক সময় অত্যন্ত উচ্চ মাত্রার অ্যান্টিবায়োটিক দিতে হচ্ছে রোগীকে। এর ফলে মানুষের শরীরে রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা ক্রমেই হ্রাস পাচ্ছে।

১৯২৮ সালে পেনিসিলিন আবিষ্কারের পর থেকে চিকিৎসা ক্ষেত্রে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার শুরু হয়। এরপর আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার। বর্তমান বিশ্বে বহু ক্ষেত্রে অতিরিক্ত অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার হচ্ছে বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। অ্যান্টিবায়োটিক তৈরি হতে যে সময় লাগে ওই সময়ের মধ্যেই কয়েকগুণ বেশি হারে বাড়ছে অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স। যার ফলে অদূর ভবিষ্যতে সামান্য হাঁচি, কাশি, জ্বরেও মানুষের মৃত্যু ঝুঁকি তৈরি হতে পারে বলে আশঙ্কা করা হচ্ছে। চিকিৎসকরা বলছেন অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্সের সবচেয়ে বড় কারণ হলো সাম্প্রতিক সময়ে অত্যধিক মাত্রায় অ্যান্টিবায়োটিকের ব্যবহার। বাংলাদেশে অ্যান্টিবায়োটিক ওষুধ বিক্রির ক্ষেত্রে কোনো নীতিমালা নেই। কিছু নির্দেশনা থাকলেও সেগুলো বিক্রেতা বা ক্রেতা কেউই মানেন না।

অনেকই জ্বর মাথাব্যথা হলে চিকিৎসকের পরামর্শ ছাড়াই অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করে থাকেন। বিনা প্রেসক্রিপশনে ঘন ঘন অ্যান্টিবায়োটিক সেবন করেন। আবার অনেকে চিকিৎসকের পরামর্শে অ্যান্টিবায়োটিক নিলেও সেটার পূর্ণ কোর্স সম্পন্ন করেন না। কয়েকটি খাবার পর ভালো বোধ করলেই ছেড়ে দেন। ফলে ওই ব্যাকটেরিয়া বিরুদ্ধে অ্যান্টিবায়োটিকের আর কোনো প্রভাব থাকে না। প্রয়োজনের তুলনায় স্বল্প ডোজের অ্যান্টিবায়োটিক দেয়া হলে ভাইরাসজনিত বিভিন্ন অসুখে অর্থাৎ যেসব ক্ষেত্রে একটি নির্দিষ্ট সময় পরে অসুখ এমনিই সেরে যেত সেখানে বিশেষ করে শিশুদের অ্যান্টিবায়োটিক দিলে অ্যান্টিবায়োটিক রেজিস্ট্যান্স তৈরির আশঙ্কা থাকে।

প্রকৃতি ও পরিবেশে অ্যান্টিবায়োটিকের বিস্তার রয়েছে। ইদানীং মাছ, হাঁস, মুরগি বা গরুকে অ্যান্টিবায়োটিক যুক্ত খাবার দেয়া হয়। আবার শাক-সবজি উৎপাদনের ব্যবহার হয় কীটনাশক। ফলে এসব প্রাণীর কাঁচামাংস সংস্পর্শে এলে, আধাসেদ্ধ অবস্থায় খেলে অ্যান্টিবায়োটিকের রেসিস্ট্যান্স তৈরি হওয়ার আশঙ্কা থাকে, এমনটাই বলছেন বিশেষজ্ঞরা।

অর্থাৎ আমরা প্রতিদিন যেসব খাবার খাচ্ছি তার অনেকগুলো থেকেই অ্যান্টিবায়োটিক শরীরে প্রবেশ করতে পারে। অ্যান্টিবায়োটিক নিয়ম করে খাওয়ার পরও শিশুরা অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্সের শিকার হতে পারে, এমনটাই জানাচ্ছেন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা।

চিকিৎসকরা বলছেন, বাংলাদেশে বহু মানুষ বিশেষ করে নিম্নআয়ের মানুষ চিকিৎসকের কাছে না গিয়ে ফার্মেসিতে গিয়ে রোগের উপসর্গ বলে অ্যান্টিবায়োটিক কিনে নিয়ে আসেন। তাদের মধ্যে ধারণাই নেই যে এর ফলে তার শরীরের মধ্যে অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্স তৈরি হয়ে যাচ্ছে এবং পরবর্তীতে কোনো সংক্রমণ হলে সেটা আর কোনো ওষুধে হয়তো সারবে না। এর ফলে যে অ্যান্টিবায়োটিককে মনে করা হতো কোনো জীবাণুর বিরুদ্ধে অব্যর্থ তা এখন অনেক ক্ষেত্রে কাজই করছে না। আরেকটি ঝুঁকি হচ্ছে মানুষের সঙ্গে সঙ্গে প্রাণীর ওপরও অ্যান্টিবায়োটিক ব্যবহার হয়। যা কখনোই পুরোপুরি বিলীন হয় না, মাটিতে রয়ে যায়।

অ্যান্টিবায়োটিকের সঠিক প্রয়োগ যেন হয় সেজন্য বিশ্বব্যাপী চিকিৎসকরা কিছু পরামর্শ দিয়েছেন। শুধুমাত্র প্রয়োজন অনুযায়ী অ্যান্টিবায়োটিক গ্রহণ করতে হবে এবং অবশ্যই সেটা চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী হতে হবে। নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়াজনিত চিকিৎসা নির্দিষ্ট অ্যান্টিবায়োটিক দিয়েই করতে হবে। শুধু সঠিকভাবে রোগ নির্ণয়ের পরই সঠিক মাত্রায় ওষুধ গ্রহণের পরামর্শ দিতে হবে। সংক্রমণ প্রতিরোধে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্নতা বজায় রাখতে হবে। হাসপাতালে কঠোর স্বাস্থ্যবিধি থাকতে হবে। হাসপাতালের কর্মকর্তা ও দর্শনার্থীদের জন্য সবসময় হাত ধোয়ার ব্যবস্থা থাকতে হবে।

যারা অ্যান্টিবায়োটিক রেসিস্ট্যান্সের রোগী তাদের অন্য রোগী থেকে বিচ্ছিন্ন রাখতে হবে। মাছ-মাংসে অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগের ক্ষেত্রে আরও সচেতন হতে হবে। শাক-সবজিতে কীটনাশকের প্রয়োগের ক্ষেত্রে নিয়ম মেনে সেটা করতে হবে। সূত্র : বিবিসি

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত