ঢাকা ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ | বেটা ভার্সন

মডেল মসজিদ ধর্মীয় বিভ্রান্তি দূর করতে সহায়তা করবে

উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী
মডেল মসজিদ ধর্মীয় বিভ্রান্তি দূর করতে সহায়তা করবে

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রগুলো থেকে জনগণ ইসলামী মূল্যবোধ ও সংস্কৃতি সম্পর্কে প্রকৃত জ্ঞান লাভ করবে, যা সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও নারী নির্যাতন বন্ধে ব্যাপক অবদান রাখার পাশাপাশি ধর্মের নামে বিভ্রান্তি দূর করতে সহায়তা করবে।

তিনি বলেন, আমরা মডেল মসজিদ নির্মাণের প্রকল্প হাতে নিয়েছি, কারণ, এতে ইসলামের নামে কেউ মানুষকে বিভ্রান্ত করতে পারবে না এবং তাদের মধ্যে ইসলামী মূল্যবোধ সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টি হবে।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল সকালে গণভবন থেকে সারা দেশে ভার্চুয়ালি আরও ৫০টি মডেল মসজিদের উদ্বোধনকালে এ কথা বলেন।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, মডেল মসজিদে ইসলামী মূল্যবোধের চর্চা হবে, ইসলাম ধর্ম সম্পর্কে মানুষের জ্ঞান আরো বাড়বে, ইসলামী সংস্কৃতি লালন ও বিকাশের আরো সুযোগ থাকবে এবং ইসলাম ধর্মকে আরো উন্নতভাবে পালনের সুযোগ সৃষ্টি করা হয়েছে।

তিনি বলেন, জাতির পিতার পদাঙ্ক অনুসরণ করে তার সরকার চলে বলেই ইসলাম ধর্ম এবং শিক্ষাকে গুরুত্ব দেয় এবং দীর্ঘদিনের দাবি পূরণ করে দাওরায়ে হাদিসকে মাস্টার্সের মর্যাদা দিয়েছে, ইসলামিক আরবি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেছে, তাছাড়া প্রতিটি উপজেলা ও জেলা সদরে একটি করে মডেল মসজিদ প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নিয়েছে।

ইসলাম ধর্মের দোহাই দিয়ে কেউ যেন মানুষকে বিপথে নিতে না পারে, প্রকৃত ইসলামের মূল্যবোধ সম্পর্কে মানুষের মাঝে যেন সচেতনতার সৃষ্টি হয় সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি রেখেই এই মডেল মসজিদ নির্মাণের প্রকল্প আমরা নেই এবং নির্বাচনি ইশতেহারেও সেটার ঘোষণা দেই, বলেন তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, এই প্রকল্পটির মূল লক্ষ্য এবং উদ্দেশ হচ্ছে মুসল্লিদের জন্য নামাজের ব্যবস্থা, ধর্মীয় শিক্ষা, প্রশিক্ষণ, দ্বীনি দাওয়াতি কার্যক্রমের সুবিধাদি সৃষ্টি করা, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ এবং নারীর প্রতি সহিংসতা রোধ, সরকারের উন্নয়ন প্রক্রিয়ার নীতিনির্ধারণের বিষয়ে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং স্বাধীনভাবে ইসলামী জ্ঞান ও সংস্কৃতি চর্চার মাধ্যমে ইসলামী মূল্যবোধের প্রসার ঘটানো। এছাড়া, এখানে একটি লাইব্রেরিও থাকবে। কেননা ইসলাম ধর্মের ভ্রাতিত্ব এবং সাম্যের প্রচার এবং প্রসারও এর একটি অন্যতম লক্ষ্য। তিনি বলেন, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত মসজিদগুলোতে ওজু ও নামাজের জন্য আলাদা জায়গা রয়েছে।

এছাড়া হাজীদের জন্য রেজিস্ট্রেশন ও প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা, ইমাম প্রশিক্ষণ কেন্দ্র, গবেষণা কেন্দ্র ও ইসলামিক লাইব্রেরি, অটিজম কর্নার, দাফনের আগে আচার, প্রাক-প্রাথমিক শিক্ষা ও কোরআন শিক্ষার ব্যবস্থা, ইসলামী সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডে জন্য সম্মেলন কক্ষও থাকবে। ইসলামিক দাওয়াত, ইসলামী বই বিক্রয় কেন্দ্র, দেশি-বিদেশি অতিথিদের জন্য বোর্ডিং সুবিধাও এখানে থাকছে।

তিনি এর আগে ৫০টি এবং আজকে আরো ৫০টি মডেল মসজিদ উদ্বোধন করতে পারায় মহান রাব্বুল আলামিনের দরবারে শোকরিয়া আদায় করেন।

প্রধানমন্ত্রী এ সময় সূরা তওবার ১৮ নম্বর আয়াতের বাংলা তরজমা উচ্চারণ করে বলেন, আমি এটুকুই বলব আমাদের এই ধর্ম নিয়ে কেউ যেন আর কোনো রকম বিভ্রান্তির সৃষ্টি করতে না পারে। আমাদের আলেম ওলামাগণ হচ্ছেন ‘ওরাসাতুল আম্বিয়া’। মানুষ মসজিদের ইমাম, খাদিম এবং আলেমণ্ডওলামাদের অত্যন্ত শ্রদ্ধার সঙ্গে দেখে। আমাদের সমাজে যেসব অসঙ্গতি রয়েছে- যেমন বাল্যবিয়ে, মাদকাশক্তি, নারীর প্রতি সহিংসতা, গৃহকর্মী ও অধীনস্থদের নির্যাতন, খাদ্যে ভেজাল এবং দুর্নীতি ইত্যাদি দূরীকরণে ইমাম ও খতিব সাহেবদের প্রতি আমার অনুরোধ থাকবে আপনারা যখন মসজিদে কোনো বয়ান দেন বা জুমার নামাজে খোৎবা পড়েন সে সময় উপরোক্ত বিষয়গুলো থেকে মানুষ যাতে বিরত থাকে সে বিষয়গুলো আপনারা মানুষের সামনে তুলে ধরবেন এবং এর বিপরীতে সঠিক মানবিক গুণগুলো যাতে উঠে আসে সেদিকে বিশেষভাবে দৃষ্টি দেবেন।

তাছাড়া, সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদণ্ডমাদক এগুলো আমাদের সমাজকে, একেকটা পরিবারকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। এই সন্ত্রাস-জঙ্গিবাদ থেকে যেন প্রত্যেকের ছেলে-মেয়েরা বিরত থাকে, এটা যে ইসলাম ধর্মের প্রতি কোনো সম্মান নয় বরং ইসলামের বদনাম হয় সেই বিষয়টার দিকে সবাই যাতে সচেতন হয়। নিজেদের সন্তানের দিকে নিজেরা যেমন তেমনি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকরাও তাদের শিক্ষার্থীদের প্রতি লক্ষ্য রাখবেন। আপনাদের ছেলেমেয়ে কোথায় যায় এবং কার সঙ্গে মেশে-জঙ্গিবাদ এবং সন্ত্রাসের সঙ্গে যেন কোনোভাবে সম্পৃক্ত না হয়। আর এ বিষয়ে সচেতনতা সৃষ্টির ক্ষেত্রেও আপনারা অবদান রাখতে পারেন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। আওয়ামী লীগ সব সময় ইসলামের সেবক উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মাদ্রাসা বোর্ড প্রতিষ্ঠা, বায়তুল মোকাররম মসজিদ ও ইজতেমা মাঠের জায়গা দেয়ার পাশাপাশি ঘোরদৌড় ও জুয়া খেলা এবং মদ খাওয়া বন্ধ করেছিলেন।

তিনি বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশে বিশ্ব ইজতেমা আয়োজনের উদ্যোগ নিয়েছিলেন এবং বাংলাদেশকে ওআইসির সদস্য হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করেছিলেন।’

দ্বিতীয় পর্যায়ে ৫০টি মসজিদ খোলার মাধ্যমে, প্রধানমন্ত্রী এখন পর্যন্ত ৯৪৩৫ কোটি টাকা ব্যয়ে নির্মিত ৫৬৪টির মধ্যে ১০০টি মসজিদ উদ্বোধন করেছেন। তিনি এর আগে ২০২১ সালের ১০ জুন প্রথম ধাপে ৫০টি মসজিদ উদ্বোধন করেছিলেন। আশা করা হচ্ছে আগামী ফেব্রুয়ারির শেষে তৃতীয় ধাপে আরও ৫০টি মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্র চালু করা হবে।

ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আয়োজিত অনুষ্ঠানে ধর্ম প্রতিমন্ত্রী ফরিদুল হক খান এবং মন্ত্রণালয়ের সচিব কাজী এনামুল হাসান বক্তব্য দেন। কুমিল্লা জেলার চৌদ্দগ্রাম, রাজশাহী ও শরীয়তপুর থেকেও কর্মসূচিতে ভার্চুয়ালি যুক্ত ছিলেন স্থানীয় সংসদ সদস্য, জনপ্রতিনিধি, রাজনৈতিক দল, সরকারি কর্মকর্তা ও সাধারণ মানুষ। অনুষ্ঠানে মডেল মসজিদ ও ইসলামিক সাংস্কৃতিক কেন্দ্রের ওপর একটি ভিডিও-ডকুমেন্টারি প্রদর্শন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার দেশের অর্থনৈতিক উন্নতির পাশাপাশি গরিব দুঃখী মানুষ যেন দারিদ্র্যের কষাঘাত থেকে মুক্তি পেতে পারে সে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে।

করোনাভাইরাস অতিমারী মোকাবিলায় দেশের সব শ্রেণি পেশার মানুষের কর্মকাণ্ড চালু রাখার মাধ্যমে অর্থনীতির চাকাকে গতিশীল রাখায় তার সরকারের বিভিন্ন উদ্যোগ এবং প্রণোদনা দেয়ার উল্লেখ করে তিনি বলেন, সবাইকে যেমন বিনা পয়সায় ভ্যাকসিন দিয়েছেন তেমনি সমাজের একেবারে নিম্নস্তরের মানুষকেও নগদ অর্থ এবং খাদ্য সাহায্য দিয়েছেন। সেইসঙ্গে দেশের প্রায় ২ লাখ ৪৪ হাজার ৪৩টি মসজিদের ইমামণ্ডমুয়াজ্জিনদের অনুকূলে ৫ হাজার টাকা হারে ১২২ কোটি ২ লাখ ১৫ হাজার টাকা তার সরকার অনুদান হিসেবে দিয়েছে। পাশাপাশি করোনাকালিন কওমি মাদ্রাসার আয়ের পথ রুদ্ধ হওয়ায় দেশের ১৩ হাজার ৯৪৪টি কওমি মাদ্রাসায় ৮ কোটি ৬৩ লাখ ৬৫ হাজার টাকা আর্থিক সহায়তাও প্রদান করেছে। প্রধানমন্ত্রী তার ভাষণে ’৯৬ সালে ২১ বছর পর প্রথম সরকারে এসেই ইমামণ্ডমুয়াজ্জিনদের জন্য ‘সিড মানি’ দিয়ে ট্রাস্ট ফান্ড গঠন করে দেয়ার কথাও উল্লেখ করেন। শেখ হাসিনা বলেন, আমি এটুকুই চাই আমাদের দেশে সত্যিকারের ইসলামের জ্ঞান চর্চা হোক। কেননা আমরা ২৭ হাজার ৮৩২টি মসজিদ পাঠাগার স্থাপন করেছি তাছাড়া মসজিদ পাঠাগার সম্প্রসারণ ও শক্তিশালীকরণ প্রকল্পের মাধ্যমে আরো ২ হাজার ৫০০টি নতুন পাঠাগার স্থাপনে নানা পদক্ষেপ নেয়া হয়েছে। এ পর্যন্ত ২ লাখ ১২ হাজার ৬৪৭ জন ইমামকে বুনিয়াদি প্রশিক্ষণ, ৯৫ হাজার ৮৫ জনকে নিয়মিত প্রশিক্ষণ, ৩৪ হাজার ৩২৩ জন ইমামকে অন্যান্য প্রশিক্ষণ এবং ৩ হাজার ৬১৩ জন ইমামকে কম্পিউটার প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। ‘আধুনিক প্রযুক্তি জ্ঞান থেকেও যেন কেউ দূরে না থাকে, তার ব্যবস্থাটাই আমরা নিয়েছি,’ বলেন তিনি।

তিনি বলেন, আমরা সবসময় চেষ্টা করি আমাদের ধর্মের সম্মানটা যাতে আরো উন্নত হয়। আমাদের সমাজ থেকে সব ধরনের অন্ধকার, কুশিক্ষা, বিভেদ, হানাহানি, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ যেন দূর করে আমাদের সমাজটাকে সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারি। বাংলাদেশের প্রতিটি মানুষ যার নিজ নিজ ধর্ম যেন নিশ্চিতভাবে পালন করতে পারে, সেই ধর্মীয় স্বাধীনতা যাতে নিশ্চিত থাকে। যেটা আমাদের ইসলামের শিক্ষা। আমরা সেটাতেই বিশ্বাস করি এবং সেটাই আমরা করতে চাই। প্রধানমন্ত্রী বলেন, কাজেই আসুন আমরা সবাই আমাদের পরমত সহিষ্ণুতা এবং ধর্মীয় সহিষ্ণুতাও যেন আমরা দেখাই। কারণ ইসলাম শান্তির ধর্ম, সৌহার্দ্যরে ধর্ম, ভ্রাতৃত্যের ধর্ম। দলমত নির্বিশেষে ধর্মপ্রাণ সব মুসলমানই অন্যান্য ধর্মের প্রতি সমানভাবে সম্মান দেখিয়ে আমাদের দেশটা অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উন্নত সমৃদ্ধ সোনার বাংলাদেশ হিসেবে যাতে গড়ে ওঠে সেই প্রচেষ্টাই আমরা চালাব।

আজকে করোনা এবং রাশিয়া-ইউক্রেন যুদ্ধের কারণে যে বিশ্বব্যাপী অর্থনৈতিক মন্দা দেখা দিয়েছে আমরা বাংলাদেশটা যেন তার থেকে মুক্ত থাকি। তাই সবার কাছে আমার আবেদন থাকবে কোথাও যেন কোনো অনাবাদী জমি না থাকে। সব জায়গার জমিতে আবাদ করে আমাদের খাদ্য চাহিদা পূরণ করে আমরা নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে সম্মানের সঙ্গে যেন আমাদের দেশকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারি।

আরও পড়ুন -
  • সর্বশেষ
  • সর্বাধিক পঠিত