আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণের সঙ্গে রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্সপ্রবাহ বৃদ্ধি

জুনে রিজার্ভ ছাড়াবে সাড়ে ৩৬ বিলিয়ন ডলার

প্রকাশ : ১৯ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  নিজস্ব প্রতিবেদক

দেশের অর্থনীতি আবার ঘুরে দাঁড়াচ্ছে। আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণে আসার পাশাপাশি রপ্তানি আয় ও রেমিট্যান্স প্রবাহ বেড়ে যাওয়ায় অর্থনীতি ফের গতিশীল হচ্ছে। এর ফলে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের ওপর যে চাপ তৈরি হয়েছিল, তা ধীরে ধীরে প্রশমিত হচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বলেছে, আগামী সাড়ে ৫ মাসে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভ অন্তত ৪ বিলিয়ন ডলার বাড়বে। ফলে আগামী জুন মাসে এই রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়াবে সাড়ে ৩৬ বিলিয়ন ডলারে। বর্তমানে রিজার্ভ আছে ৩২ দশমিক ৫১ বিলিয়ন ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের প্রধান অর্থনীতিবিদ হাবিবুর রহমান জানিয়েছেন, অর্থনীতির বেশ কিছু সূচকে উন্নতি লক্ষ করা যাচ্ছে। বাংলাদেশ ব্যাংক যে টার্গেট নির্ধারণ করেছে তাতে জুনে রিজার্ভ বেড়ে দাঁড়াবে সাড়ে ৩৬ বিলিয়ন ডলার। তিনি বলেন, আমদানি ব্যয় নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয়েছে। রপ্তানি আয় বেড়েই চলেছে। রেমিট্যান্সও বেড়ে গেছে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের টার্গেট অনুযায়ী আগামী জুন মাস নাগাদ রপ্তানি আয়ে প্রবৃদ্ধি হতে পারে সাড়ে ৭ শতাংশ। আর চলতি অর্থবছরে রপ্তানির পরিমাণ ৫৩ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি হতে পারে। এছাড়া জুন মাসে রেমিট্যান্স ৪ শতাংশ বেড়ে চলতি অর্থবছরে প্রবাসী আয় ২৩ বিলিয়ন ডলারের কাছাকাছি হতে পারে। এছাড়া এই অর্থবছরে আমদানি হতে পারে ৮০ বিলিয়ন ডলার।

বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের অন্যতম প্রধান উৎস প্রবাসীদের পাঠানো রেমিট্যান্স প্রবাহে ফের সুবাতাস বইতে শুরু করেছে। গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরের মতো নতুন বছরের প্রথম মাস জানুয়ারিতেও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ এই সূচকে উল্লম্ফন দেখা যাচ্ছে। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের কর্মকর্তারা বলছেন এই ধারা অব্যাহত থাকবে। বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, চলতি জানুয়ারি মাসের প্রথম ১৩ দিনে প্রায় ৯৩ কোটি ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা। প্রতিদিন গড়ে এসেছে ৭ কোটি ১৫ লাখ ডলার।

বাংলাদেশ ব্যাংকের মুদ্রানীতি ঘোষণাকালে বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর আব্দুর রউফ তালুকদার জানান, করোনায় আমরা ঘুরে দাঁড়িয়েছি। এখন যে পরিস্থিতি রয়েছে, এর চেয়ে আর খারাপ হবে না। তিনি উল্লেখ করেন, আমাদের অর্থনীতির যে সহনশীলতা, তা কোনো একটা ধাক্কায় পড়ে যাবে না। তিনি বলেন, ‘আমি বাংলাদেশ ব্যাংকে যোগ দেওয়ার পর আমদানি কমাতে নানা পদক্ষেপ নিয়েছি। বেশি দামে ঋণপত্র যেন খোলা না হয়, সে জন্য ব্যবস্থা নিয়েছি। এসব পদক্ষেপের ফলে আমদানি কমেছে। এখন প্রতি মাসে আমদানিতে যে খরচ হচ্ছে, রপ্তানি আয় ও প্রবাসী তার চেয়ে বেশি। তবে আগের আমদানি দায় এখন পরিশোধ করতে হচ্ছে। এজন্য ডলারের সমস্যা কাটিয়ে উঠতে আরও কিছু দিন সময় লাগবে।

এদিকে বাংলাদেশ ব্যাংকের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, নতুন বছরের প্রথম মাসের ১৩ দিনে যে হারে রেমিট্যান্স এসেছে, মাসের বাকি ১৮ দিনে সেই হারে আসলে জানুয়ারিতে রেমিট্যান্সের পরিমাণ গত জুলাই ও আগস্ট মাসের মতো ২ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়ে যাবে।

কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্যে দেখা যায়, গত বছরের শেষ মাস ডিসেম্বরে রেমিট্যান্স বেশ খানিকটা বেড়েছে। এই মাসে ১৭০ কোটি (১ দশমিক ৭০ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা চার মাসের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। গত বছরের ডিসেম্বরের চেয়ে বেশি ৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। আগের তিন মাস নভেম্বর, অক্টোবর ও সেপ্টেম্বরে এসেছিল যথাক্রমে ১৫৯ কোটি ৫২ লাখ, ১৫২ কোটি ৫৫ লাখ এবং ১৫৩ কোটি ৯৬ লাখ ডলার। তার আগের দুই মাসেই ২ বিলিয়ন (২০০ কোটি) ডলারের বেশি রেমিট্যান্স পাঠিয়েছিলেন প্রবাসীরা। জুলাই মাসে এসেছিল ২০৯ কোটি ৬৩ লাখ ডলার; আগস্টে আসে ২০৩ কোটি ৬৯ লাখ ডলার।

অর্থাৎ চলতি ২০২২-২৩ অর্থবছরের প্রথমার্ধে অর্থাৎ জুলাই-ডিসেম্বর সময়ে ১ হাজার ৪৯ কোটি ৩২ লাখ (১০.৪৯ বিলিয়ন) ডলার পাঠিয়েছেন প্রবাসীরা, যা গত বছরের একই সময়ের চেয়ে ২ দশমিক ৪১ শতাংশ বেশি। গত ২০২১-২২ অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ১০ দশমিক ২৪ বিলিয়ন ডলার রেমিট্যান্স এসেছিল দেশে।

এদিকে চলতি অর্থবছরের প্রথম ছয় মাসে ২৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য রপ্তানি করা হয়েছে, যা আগের অর্থবছরের একই সময়ের তুলনায় ১১ শতাংশ বেশি। একই সঙ্গে, তা নভেম্বরে হওয়া রেকর্ডকেও ভেঙেছে। ডিসেম্বর মাসে ৯ শতাংশের কিছু বেশি প্রবৃদ্ধি নিয়ে রপ্তানি হয়েছে ৫ দশমিক ৩৭ বিলিয়ন ডলারের পণ্য, যা একক মাসের হিসাবে এযাবৎকালের সর্বোচ্চ। গার্মেন্ট ব্যবসায়ীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, রাশিয়া ইউক্রেন যুদ্ধের প্রভাবে বিশ্বমন্দায় ইউরোপ-আমেরিকার ক্রেতারা পণ্য কেনা কমিয়ে দিলেও আলো হয়ে দাঁড়িয়েছে অপ্রচলিত বাজারগুলো। ১৭টি নতুন দেশে অন্তত ৪ হাজার মিলিয়ন ডলারের পোশাক রপ্তানি হয়েছে।

পোশাক কারখানার মালিকরা বলছেন, আগে কারখানায় ইউরোপ-আমেরিকান বায়ারদের পণ্য তৈরি হতো। ইউক্রেন-রাশিয়া সংকট শুরু পর অর্ডার কমে যায়। তবে ২০২২ সালে ভারত-জাপান কিংবা অস্ট্রেলিয়ার মতো অপ্রচলিত বাজারে রপ্তানি করে ভালো আয় পাচ্ছেন তারা। এদিকে বিশ্বব্যাংক বাংলাদেশের অর্থনীতি নিয়ে সর্বশেষ যে পূর্বাভাস দিয়েছে, সেখানেও ভারত ছাড়া দক্ষিণ এশিয়ায় ভালো অর্থনীতির দেশের তালিকায় সবার উপরে রেখেছে বাংলাদেশকে।

বিশ্বব্যাংক বলেছে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে বাংলাদেশের ৫ দশমিক ২ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে। ২০২৩-২৪ অর্থবছরে প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে ৬ দশমিক ২ শতাংশ। যদিও পাকিস্তানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে হবে ২ শতাংশ; ২০২৩-২৪ অর্থবছরে হতে পারে ৩ দশমিক ২ শতাংশ। ভুটানে ২০২২-২৩ অর্থবছরে ৪ দশমিক ১ শতাংশ, নেপালে ৫ দশমিক ১ শতাংশ এবং শ্রীলঙ্কায় ৪ দশমিক ২ শতাংশ নেগেটিভ (মাইনাস) প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে বলে পূর্বাভাস দিয়েছে বিশ্বব্যাংক। সংস্থাটি মনে করে, ২০২২-২৩ অর্থবছরে ভারতে ৬ দশমিক ৯ শতাংশ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে; ২০২৩-২৪ অর্থবছরে হবে ৬ দশমিক ৬ শতাংশ।