রোজার সময় বেড়ে যায় পেঁয়াজ-রসুনের ব্যবহার, সেই সঙ্গে দামও যায় বেড়ে। ব্যবসায়ীরা চাহিদা বাড়ার সুযোগ নেন বলে অভিযোগ বহু দিনের।
তবে এবার রোজায় রান্নার প্রয়োজনীয় এই দুটি কৃষিপণ্যের মধ্যে পেঁয়াজের দাম বাড়বে না বলে আশ্বস্ত করেছেন ব্যবসায়ীরা। গতকাল সোমবার জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের প্রধান কার্যালয়ে এক মতবিনিময় সভায় তারা বলেছেন, এবারের রমজান মাস পেঁয়াজ উৎপাদন মৌসুমের মধ্যে হওয়ায় দাম স্থিতিশীল থাকবে। তবে রসুন ও আদা আমদানির জন্য সময়মতো এলসি (ঋণপত্র) খুলতে পারার উপর জোর দিয়েছেন তারা। নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যের (আদা, রসুন, হলুদ ও শুকনো মরিচ) মূল্য পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে পাইকারি ও খুচরা ব্যবসায়ীদের নিয়ে এই মতবিনিময় সভা করে ভোক্তা অধিদপ্তর। অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান সভায় বলেন, কিছু অসাধু ব্যবসায়ীর কারণে রমজানের সময়ে বাজার অস্থির হয়ে যায়। তাই পুরো রমজানজুড়ে বাজারে অধিদপ্তরের মনিটরিং জোরদার করা হবে। পাশাপাশি ব্যবসায়ীদের যদি সরকারের কাছ থেকে কোনো সাপোর্ট লাগে, তা দিতেও জাতীয় ভোক্তা-অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর সদা প্রস্তুত। এ সময় শ্যামবাজার কৃষিপণ্য আড়ত সমিতির সহ-সভাপতি হাজী মোহাম্মদ মাজেদ বলেন, ‘এ সময় পেঁয়াজ, রসুন, আদা, হলুদ, মরিচ নিয়ে বেশি কথা হয়। পেঁয়াজ খুবই ভালো আছে। এ নিয়ে চিন্তার কারণ নেই। রমজানে বাজার খুব একটা বাড়বে বলে আমার মনে হয় না। কিন্তু আমদানি না হওয়ার কারণে রসুনের বাজার ১৫ দিন হলো বাড়ছে। এ ক্ষেত্রে আদা-রসুনের এলসিটা পেলে আশা করি কোনো সমস্যা হবে না। না পেলে একটু সমস্যা হতে পারে। শ্যামবাজারের আমদানিকারক হাফিজুর রহমান বলেন, আমাদের দেশে নতুন রসুন আসার সময়টা এখনও আসেনি। সেক্ষেত্রে যেখান থেকে আমদানি করব, সেখানে যদি দাম বেড়ে যায়, তাহলে আমরা দাম কমাতে পারব না। এখন সমস্যা হচ্ছে, আমরা এলসি পাচ্ছি না। প্রয়োজনমতো এলসি করা হোক। সাপ্লাই এবং ডিমান্ডের মাঝে যদি ঘাটতি থাকে, আমরা নিয়ন্ত্রণ করতে পারব না। তবে কারওয়ান বাজারের খুচরা ব্যবসায়ী মোহাম্মদ দেলোয়ার হোসেন মনে করেন, বাজারে রসুনের দাম বেড়ে যাওয়ার পেছনে ডলার সংকট কিংবা এলসি একটা অজুহাত মাত্র। তিনি ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতার আলোকে বলেন, ‘আমরা দেখেছি, কোম্পানিরা আমাদের সঙ্গে ছলনা করে। কারণ আজ থেকে ৪ মাস আগে এক কেজি পোলাওর চাল ছিল ১০০ টাকা, এখন হইছে ১৫০ টাকা। এইটা তো ইম্পোর্টে আসে নাই। এইটা তো আমাদের দেশি সম্পদ। আমাদের কৃষক করছে। ওনারা এইটাকে স্টক কইরা বেশি দামে বিক্রি করতেছে। বারবার ওনারা ডলারের কথা বলতেছেন, আপনারাও ডলারের কথা বলছেন। যখন মালের দাম বাড়ে, তখন ওনাদের কাছে ১০০ গ্রাম মালও থাকে না। যখন দাম কমে, তখন ওনাদের কাছে মেট্রিক মেট্রিক টন মাল। আপনারা এইগুলো দেখেন না, শুধু দেখেন ডলারের দাম বাড়ছে। সরকারের দোষ। ব্যবসায়ীর দোষ। আপনারা কোম্পানি তল্লাশি করেন, দেখবেন কোনো সমস্যা নাই। এই ব্যবসায়ী উদাহরণ দিয়ে বলেন, আজকে মুখে মুখে ডালের দাম বাড়ছে। যখন তীর কোম্পানি, ফ্রেশ, এসিআই কোম্পানি ইমপোর্ট করে নাই, তখন মুসুরির ডাল ছিল ৪০ টাকা। ওনারা যখন থেকে ইমপোর্ট শুরু করছে, তখন দাম হইছে ১৪০ টাকা।’ সভায় বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের উপ-প্রধান মাহমুদুল হাসানও বলেন, ‘ডলারের দামের সঙ্গে সমন্বয়ের জন্য আমদানিকৃত নিত্যপণ্যের দাম ৩০ শতাংশ বাড়তে পারে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যাচ্ছে তার উল্টোটা। গত এক মাসে আমাদের এখানে দামে পরিবর্তন আসছে। আমাদের লোকাল রসুন ৮০ শতাংশ, মাত্র ২০ শতাংশ আমরা ইমপোর্ট করি। কিন্তু সেই ২০ শতাংশের দামটাই আমাদের লোকাল মার্কেটকে ডমিনেট করছে। ভোক্তা সংগঠন ক্যাবের প্রতিনিধি কাজী মো. আব্দুল হান্নান সভায় বলেন, ক্যাবের পক্ষ থেকে বাজার মনিটরিং করেছি, দেখেছি যে এই (রসুন, আদা, মশলা) ধরনের পণ্যের বাজার আচমকা বেড়ে গেছে। দেখা গেছে যে, আমাদের লোকাল পণ্যের দাম ১২০ শতাংশ বেড়ে গেছে। লোকাল প্রোডাক্টের দাম কেন এত বেশি হবে ব্যবসায়ীদের সংগঠন এফবিসিসিআইর ভাইস-প্রেসিডেন্ট আমিন হেলালি বলেন, আমরা যারা ব্যবসায়ী, সরকারের সব নিয়মণ্ডকানুন মেনে ব্যবসা করতে চাই। আজকে হলুদ, রসুন, পেঁয়াজ নিয়ে কথা হচ্ছে। তথ্য অন্যুায়ী, আমাদের সামান্য কিছু আমদানি করতে হয়। আজকে আন্তর্জাতিক বাজারে সাপ্লাই চেইনে সমস্য। কিন্তু এই সমস্যার সুযোগটা যেন না নেই আমরা।’ অসাধু ব্যবসায়ীদের ধরতে সরকারকে সহযোগিতা করার আশ্বাসও দেন তিনি। সেই সঙ্গে এলসি খোলা সহজ করার সুপারিশ করেন তিনি। সবশেষে ব্যবসায়ীদের অনুরোধ করে ভোক্তা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক বলেন, আজকে কারওয়ান বাজারে যে শসা ৩২ টাকা, শান্তিনগরে গেলে তা ৮০ টাকা হয়ে যায়। এই রমজানে ইফতারির সময় পণ্য মুখে দেয়ার পর রোজাদার যাতে দীর্ঘশ্বাস না ছাড়ে, সেই জায়গাটায় আমরা সবার সহযোগিতা চাচ্ছি। একই সঙ্গে আতঙ্কিত হয়ে বেশি বেশি পণ্য কিনতে হুমড়ি না খেতে ভোক্তাদের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। আমাদের ভোক্তাদের ধারণা হয়ে গেছে যে, রমজানের সময় সবকিছুর দাম বেড়ে যাবে। তাই তারা রমজানের আগে একই সঙ্গে প্রচুর পরিমাণে পণ্য কিনে ফেলে রাখে। তাতে রমজানের আগের সপ্তাহে একটা অস্থিরতা তৈরি হয়।