বিএসএমএমইউ

স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে চিকিৎসকদের চ্যালেঞ্জ নিয়ে গবেষণা প্রকাশ

প্রকাশ : ২৫ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  প্রেস বিজ্ঞপ্তি

বাংলাদেশের জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে স্বাস্থ্যসেবা প্রদানে চিকিৎসকদের চ্যালেঞ্জ নিয়ে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) গবেষণার ফলাফল অবহিতকরণ সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে।

গত সোমবার বিকাল ৩টায় বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় সুপার স্পেশালাইজড হাসপাতালের মিলনায়তনে পাবলিক হেলথ ও ইনফরমেটিজ বিভাগ এ অবহিতকরণ সভার আয়োজন করে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ ও ইনফরমেটিজ বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক গবেষক ডা. মো. খালেকুজ্জামান এ ফলাফল উপস্থাপন করেন। সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ মন্ত্রী জাহিদ মালেক বলেন, চিকিৎসকদের সংখ্যা এখনও প্রয়োজনের তুলনায় অনেক কম। এতে তারা কাজের চাপে থাকেন। তাছাড়া রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে নিরাপত্তাহীনতা রয়েছে, এটা থাকবেই। রাতারাতি দেশের সামাজিক অবস্থার পরিবর্তন করা যাবে না। তবে চিকিৎসকদের নিরাপত্তায় কিছু জায়গায় আনসার মোতায়েন করা হয়েছে। পর্যায়ক্রমে সব হাসপাতালেই নিরাপত্তা নিশ্চিত করা হবে।

তিনি বলেন, জেলা ও উপজেলা পর্যায়ের হাসপাতালগুলোর টয়লেটগুলো ব্যবহারের অনুপযোগী, দুই তৃতীয়াংশ হাসপাতালের এক্স-রেসহ সব মেশিনপত্র নষ্ট। এগুলোর দায় সিভিল সার্জন এবং ইউএইচএফপিওদের নিতে হবে।

মন্ত্রী বলেন, প্রতিষ্ঠান প্রধান ভালো হলে বেশিরভাগ সমস্যার সমাধান করা সম্ভব।

অনুষ্ঠানে সভাপতির বক্তব্যে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক ডা. মো. শারফুদ্দিন আহমেদ বলেন, উপজেলা স্বাস্থ্যসেবা কেন্দ্রে বিনামূল্যে ওষুধ নেয়ার জন্য একজন রোগী একসঙ্গে চার-পাঁচ বিভাগের চিকিৎসকের কাছে যান, এটির সমাধান করতে হবে। সামনের দিনগুলোতে উপজেলায় নারী-পুরুষ চিকিৎসকদের সমতায়ন নিশ্চিতে কোটা ব্যবস্থার প্রবর্তন করা যেতে পারে। চিকিৎসকদের পদোন্নতি অটোমেশন করতে হলে চিকিৎসকদের ৪টি ক্যাডার প্রয়োজন। অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন স্বাস্থ্যশিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. টিটো মিয়া, বাংলাদেশ মেডিক্যাল রিসার্চ কাউন্সিলের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ডা. সৈয়দ মোদাচ্ছের আলী। অনুষ্ঠানে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক ডা. ছয়েফ উদ্দিন আহমদ, উপ-উপাচার্য (গবেষণা ও শিক্ষা) অধ্যাপক ডা. মো. মনিরুজ্জামান খান, কোষাধ্যক্ষ অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ আতিকুর রহমান, সার্জারি অনুষদের ডিন অধ্যাপক ডা. মোহাম্মদ হোসেন, প্রিভেন্টিভ এন্ড সোস্যাল মেডিসিন অনুষদের ডিন অধ্যাপক সৈয়দ শরীফুল ইসলাম, প্রক্টর ও ইউরোলজি বিভাগের অধ্যাপক ডা. মো. হাবিবুর রহমান দুলাল, রেজিস্ট্রার ডা. স্বপন কুমার তপাদার প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন। গবেষণা লব্ধ প্রবন্ধে বলা হয়, বাংলাদেশের বড় সংখ্যক মানুষ স্বাস্থ্যসেবার জন্য জেলা হাসপাতাল ও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সের উপর নির্ভরশীল। এই স্বাস্থ্যসেবা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চিকিৎসকরা বিভিন্ন ধরনের চ্যালেঞ্জের মুখোমুখি হন। যা সঠিক স্বাস্থ্যসেবা প্রদানের অন্তরায়। এ চ্যালেঞ্জগুলো সমাধান করা গেলে কর্মস্থলে চিকিৎসকদের অনুপস্থিতি কমিয়ে উন্নত সেবা দেয়ার পরিবেশ তৈরি সম্ভব বলে এতে জানানো হয়। এ গবেষণায় বাংলাদেশের ৯টি জেলা হাসপাতাল এবং ১৭টি উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে সার্ভে চেকলিস্টের মাধ্যমে হাসপাতালগুলোর সার্বিক অবস্থা পর্যবেক্ষণের পাশাপাশি ৭৭ জন উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা/সিভিল সার্জন/সুপারিনটেনডেন্ট/ মেডিক্যাল অফিসার আবাসিক মেডিক্যাল অফিসারদের সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে সংগৃহীত তথা পর্যালোচনা করা হয়। এ গবেষণাটি ২০২০ সালের নভেম্বর থেকে ২০২১ সাল পর্যন্ত তথ্য নেয়া হয়। শতভাগ জেলা হাসপাতালে রক্ত পরিসঞ্চালন মোটে থাকলেও শতকরা ৪১.২ ভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে এই সেবাটি পাওয়া যায় না। জেলা হাসপাতাল এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স যথাক্রমে শতকরা ৮৮.৯ এবং ৪১.২ ভাগ ক্ষেত্রে এক্স-রে পরিষেবা পাওয়া গেছে। শতকরা ৮৮.৯ ভাগ জেলা হাসপাতাল এবং ৭৬.৫ ভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে ইসিজি পরিষেবা পাওয়া গেছে। শকতরা ৪৪.৪ ভাগ জেলা হাসপাতাল এবং ১১.৮ ভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আল্ট্রাসনোগ্রাম সুবিধা পাওয়া গেছে। শতকরা ৭৭.৮ ভাগ জেলা হাসপাতালে এবং শতকরা ৬৪.৭ ভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে মহিলা রোগীদের/অ্যাটেনডেন্টদের জন্য আলাদা টয়লেট এর ব্যবস্থা পাওয়া যায়নি। শতভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকদের জন্য ডরমিটরি/কোয়ার্টার সুবিধা থাকলেও জেলা হাসপাতালে এর উপস্থিতি শতভাগ ৪৪.৪ ভাগ। শতকরা ৫২.৯ ভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকদের জন্য ব্যবহার উপযোগী ডরমিটরি/কোয়ার্টার পাওয়া গেলেও জেলা হাসপাতালে এর পরিমাণ শতকরা শূন্য শতকরা ২০.০ ভাগ জেলা হাসপাতালে এবং শতকরা ১৭.৬ ভাগ উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে চিকিৎসকদের জন্য থাকা ডরমিটরি/ কোয়ার্টারে গার্ড থাকার তথ্য পাওয়া গেছে।

অনুমোদিত পদের বিপরীতে শূন্য পদের চিত্র : জেলা হাসপাতালে শতকরা ৩০ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ৬৩ ভাগ আবাসিক মেডিক্যাল অফিসারের পদ শূন্য রয়েছে। জেলা হাসপাতালে শতভাগ ৫১ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ৭৭ ভাগ জুনিয়র/ সিনিয়র কনসালটেন্ট শূন্য রয়েছে। জেলা হাসপাতালে শতকরা ৬৫ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ৩৮ ভাগ মেডিক্যাল অফিসার/সহকারী সার্জন পদ শূন্য রয়েছে। নার্সিং স্টাফ/মিডওয়াইফ পদের ক্ষেত্রে জেলা হাসপাতালে শতকরা ১৫ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ২৫ ভাগ পদ শূন্য পাওয়া গেছে। জেলা হাসপাতালে শতকরা ৫১ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ৪২ ভাগ মেডিক্যাল টেকনোলজিস্ট / টেকনিশিয়ান পদ শূন্য পাওয়া গেছে। জেলা হাসপাতালে শতকরা ২০ ভাগ ক্লিনার পদ শূন্য থাকলেও উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শূন্য ক্লিনার পদের পরিমাণ শতকরা ৬৬ ভাগ। জেলা হাসপাতালে শতকরা ৩১ ভাগ এবং উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে শতকরা ৫৩ ভাগ নিরাপত্তা প্রহরী বা আনসারের পদ শূন্য পাওয়া গেছে।

অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জ : প্রয়োজনের তুলনায় কম, ছোট, পুরোনো ও ঝুঁকিপূর্ণ সেবাকক্ষ, অপরিচ্ছন্ন টয়লেট এবং নিরাপদ পানির অভাব, অনুপযুক্ত হসপিটাল বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, মেডিক্যাল অফিসার/ল্যারেটরি টেকনিশিয়ান/সহায়ক কর্মী সংকট, অতিরিক্ত কাজের চাপ, সঠিক চিকিৎসা প্রদানের জন্য স্বাস্থ্য সরঞ্জাম প্রযুক্তির অভাবকে অবকাঠামোগত চ্যালেঞ্জ হিসেবে চিকিৎসকদের চিহ্নিত করেছেন। অন্যায্য সুবিধাভোগীদের প্রভাব ও নিরাপত্তার অভাব সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ : কিছু কিছু রাজনৈতিক নেতার অনাকাঙ্ক্ষিত চাপ ও প্রস্তাব, কোনো কোনো ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রভাবশালী ব্যক্তি ও কিছু স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীর অবাঞ্ছিত হস্তক্ষেপ কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের সেবা প্রদানকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলে দেয়। নীতি সম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ : উচ্চ শিক্ষা বা প্রশিক্ষণের সুযোগের অভাব, কর্মক্ষেত্রে বদলি বৈষম্য, অর্জিত জ্ঞান বাস্তবায়নে সুযোগের অভাব, বিভিন্ন ক্যাডার সার্ভিসের মধ্যে বৈষম্য চিকিৎসকদের কর্মক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য চ্যালেঞ্জ।

পারিপার্শ্বিক পরিবেশগত চ্যালেঞ্জ : জীর্ণশীর্ণ আবাসন ব্যবস্থা, শিশুদের জন্য মানসম্মত শিক্ষা সুবিধার অভাব, দুর্বল যোগাযোগ ও পরিবহন ব্যবস্থা কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের অবস্থানকে নিরুৎসাহিত করে।

সুপারিশ : মানসম্পন্ন স্বাস্থসেবা নিশ্চিত করার জন্য স্বাস্থ্যকর্মীদের সব স্তরের শূন্য পদ পূরণ করা প্রয়োজন। অর্জিত দক্ষতা অনুযায়ী চিকিৎসকদের যথাযথ পোস্টিং নিশ্চিত করা উচিত। পৃথক পরামর্শ রুম, ওয়েটিং রুম, ডাক্তারের কক্ষ, চিকিৎসক ও রোগী উভয়ের জন্য পরিষ্কার টয়লেট সুবিধা, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ ও পানি সরবরাহের মাধ্যমে কর্মক্ষেত্রের পরিবেশের উন্নতি করা প্রয়োজন। প্রয়োজনীয় যন্ত্রপাতি রসদ, প্রশিক্ষিত জনবল, ল্যাবরেটরি পরিষেবাগুলো উন্নত করা দরকার। কর্মক্ষেত্রে চিকিৎসকদের সার্বিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হবে।

চিকিৎসকদের সঙ্গে রোগীর অ্যাটেনডেন্ট, স্থানীয় প্রভাবশালী এবং স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মীদের মধ্যে সুসম্পর্ক তৈরি করতে উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন। হাসপাতালের উপযুক্ত বর্জ্য ব্যবস্থাপনার ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। চিকিৎসকদের জন্য মানসম্মত আবসন সুবিধা নিশ্চিত করা প্রয়োজন। পোস্টিং, বদলি এবং পদোন্নতির জন্য যুগোপযোগী নীতিমালা তৈরি এবং বাস্তবায়ন করা প্রয়োজন। চিকিৎসকদের উচ্চশিক্ষা এবং প্রশিক্ষণ সংক্রান্ত নীতিমালা প্রয়োজনীয় সংশোধন করা এবং চিকিৎসকদের পূর্বশর্ত সম্পন্ন করার সঙ্গে সঙ্গে পছন্দসই বিষয়ে শিক্ষা গ্রহণের সুযোগ দেয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ করতে হবে।