টেকনাফ জেলায় উখিয়ার সাগরপাড়ের জলাশয়গুলোয় গবেষণার মাধ্যমে শৈবাল চাষ শুরু হলে সামুদ্রিক শৈবাল চাষের গবেষণায় ব্যাপক সফলতা পেয়েছেন দেশের কৃষি বিজ্ঞানীরা। ছোট পরিসরে শৈবাল চাষে আলোর মুখ দেখায় বিজ্ঞানীরা এটি বাণিজ্যিকভাবে বড় পরিসরে চাষের সম্ভাবনা দেখছেন। বর্তমানে দেশে প্রায় চার শতাধিক কৃষক শৈবাল চাষ করছেন। খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার সঙ্গে ওষুধ ও শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে শৈবালের যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। তাই উদ্যোক্তারা চাইলে সমুদ্র উপকূলের এই অর্থকরী ফসলটি চাষ করে লাভবান হতে পারবেন। কৃষি অর্থনীতিবিদরা মনে করছেন, এখন উদ্যোক্তারা শৈবাল চাষে গেলে যেমন লাভবান হবেন, ঠিক তেমনি শৈবালের চাষও বিস্তৃত হবে। এতে করে অর্থনীতিতে দেশ এগিয়ে যাবে।
বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট সূত্র জানায়, শুরুতে বাংলাদেশে ১০২ গ্রুপের ২১৫ প্রজাতির শৈবালের মধ্য থেকে সেন্টমার্টিন দ্বীপ ও তার নিকটতম অঞ্চল থেকে ১২ প্রজাতি শৈবাল সংগ্রহ করা হয়। আবার এরমধ্যে ৮ প্রজাতি থেকে সফলতা পাওয়া যায়। এ ৮ জাতের মধ্যে অপেক্ষাকৃত দেশীয় ব্র্যসেলিয় ও সবুজ রঙের শৈবাল চাষে বেশি সফলতা পাওয়া গেছে। তবে বাকি ৬ প্রজাতি শৈবালও চাষ করা সম্ভব। ২০১৬ সালে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের (বিএআরআই) তত্ত্বাবধানে Capacity Building for Conducting Adaptive Trials on Seaweed Cultivation in Coastal Areas নামে একটি প্রকল্পের অধীনে সমুদ্রের উপকূলে শৈবাল চাষ ও গবেষণা শুরু হয়। মূলত এখান থেকেই দেশে শৈবাল চাষ নিয়ে বড় সফলতা দেখা মিলতে থাকে।
এ বিষয়ে কৃষি গবেষণা প্রতিষ্ঠান বিএআরআইয়ের কক্সবাজার অফিস প্রধান ও ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মোহাম্মদ শরফুদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, ২০১৬ সাল থেকে কক্সবাজারের টেকনাফ, উখিয়া ও সদর উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলের সাগরপাড়ের জলাশয়গুলোতে গবেষণার মাধ্যমে শৈবাল চাষ শুরু হয়।
এই গবেষণা কার্যক্রমে অন্তত ২০ জন বিজ্ঞানী, ১০ জন বৈজ্ঞানিক সহকারী, ১৫ জন সম্প্রসারণ কর্মী, আগ্রহী উদ্যোক্তা এবং ৪০০ জনের অধিক কৃষকদের প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। গত দুই বছর ধরে এসব কৃষকরা বছরে প্রায় ২৫০ মেট্রিক টন শৈবাল উৎপাদন করছেন। প্রতি হেক্টরে দেশীয় ব্র্যসেলিয় জাতের শৈবাল উৎপাদন হচ্ছে ৫৫ থেকে ৬৫ মেট্রিক টন। সবুজ রঙের ২০ থেকে ৪০ মেট্রিক টন পর্যন্ত উৎপাদন হচ্ছে। কেজি ভেদে গড়ে প্রায় ৩০ থেকে ৪০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি হয়ে থাকে শৈবাল।
দীর্ঘ কয়েক বছরের শৈবাল চাষ ও গবেষণার সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিজ্ঞতায় এ কৃষি বিজ্ঞানী বলেন, আমরা এখন উদ্যোক্তাদের অপেক্ষায় আছি। চাইলে যেকোনো উদ্যোক্তা বড় পরিসরে বাণিজ্যিকভাবে শৈবাল চাষ করতে পারেন। মূলত সামুদ্রিক পরিবেশ ও পানি দরকার হয় এসব জাতের শৈবাল চাষ করতে। তাই এ জাতের শৈবাল চাষ করতে হলে সামুদ্রিক উপকূল এলাকায় আসতে হবে। অবশ্য আমরা বাসা বাড়ির শৈবাল চাষ নিয়েও গবেষণা করছি।
তিনি জানান, উদ্ভাবিত ওই প্রজাতিগুলো চাষাবাদের (one step seed production) জন্য উপযুক্ত সময় (অক্টোবর-এপ্রিল) ও পরিবেশ নির্ধারণ করা হয়েছে। এছাড়াও জাপানি একটি সামুদ্রিক শৈবাল প্রজাতিকে (উলভা ল্যাকটুকা বা সামুদ্রিক লেটুস) বাংলাদেশের উপকূলে চাষের পদ্ধতি (one step seed production) উদ্ভাবন করা হয়েছে।
বারি’র কৃষি অর্থনীতিবিদ ও গবেষক মো. আক্তার হোসেন জানান, উদ্যোক্তারা এখন শৈবাল চাষে আসলে এর ব্যাপ্তি বিস্তৃত হবে। খুলে যাবে অর্থনীতির দুয়ার। সম্ভাবনাময় এ ফসলে চাষ ও উৎপাদন দুই বেড়ে যাবে। আমরা চেষ্টা করছি শৈবালের সঙ্গে বেসরকারি উদ্যোক্তাদের সংযুক্ত করার।
শৈবালের গুরুত্ব তুলে ধরে কৃষি বিজ্ঞানী মোহাম্মদ শরফুদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তার সঙ্গে ওষুধ ও শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে এর যথেষ্ট চাহিদা রয়েছে। বর্তমানে শৈবাল থেকে সুপ, সবজি বার্গার, সিঙ্গারা, সমুচা, নুডুলস, সালাদ, চাটনি, পাকোড়া, নিমকি, চকলেট, জেলিসহ সাশ্রয়ী মূল্যের পুষ্টি সমৃদ্ধ মানব ও পশুখাদ্য পোশাক শিল্প ও ওষুধ শিল্পের কাঁচামাল পণ্য উৎপাদিত হচ্ছে। যা সরকারের সমুদ্র অর্থনীতির ব্লু ইকোনমিতে ভূমিকা রাখছে। কৃষি বিজ্ঞানীরা জানান, শৈবাল একটি গুরুত্বপূর্ণ সবজি। কসমেটিকসহ শিল্পের কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহার করা হয়। দেশের চাহিদা মিটিয়ে আন্তর্জাতিক বাজারে রপ্তানি করা যাবে। অনেক ল্যাবরেটরিতে ‘এগার’ কেরাবিনা প্রোডাক্ট যার কেজি ২০ হাজার টাকা মূল্যের পণ্য তৈরি সম্ভব। সার্বিক বিষয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ও কৃষিবিজ্ঞানী ড. মো. নাজিরুল ইসলাম বলেন, কৃষিতে বাণিজ্যিকীকরণ এবং খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে উৎপাদনের সঙ্গে সঙ্গে কৃষকদের আয়, আয়ের উৎস ও কর্মসংস্থান বাড়াতে হবে। এটা করতে পারলে আমাদের গার্মেন্টস রফতানি আয় নির্ভরতা কমিয়ে কৃষি অর্থনীতি নির্ভরতা বাড়ানো সম্ভব। তিনি বলেন, আমরা যদি শৈবালের মতো অর্থনীতি সমৃদ্ধ ফসলে উদ্যোক্তাদের ডেভেলপ করতে পারলে দেশের অর্থনীতির ধারাতে অনেক বড় পরিবর্তন চলে আসবে। কেননা শৈবাল এমন মূল্যবান ফসল যা আন্তর্জাতিকভাবে বিপণনের সম্ভাবনা আছে। পাশাপাশি এখানে বিনিয়োগ করা গেলে সারা দেশেও বিপণনের সঙ্গে পুষ্টির ঘাটতি মেটানো যাবে।
প্রসঙ্গত, বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তন প্রেক্ষাপটে ভবিষ্যৎ খাদ্য ও পুষ্টি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে বর্তমান সরকার সপ্তম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনায় সামুদ্রিক সম্পদ ব্যবস্থাপনায় বিশেষ গুরুত্বারোপ করেছে। তারই ধারাবাহিকতায় সামুদ্রিক শৈবাল নিয়ে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিলের সমন্বয়ে, কৃষি গবেষণা ফাউন্ডেশনের অর্থায়নে এবং বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের সরাসরি তত্ত্বাবধানে গত ২০১৬ সালে প্রকল্পটি শুরু করা হয়। ভবিষ্যতে সামুদ্রিক শৈবাল জনপ্রিয় করতে ও বাণিজ্যিক ব্যবহার এবং বাজারজাতের উদ্দেশ্যে আরও ব্যাপক গবেষণা কার্যক্রম হাতে নেয়া জরুরি বলে মত দেন গবেষকরা।