সুসংবাদ প্রতিদিন

শিম চাষে স্বাবলম্বী চাষি

প্রকাশ : ৩১ জানুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  আলোকিত ডেস্ক

যতদূর চোখ যায় তার পুরোটাজুড়েই শিমের রাজ্য। সোনালি-বেগুনি ফুল আর সবুজ শিমের মায়ায় যেন ভরা পুরো এলাকা। মাত্র সতেরো বছরের ব্যবধানে একটি এলাকা পরিণত হয়েছে শিমের রাজ্যে।

এখন এমন কেউ নেই যারা শিম আবাদ করেন না। যাদের জমি নেই তারাও চুক্তিতে জমি নিয়ে শিমের আবাদ করে স্বাবলম্বী হয়েছেন। এবারের উৎপাদিত শিম থেকে অন্তত ২৭ কোটি টাকা ঘরে তুলবে এমন কথা জানিয়েছেন কৃষক ও কৃষি বিভাগের কর্মকর্তারা। শিম চাষের বিপ্লব ঘটেছে ময়মনসিংহের ঈশ্বরগঞ্জের সীমান্তবর্তী ব্রহ্মপুত্র নদের তীরঘেঁষা তিনটি ইউনিয়নে। তবে শিমের গ্রামের কাঁচা সড়ক পাকাকরণ ও কৃষকের সবজির জন্য বাজার সৃষ্টি করা গেলে এ অঞ্চলের সবজি থেকে বছরে কয়েকশ’ কোটি টাকা আয় করবেন কৃষকরা।

কৃষি বিভাগের পরিসংখ্যান বলছে, ২০০৫-১ অর্থবছরে পুরো ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলায় শিমের আবাদ হয়েছিল মাত্র ৫ হেক্টর জমিতে। ২০২১-২২ অর্থবছরে শিমের আবাদ হয়েছিল ১১৫ হেক্টর জমিতে। আর ২০২২-২৩ অর্থবছরে এ উপজেলায় শিমের আবাদ ঠেকেছে ৩৫০ হেক্টরে। এ অঞ্চলে বারি শিমণ্ড৪ জাতের আবাদ সবচেয়ে বেশি। পরিমাণে ইপ্সা ও স্থানীয় জাতের শিমও আবাদ হয়েছে। তবে বারি শিমণ্ড৪ চাষেই বিপ্লব ঘটেছে। এর মধ্যে রাজিবপুর ইউনিয়নের উজান চরনওপাড়া, ভাটিরচর নওপাড়া, মমরেজপুর এলাকায় চলতি বছর ১৮০ হেক্টর জমিতে শিমের আবাদ হয়েছে। উচাখিলা ইউনিয়নের চরআলগীতে ৭০ হেক্টর, তারুন্দিয়া ইউনিয়নের চরটিশ্বর গ্রামে ৪০ হেক্টর এবং বাকি ইউনিয়নগুলোতে ৬০ হেক্টর জমিতে শিম চাষ হয়েছে।

শিমের গ্রামগুলো ঘুরে দেখা গেছে, শিম তোলায় ব্যস্ত সময় পার করছেন চাষিরা। ভালো ফলন হওয়ায় খুশি তারা। মৌসুমের শুরুতে উৎপাদন কম হলেও নাম পেয়েছেন ভালো আর এখন উৎপাদন বেড়েছে, কিন্তু কমে গেছে নাম এই এলাকার শিমের চাহিদা রয়েছে দেশজুড়ে ফসলের ক্ষেত্র এবং স্থানীয় বাজার থেকে শিম কিনে ঢাকা, সিলেট, চট্টগ্রামসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে বিক্রি করেন পাইকাররা। শিম চাষ করে প্রত্যন্ত এলাকার মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নতি ঘটেছে। এর মধ্যে চরাঞ্চলের প্রধান অর্থকরী ফসল শিম। এখানকার মানুষের সিংহভাগ আয় শিম চাষ থেকে। তবে বর্তমানে ৪০০ থেকে ৫০০ টাকা মণ দরে শিম বিক্রি হচ্ছে ক্ষেত থেকে। মৌসুমের শুরুতে পাইকারি ১০০ থেকে ১২০ টাকা কেজি দরে শিম বিক্রি করেছেন এখানকার কৃষকরা। দিনভর ক্ষেত থেকে শিম তোলা হয়। ফসল শিম। বিকাল থেকে মধ্যরাত পর্যন্ত পাইকাররা শিম কিনে ট্রাক ভরে নিয়ে যায় দেশের বিভিন্ন প্রান্তে।

ভাটির চরনওপাড়া গ্রামের চাষি সাইফুল ইসলাম। এবার ২৮০ শতক জমিতে শিম চাষ করেছেন। তিনি জানান, যে জমিতে শিম চাষ করা হয় সেখানে মূলত শসা ও ঝিঙার জন্য আগে মাচা করা হতো। দশ শতক জমিতে মাচা করতে ৭ হাজার টাকার মতো খরচ হয়। সেই জমিতে প্রথমে শসা, পরে ঝিঙা ও শেষে শিম চাষ করা হচ্ছে। তিনি নিজের ৩০ শতক জমির হিসাব তুলে ধরে বলেন, তিনি ২০ হাজার টাকা খরচ করে প্রথমে শসা বিক্রি করেছেন ৭০ হাজার টাকা, ঝিঙা বিক্রি করেছেন ৩২ হাজার টাকা। একই জমি থেকে এরইমধ্যে ৮০ হাজার টাকার শিম বিক্রি করেছেন। শিমের লতাপাতাও গরুর খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করেন তারা। স্বল্প খরচে লাভ বেশি হওয়ায় জনপ্রিয় হয়ে উঠছে শিম চাষ।

কৃষক আবদুস সামাদ মণ্ডলও ১০০ শতক জমিতে শিম চাষ করেছেন। তার ভাষ্য, এখানের মানুষ মূলত সবজি চাষ করেই দিন চালায়। আগে কোনো ফসলই হতো না। অনেক কষ্টে এ অঞ্চলের মানুষের দিন কাটত। শসা চাষের পর পতিত থাকত জমি। এখন একই মাচাতে শিম চাষ করে এলাকার সবাই লাভবান হচ্ছে। এখন চরের মানুষের প্রধান অর্থকরী শিম তোলার কাজে ব্যস্ত দেখা গেছে ভাটিরচর দত্তপাড়া গ্রামের সেলিনা খাতুনকে। তিনি নিজে ভাড়া নিয়ে ৩০ শতক জমিতে শিম চাষ করেছেন। নিজের জমির পাশাপাশি অন্যদের শিমও ২০০ টাকা দিন হাজিরায় তুলে দেন তিনি। শুধু সেলিনা নন, এলাকার প্রায় ৮০ শতাংশ নারী নিজের সংসারের ফাঁকে শিমের মৌসুমে শিম তুলে বাড়তি আয় করেন। রোকেয়া আক্তার নামে এক নারী বলেন, তিনি বর্গা নিয়ে ৩০ শতক জমিতে ৬ হাজার টাকার আবাদ করেই তার ভাগ্য বদলে গেছে। খরচ করে শিম চাষ করেছেন। এরইমধ্যে ২০ হাজার টাকার শিম বিক্রি করেছেন। শিম চাষ করে তাদের সংসারে সচ্ছলতা ফিরেছে।

কৃষক সোলায়মান সিকদার বলেন, এলাকায় বিদ্যুৎ ব্যবস্থার সম্প্রসারণ, সেচ সহজ হওয়ার পর থেকেই শিমের বিপ্লব ঘটেছে। শিম চাষ করেই এলাকায় গরিবের সংখ্যা কমে গেছে। যাদের জমি নেই তারা অন্যের জমি ভাড়া নিয়ে সবজি চাষ করে পাকা বাড়ি নির্মাণ করেছেন। শিম চাষ করেই সন্তানদের পড়ালেখা চলছে, কেউ বিদেশে পাড়ি জমাচ্ছেন জীবন উন্নয়নে।

রাজিবপুরের চরাঞ্চলের ১৮০ একর জমিতে শিম চাষ হয়। এক দশক ধরে এলাকাটিতে উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার দায়িত্বে আছেন রফিকুল ইসলাম ভূঁইয়া। এলাকাটিতে শিমের বিপ্লব তার হাত ধরেই। তিনি বলেন, অল্প সময়ে অল্প খরচে শিমের আবাদ করে লাভবান হতে গ্রামে গ্রামে ঘুরে কৃষকদের উৎসাহিত করার ফসল আজকের বিপ্লব। ঈশ্বরগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা নুসরাত জামান জানান, কৃষি বিভাগের নিবিড় পর্যবেক্ষণ সঠিক পরামর্শে মাত্র সতেরো বছরের ব্যবধানে শিমের বিপ্লব ঘটেছে। এলাকার কৃষকের জীবনমান উন্নত হয়েছে। এলাকার ৮০ শতাংশ নারীই সংসারের ফাঁকে শিম তোলার কাজ করে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হচ্ছেন। সবজির জন্য পৃথক বাজার সৃষ্টি ও সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা উন্নত করলে কৃষক আরও লাভবান হবেন।