সফলতা ও ব্যর্থতার মধ্যে পর্দা নামল বাণিজ্য মেলার

প্রকাশ : ০১ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ

  রিয়াজ হোসেন, রূপগঞ্জ

ব্যবসায়ীদের হতাশা, কর্তৃপক্ষের সফলতা ও ব্যর্থতার মধ্যে দিয়ে শেষ হলো ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার ২৭তম আসরের। গতকাল মঙ্গলবার বিকালে মেলার স্থানীয় ভেন্যু পূর্বাচলের ৪ নম্বর সেক্টরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ-চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিউশন সেন্টারের অডিটরিয়ামে আয়োজিত সমাপনী অনুষ্ঠানের মাধ্যমে এ মেলার সমাপ্তি ঘোষণা করেন অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি বস্ত্র ও পাটমন্ত্রী গোলাম দস্তগীর গাজী (বীরপ্রতিক)। সমাপনী অনুষ্ঠানে সভাপতিত্ব করেন বাণিজ্যমন্ত্রী টিপু মুনশি। উপস্থিত ছিলেন, রপ্তানী উন্নয়ন ব্যুরোর ভাইস চেয়ারম্যান এএইচএম আহসান, বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের ভারপ্রাপ্ত সচিব হাফিজুর রহমান, রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর সচিব ও মেলার পরিচালক ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী প্রমুখ। অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি গোলাম দস্তগীর গাজী বলেন, এ বছর প্রধানমন্ত্রী পাটকে বর্ষসেরা পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিয়েছেন। মেলায় পাটের তৈরি বাহারি রকমের নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী বেচাকেনা হয়েছে। রপ্তানি আদেশও পাওয়া গেছে বেশ ভালো। বাণিজ্য মন্ত্রী টিপু মনশি বলেন, মেলার স্থায়ী ভেন্যু পূর্বাচলে এ মেলা বসায় রাজধানীতে অনেকটা চাপ কমেছে। এবারের মেলায় বিভিন্ন পণ্যসামগ্রীর ওপর ৩০০ কোটি টাকার রপ্তানি আদেশ পাওয়া গেছে। লোকসমাগম ঘটেছে প্রায় ৩৫ লাখের মতো। জানা যায়, ১ জানুয়ারি মেলার স্থায়ী ভেন্যু পূর্বাচলের ৪ নম্বর সেক্টরে বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশ চায়না ফ্রেন্ডশিপ এক্সিবিউশন সেন্টারে দ্বিতীয়বারের মতো শুরু হয় ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার ২৭তম আসরের। মেলা শুরু থেকে শৈত্যপ্রবাহ, ঘন কুয়াশা, টঙ্গীতে দুই দফা বিশ্ব ইজতেমার কারণে, এমনকি রাজধানীসহ আশপাশের এলাকার লোকজনের মেলায় প্রবেশের প্রধান দুই সড়ক কাঞ্চন-কুড়িল বিশ্বরোড ও এশিয়ান হাইওয়ে সড়কের উন্নয়ন কাজ চলমান থাকার কারণে এশিয়ান হাইওয়ে সড়কে প্রতিনিয়ত দীর্ঘ যানজটের কারণে প্রথম ১৫ দিন তেমন ক্রেতা দর্শনার্থীর সমাগম ঘটেনি মেলায়। এ কারণে তেমন আশানুরূপ বেচাকেনাও করতে পারেনি ব্যবসায়ীরা। সেজন্য অনেকটা লোকসানের কবলে পড়েছিল তারা। তবে মেলা শেষ মুহূর্তে লোকসমাগম ও বেচাকেনা হলেও তেমন লোকসান কাটিয়ে উঠতে পারবে না বলে জানিয়েছেন ব্যবসায়ীরা। সে কারণে মেলার ২৫তম দিনে মেলার সময় এক সপ্তাহ বাড়ানোর দাবি জানিয়েছিল ব্যবসায়ী ও ইজারাদাররা। তারা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব বরাবর পৃথক দুটি আবেদন করেন। এমনকি মেলা প্রাঙ্গণে সংবাদ সম্মেলনও করেন তারা। কিন্তু ব্যবসায়ীদের লোকসানের কথা শুনেও সময় না বাড়ানোয় হতাশায় পড়ে ব্যবসায়ী। তবে এবারের আন্তর্জাতিক মেলায় বিদেশি দর্শনার্থী ক্রেতা তেমন দেখা যায়নি। ব্যবসায়ীরা জানান, মেলার বিগত ২৫টি আসর বসেছিল রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে। সেখানে প্রতিটি মেলা শুরুর আগে রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরো ব্যাপক প্রচার প্রচারণা চালিয়েছিল। এখানে এর বালাই নেই। রাজধানী থেকে বেশ খানিক দূরে এ মেলা বসায়, সড়ক ব্যবস্থা ও বিআরটিসি ছাড়া তেমন কোনো গণপরিবহন না থাকায় রাজধানী থেকে লোকজন তেমন আসেনি। তাছাড়া প্রতিদিন সড়কে দীর্ঘযানজট থাকায় অনেকের ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও আশপাশের লোকজন তেমন আসেনি। তাছাড়া রাজধানী বাদে মেলার আশপাশের এলাকার লোকজন প্রতিদিন মেলায় ঘোরাফেরা করতে ও দেখতে এসেছে। মেলায় মূলত রাজধানীতে বসবাসরত লোকজন কেনাকাটা করেন। তাছাড়া এবছর মেলায় বিগত বছরের চেয়ে চড়া দামে দোকান বরাদ্দ নিতে হয়েছে।

মেলার লোকসান কাটিয়ে উঠতে শেষ মুহূর্তে ক্রেতাদের আকৃষ্ট করতে মেলার প্রায় সব ব্যবসায়ী পণ্যসামগ্রীতে বিভিন্ন ছাড় প্রদান করেন। সর্বোপরি ব্যবসায়ীরা এ মেলায় তেমন বেচাকেনা না করতে পেরে অনেকটা হতাশা নিয়ে ফিরছে বাড়িতে। তুর্কি প্যাভিলিয়নের ম্যানেজার সাইয়ান হতাশার সঙ্গে বলেন, এক সপ্তাহ সময় বাড়ানোর দাবি জানানো হয়েছিল কিন্তু কর্তৃপক্ষ বাড়ায়নি। অনেকেই মেলার শুরু থেকে স্টল চালু করতে পারেনি। শেষের দিকে বেচাকেনা বাড়লেও কাঙ্ক্ষিত ব্যবসা হয়নি। আমাদের স্টলে মোট ২০ জন কাজ করেছেন, সবার বেতন দিয়ে তুর্কিশরা লাভবান হবে বলে মনে হয় না। এমন হতে থাকলে তারা সামনে স্টল নিতে আগ্রহী হবে না। তাছাড়া মেলায় ব্যবস্থানার অনেক অভাব ছিল। আকতার ফার্নিচারের কর্মকর্তা সৌরভ আহমেদ বলেন, শেষ হয়ে গেল এবারের বাণিজ্য মেলার আসর। এবারের মেলায় তেমন আশানুরূপ বেচাকেনা করতে পারিনি। রাজধানীর শেরেবাংলা নগরে বেচাকেনা অনেকটা ভালো হতো। এখানে মেলার স্টল বরাদ্দ নিতে টাকা লেগেছে দ্বিগুণ। তবে আমাদের বেচাকেনার চেয়ে প্রচারণার জন্যই এখানে আসা। তবে রাজধানীতে স্বাধীনভাবে বেচাকেনা করা যেত না সন্ত্রাসীদের যন্ত্রণায়। সেটা এখানে নেই। তবে এখানে মেলা আরো ২/৩ বছর পর থেকে ভালোভাবে জমে উঠবে বলে তিনি আশাবাদী। মেলার গেট ইজারা আব্দুল্যাহ এন্টারপ্রাইজের স্বত্বাধিকারী ছালাউদ্দিন ভূঁইয়া বলেন, এ বছর গেট ইজারা নিতে হয়েছে অনেক বেশি টাকা দিয়ে। মেলায় যে পরিমাণ লোকসমাগমের আশা করেছিলাম, সে পরিমাণ লোকসমাগম ঘটেনি। সেজন্য তাদের অনেক টাকা লোকসান গুনতে হবে। আমরা মেলার সময় ৭ দিন বাড়ানোর জন্য আবেদন করেছিলাম। কর্তৃপক্ষ এ ব্যাপারে কোনো নজর দেননি। তারপরও আগামীতে কর্তৃপক্ষ এ বিষয়টির দিকে নজর দিবেন বলে তিনি আশাবাদী। বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর (ইপিবি) সচিব ইফতেখার আহমেদ চৌধুরী বলেন, সবকিছু সঠিকভাবে করা যায় না। কিছুটা তো ভুল হতেই পারে। এবারের মেলা কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ছাড়াই ভালোভাবে শেষ করতে পেরেছি সেজন্য ভালো লাগছে। তবে মেলার শুরুতে কিছুটা শৈত্যপ্রবাহ, সড়কে কাজের উন্নয়নের কারণে সমস্যা হয়েছে। মেলা বাড়ানোর জন্য ব্যবসায়ীরা লিখিত আবেদন করেছিল। কিন্তু বইমেলা ও ২ ফেব্রুয়ারি পূর্বাচলে প্রধানমন্ত্রীর আগমন উপলক্ষ্যে মেলার সময় বাড়ানো সম্ভব হয়নি। তবে আগামীতে সবকিছু ঠিক রেখে ভালোভাবে মেলার আয়োজন করা হবে বলে তিনি জানান। উল্লেখ্য, দেশীয় পণ্যের প্রচার, প্রসার, বিপণন, উৎপাদনে সহায়তার লক্ষ্যে বাণিজ্য মন্ত্রণালয় ও রপ্তানি উন্নয়ন ব্যুরোর যৌথ উদ্যোগে ১৯৯৫ সাল থেকে ঢাকা আন্তর্জাতিক বাণিজ্য মেলার আয়োজন করা হচ্ছে। এবারের বাণিজ্য মেলায় ১০টি দেশের ১৭টি প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছে। মেলায় বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জন্য ১৭টি প্যাভিলিয়ন, মিনি প্যাভিলিয়ন ও স্টল রয়েছে। এছাড়া দেশি ও বিদেশি প্রতিষ্ঠানের জন্য দুটি হলের বাইরে মিলে মোট ৩৩১টি স্টল, প্যাভিলিয়ন ও মিনি প্যাভিলিয়ন রয়েছে। মেলা প্রতিদিন সকাল ১০টা থেকে রাত ৯টা পর্যন্ত চলেছে। তাছাড়া রাজধানীর কুড়িল বিশ্বরোড থেকে মেলায় লোকজন আসা-যাওয়া করতে প্রতিদিন ৭০টি বিআরটিসি শাটল বাস চলাচল করেছে।