সংসদীয় স্থায়ী কমিটির উদ্বেগ
প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে চলছে স্থাপনা নির্মাণের প্রতিযোগিতা
প্রকাশ : ০৭ ফেব্রুয়ারি ২০২৩, ০০:০০ | প্রিন্ট সংস্করণ
এএইচ সেলিম উল্লাহ, কক্সবাজার
দেশের একমাত্র প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিনে স্থাপনা নির্মাণের প্রতিযোগিতা চলছে। স্থাপনার নির্মাণ কাজ অব্যাহত থাকলেও নীরব দর্শকের ভূমিকায় প্রশাসন। গত শনিবার সেন্টমার্টিনের অপরিকল্পিত স্থাপনা নির্মাণ ও পরিবেশ পরিস্থিতি দেখে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন বেসামরিক বিমান পরিবহণ ও পর্যটন মন্ত্রণালয় সম্পর্কিত স্থায়ী কমিটির সভাপতি র. আ. ম. উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরী। এ সময় তিনি বলেছেন, ১৯৯৭ সালের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সফর সঙ্গী হিসেবে প্রবাল দ্বীপ সেন্টমার্টিন ভ্রমণে এসেছিলাম। ওই সময় দ্বীপটি প্রাকৃতিক পরিবেশ ছিল বিমোহিত। দ্বীপ জুড়ে প্রবাল পাথর, নীল জলরাশির স্রোত, কেয়াবনের জঙ্গল। যা সকলের মন জুড়ে যেত। কিন্তু বর্তমানে এসে দ্বীপটি পরিস্থিতি অত্যন্ত উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এখানে অপরিকল্পিত অবকাঠামো আর সার্বিক অবস্থা দ্বীপকে ধ্বংসের দ্বার প্রান্তে নিয়ে গেছে। এ ধরনের অব্যবস্থাপনা চলতে থাকলে আগামী ৫ বছর পর দ্বীপটিতে কোনো পর্যটক ভ্রমণে আসবেন কি না এ নিয়ে আমি সন্দিহান।
২০২০ সালে একটি জরিপ পরিচালনা করে কক্সবাজারের পরিবেশ বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট পিপল। ওই জরিপে বলা হয়েছিল দ্বীপটিতে ছোট-বড় ১২৩টি আবাসিক হোটেল ও কটেজ ছিল। এর মধ্যে ৩২টির মতো ২ ও ৩ তলা বিশিষ্ট পাকা ভবন। পাকা ভবনগুলোর ৯৫ ভাগের মালিক দ্বীপের বাইরের। ১২৩ আবাসিক হোটেলের প্রায় প্রত্যেকটিতে নিজস্ব রেস্তোরাঁ রয়েছে। এছাড়া জেটি ঘাট ও রাস্তার পাশে স্বতন্ত্র রেস্তোরাঁ রয়েছে ৪২ টি। কিন্তু জরিপের ৩ বছরে পর এসে সেই দৃশ্যটি ভিন্ন। বর্তমানে ওখানে আবাসিক হোটেল ও কটেজের সংখ্যা দাঁড়িয়েছে ১৯০ টির বেশি। এই সংখ্যাটা একেবারেই নিশ্চিত হওয়া না গেলেও বর্তমানে দ্বীপটিতে নতুন করে ১৮টি স্থাপনার কাজ চলমান থাকার তথ্য জানিয়েছেন পরিবেশ বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন এনভায়রনমেন্ট পিপলের প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ। তিনি বলেন, সেন্টমার্টিনে অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে সংশ্লিষ্ট প্রশাসন আন্তরিক নয়। প্রকাশ্যে টেকনাফ থেকে নির্মাণ সামগ্রী নিয়ে এসব অবৈধ স্থাপনা নির্মিত হচ্ছে। প্রশাসনের কিছু কর্মকর্তা-কর্মচারীকে ম্যানেজ করে একটি চক্র দীর্ঘদিন ধরে সেন্টমার্টিনে অবৈধভাবে নির্মাণসামগ্রী নিয়ে যাচ্ছে। মাঝে মধ্যে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের লোকজন গিয়ে এসব স্থাপনা বন্ধে মৌখিক নির্দেশ দিয়ে আসেন। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয়না। প্রশাসন এ পর্যন্ত একটি স্থাপনার কাজও বন্ধ রাখতে পারেনি। প্রশাসন ফেরার পরই পুরোদমে চলে নিমার্ণ কাজ। এমন অভিযোগ পরিবেশ বিষয়ক স্বেচ্ছাসেবী সংগঠনের এ নেতার। আর এসব অভিযোগের সত্যতা মিলেছে দ্বীপটিতে সরেজমিনে ঘুরে। দ্বীপটিতে অবৈধভাবে প্রকাশ্যে অসংখ্য স্থাপনা নিমার্ণের দৃশ্য দেখা যায়। অথচ গত ২০ থেকে ২৭ জানুয়ারি ৩ দফায় অবৈধ স্থাপনা নির্মাণ বন্ধে অভিযান চালিয়েছে পরিবেশ অধিদপ্তর ও কক্সবাজার জেলা প্রশাসন। অভিযানে ১৮ টি হোটেল ও কটেজের নির্মাণ কাজ বন্ধ করার তথ্য জানিয়েছিলেন সংশ্লিষ্টরা। কিন্তু মৌখিক নিদের্শ দেয়া ওই সব স্থাপনার কাজ চলমান রয়েছে। গত বছর মেরিন প্রোটেক্টেড এরিয়া (এমপিএ) ঘোষণা করা দ্বীপটিতে প্রতিরাতেই নেয়া হয় নির্মাণ সামগ্রী। আর এসব ইট, বালু, সিমেন্ট আনার ক্ষেত্রে স্থানীয় ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে রয়েছে একটি সিন্ডিকেট। যে সিন্ডিকেটটি সকল স্তরের প্রশাসন ম্যানেজ করে নির্মাণ কাজ পরিচালনায় সহযোগিতা করেন। স্থাপনা নির্মাণ নিয়ে কথা বলতে রাজী নন কাজে নিয়োজিত কোন শ্রমিক। এমন কি অনেকেই মালিকের নাম বলতেও অপরাগতা প্রকাশ করেন। সেন্টমার্টিনের মেরিন পার্ক নামে একটি রিসোর্টে থাকা পরিবেশ অধিদপ্তরের কার্যালয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আজহারুল ইসলাম জানান, ‘দ্বীপে অভিযান পরিচালনার ক্ষেত্রে তার করার কিছুই নেই। ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা (স্যাররা) এলে অভিযান হয়। কার্যালয়ে তিনি একা থাকেন। প্রশাসনিক শক্তিও নেই কাজ বন্ধ করে দেবার। ঘুরে ঘুরে তথ্য সংগ্রহ করা ছাড়া আর কিছু তার পক্ষে সম্ভব হয় না বলে মন্তব্য করেন তিনি।’
টেকনাফের সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. এরফানুল হক চৌধুরী জানান, দ্বীপের জীববৈচিত্র্য রক্ষায় কাজ করছেন তাঁরা। স্থাপনা নির্মাণ বন্ধ এবং অবৈধ স্থাপনা উচ্ছেদে নিয়মিত অভিযান চলছে। সরকারের নির্দেশনা মানতে যা করণীয়, সবই করা হবে। সেন্টমার্টিনের চেয়ারম্যান মুজিবুর রহমান নির্মাণসামগ্রী সরবরাহে তিনি কোনোভাবেই জড়িত নন দাবি করে বলেন, ‘সেন্টমার্টিনে পোস্ট অফিস, কোস্ট গার্ড কার্যালয় ও লাইট হাউস নির্মাণ করা হচ্ছে। বাকি সব ইকো সিস্টেমে করা হচ্ছে।’ ইট-বালির ভবন ইকো হয় কিভাবে তার কোন উত্তর পাওয়া যায়নি চেয়ারম্যানের কাছে।
পরিবেশ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আজহারুল ইসলাম জানান, কৌশলে ইট, সিমেন্ট, বালির ভবন তৈরী করে বাঁশ-গাছ আর সন পাতা নিয়ে ঢেকে এখানে নাম দেয়া হয় ইকো রিসোর্ট। এর তথ্যও সংশ্লিষ্টদের দেয়া হয়েছে। এনভায়রনমেন্ট পিপল এর প্রধান নির্বাহী রাশেদুল মজিদ জানান, হাস্যকর ইকো প্রচারণায় একে একে আবাসিক হোটেল গড়ে উঠেছে, যা এ দ্বীপের জন্য হুমকি
স্বরূপ। সরকারি যথাযথ কর্তৃপক্ষের কোনো অনুমোদন ছাড়া অস্তিত্বের সংকটে থাকা একমাত্র প্রবাল দ্বীপে এভাবে প্রকাশ্যে স্থাপনা তৈরি হওয়ার পেছনে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের দায়িত্বে অবহেলা ও সমন্বয়হীনতা রয়েছে। দ্বীপ রক্ষায় অবশ্যই দেশের প্রচলিত আইন ও বিধি মানতে হবে। এক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করা জরুরি বলে মনে করেন তিনি।