কক্সবাজারের শুঁটকি দেশের চাহিদা মিটিয়ে এখন রপ্তানি হচ্ছে বহির্বিশ্বে। পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে নিয়মিত রপ্তানি করা হচ্ছে এ শুঁটকি। বাংলাদেশে উৎপাদিত শুঁটকির একটি বড় অংশ উৎপাদন হয় কক্সবাজারে। আগে দামে সস্তা থাকায় শুঁটকিকে গরিবের খাবার বলে তাচ্ছিল্য করা হলেও এখন শুঁটকির দাম বৃদ্ধির পাশাপাশি বদলে গেছে অবস্থানও। শুঁটকি এখন দেশের ধনীদের খাবার ম্যানুতে স্থান পাচ্ছে। এমনকি দেশের বিভিন্ন নামিদামি রেস্টুরেন্টসহ বিলাসবহুল হোটেলেও শুঁটকির বেশ কদর বেড়েছে ইদানিং। গত ১৪ নভেম্বর ঢাকায় কোস্ট ট্রাস্টের বিষমুক্ত শুঁটকি উৎপাদন স্টল পরিদর্শকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বিষমুক্ত উপায়ে শুঁটকি উৎপাদন কর্মসূচি দেশের অন্য এলাকায় ছড়িয়ে দেয়ার আহ্বান জানান। এ সময় তার সঙ্গে উপস্থিত থাকা সাবেক কৃষি মন্ত্রী মতিয়া চৌধুরীও সামুদ্রিক শৈবাল চাষ ও বিষমুক্ত শুঁটকি উৎপাদনের প্রতি বিশেষ আগ্রহ প্রকাশ করেন। তাদের সঙ্গে এ সময় আরও উপস্থিত ছিলেন পল্লী কর্ম সহায়ক ফাউন্ডেশনের (পিকেএসএফ) সভাপতি কাজী খলিকুজ্জামান আহমেদ এবং ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ মঈনউদ্দীন আব্দুল্লাহ। কোস্ট ট্রাস্টের উপ-পরিচালক তারিক সাঈদ হারুন। এ সময় কোস্ট ট্রাস্টের বিভিন্ন কার্যক্রম সম্বন্ধে প্রধানমন্ত্রীসহ অতিথিবৃন্দকে অবহিত করেন।
জানা যায়, পিকেএসএফের সহযোগি সংস্থা, বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠান, গবেষণা ও তথ্যপ্রযুক্তি এবং সেবামূলক প্রতিষ্ঠানসহ মোট ১৩০টি প্রতিষ্ঠান এ মেলায় অংশ নেয়। শীতের শুরু থেকে কক্সবাজার সমুদ্র উপকূলে কাঁচা মাছকে রোদে শুকিয়ে ‘শুঁটকি মাছ’ উৎপাদনের ধুম পড়েছে। আগামী মে পর্যন্ত টানা চলবে শুঁটকি উৎপাদন মৌসুম। এ বছর শুঁটকি বিক্রি করে প্রায় ৩০০ কোটি টাকা আয়ের সম্ভাবনা রয়েছে বলে জানান সংশ্লিষ্টরা। শহরতলীর নাজিরারটেক, ফদনারডেইল, নুনিয়াছড়া, সমিতিপাড়াসহ উপকূলীয় কয়েকটি গ্রাম ঘুরে দেখা গেছে, বিভিন্ন বয়সের হাজার হাজার মানুষ মহাব্যস্ত শুঁটকি উৎপাদনে। সাগর থেকে অসংখ্য ট্রলার মাছ আহরণ করে প্রতিদিন কক্সবাজার শহরতলীর নাজিরারটেক ও ফদনারডেইল ঘাটে ভিড়ছে। এসব ট্রলারে আসা বিভিন্ন কাঁচা মাছ রোদে শুকিয়ে শুঁটকি করা হচ্ছে। বাঁকখালী নদীর তীরের বিভিন্ন গ্রামের কয়েক হাজার বসত ঘরের ছাদে ও উঠানে মাচা বানিয়ে তৈরি হচ্ছে শুটকি।
উৎপাদনকারীদের সাথে কথা বলে জানা গেছে, জেলায় উৎপাদিত বেশিরভাগ শুটকিতে কোনো কেমিক্যাল মেশানো হয় না। সম্পূর্ণ প্রাকৃতিক উপায়ে সাগর উপকূলে মাচা তৈরি করে এ শুঁটকি তৈরি করা হয়। তাই কক্সবাজারের শুটকির চাহিদা বেশি।
দেখা গেছে, শহরে ৫০টির অধিক শুঁটকি মহালে শ্রমিকরা কেউ বড় বড় শুঁটকি পানিতে ধুয়ে নিচ্ছে, কেউ কেটে রোদে শুকাচ্ছেন। তারপর বাঁশ দিয়ে বিশেষভাবে তৈরি ঘেরগুলোতে পসরা সাজানো হয়েছে নানারকম মাছের। এখানে ছুরি, লইট্যা, পোপা, ফাঁইস্যা, লাক্কা, মাইট্যা, রূপচান্দা মাছসহ বিভিন্ন ধরনের শুঁটকি উৎপাদন করা হচ্ছে। কক্সবাজার জেলার বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় পুরোদমে চলছে শুঁটকি উৎপাদন। মহেশখালীর উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নের অন্তর্ভুক্ত স্বর্ণদ্বীপ খ্যাত সোনাদিয়া, শহরের নাজিরারটেক বৃহৎ শুঁটকি মহাল, খুরুশকুল, মহেশখালী, কুতুবদিয়া, টেকনাফের বাহারছড়া ও প্রবালদ্বীপ সেন্টমার্টিনের শুটকিমহাল কেবল বাণিজ্যিক কেন্দ্র নয়, এগুলো এক একটি পর্যটন স্পটও বটে। মহেশখালী উপজেলার কুতুবজোম ইউনিয়নের সোনাদিয়া দ্বীপে শুঁটকি মাছ উৎপাদনের ধুম পড়েছে। জীব বৈচিত্র্যসমৃদ্ধ একটি অনন্য সুন্দর দ্বীপ। দ্বীপটির আয়তন ৭ বর্গকিলোমিটার। কক্সবাজার শহর থেকে ৯ কিলোমিটার উত্তর-পশ্চিমে মহেশখালী চ্যানেলের মহেশখালী দ্বীপের দক্ষিণ দিকে অবস্থিত সোনাদিয়া বঙ্গোপসাগর ঘেষে অবস্থিত সোনাদিয়ার চর এলাকায় হাজার হাজার জেলে ক্ষণস্থায়ী আবাস স্থান তৈরি করে ফিশিং কৃত মাছ শুকিয়ে, শুঁটকি মহাল তৈরি করে কোটি কোটি টাকার মাছ দেশে বিদেশে রপ্তানি করে স্বাবলম্বী হচ্ছেন।
সোনাদিয়ার স্থানীয় ব্যবসায়ী আলম জানান, দেশের ২০ শতাংশ শুঁটকি এখান থেকে উৎপাদিত হয়। এখানকার শুঁটকি তরতাজা মাছ কেটে করা হয় এবং এতে কোনো ধরনের ক্ষতিকর কীটনাশক কিংবা পাউডার মেশানো হয় না। শহরতলীর নুনিয়াছরার শুঁটকি ব্যবসায়ী সালামত জানান, প্রতি সপ্তাহে তিনি নাজিরারটেক ও ফদনারডেইল গ্রাম থেকে গড়ে ১০০ মন শুঁটকি চট্টগ্রামের খাতুনগঞ্জে সরবরাহ করে থাকেন। সেখান থেকে শুঁটকি সারা দেশে যাচ্ছে বলে তিনি জানান। অন্যদিকে, কক্সবাজার জেলার উপকূলীয় এলাকা মহেশখালীর সোনাদিয়া, গোরকঘাটা, তাজিয়াকাটা, কুতুবজোম, কুতুবদিয়া উপজেলার বড়ঘোপ, খুদিয়ারটেক, আলী আকবর ডেইল, অংজাখালী, পশ্চিম ধুরুং, টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপ, সেন্টমার্টিন, জালিয়াপাড়া, সদর উপজেলার নাজিরারটেক, খুরুশকুল, সমিতিপাড়া, চৌফলদণ্ডিসহ বিভিন্ন উপকূলীয় এলাকায় বিপুল পরিমাণ শুঁটকি তৈরি হয়ে থাকে। এখানে রাতদিন কাজ করছেন শুঁটকি শ্রমিকরা। বর্তমানে প্রতি কেজি রূপচাঁদা ১ হাজার ২০০ থেকে আড়াই হাজার টাকা, মাইট্যা ৭০০ থেকে ১ হাজার টাকা, কোরাল ৯০০ থেকে দেড় হাজার টাকা, পোপা ৫০০ থেকে ১ হাজার টাকা, চিংড়ি এক হাজার থেকে ২ হাজার টাকা, লইট্যা ৪০০ থেকে ৮০০ টাকা, ছুরি ৬০০ থেকে দেড় হাজার টাকা, অন্যান্য মাছ ২০০ থেকে ৫০০ টাকায় বিক্রি করা হয়ে থাকে।
কক্সবাজার জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বলেন, নাজিরারটেক, সোনাদিয়া শুঁটকি উৎপাদনেরও বিশাল সম্ভাবনার জায়গা কক্সবাজার। এ ব্যাপারে মৎস্য বিভাগের পক্ষ থেকে ব্যবসায়ীদের প্রয়োজনীয় সুবিধা দেয়া হবে।
বাংলাদেশ সল্টেড অ্যান্ড এক্সপোর্টাস অ্যাসোসিয়েশনের সভাপতি বলেন, সরকার ফ্রোজেন ফুডসহ রপ্তানিমুখী শিল্প প্রতিষ্ঠানে শতকরা ১০ ভাগ ইনসেনটিভ দিয়ে থাকে। কিন্তু পোপাসহ অন্যান্য শুঁটকি রপ্তানির ক্ষেত্রে ব্যবসায়ীরা এ সুবিধা পাচ্ছেন না। এ সুবিধা পেলে শুটকির বিপরীতে বার্ষিক বৈদেশিক মুদ্রা উপার্জন ৪০০ কোটি ছাড়িয়ে যেতে পারে।